মহৎ পেশার মানুষ
দেশে গবেষণার অংশটা পিছিয়ে রয়েছে : ডা. খোরশেদ
গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গেছেন তিনি। প্রথমদিন যখন কাজে বের হলেন খুব ফরমাল পোশাকে গেলেন। একেবারে কোট-টাই পরে। কিন্তু গিয়ে তো অবাক! কেউ এ রকম পোশাক পরে আসেনি। সবাই খুব সাধারণ পোশাকে এসেছে। তিনি জানতেন না, সে দেশে যারা গবেষণা করে,তারা এমন পোশাকই পরে। একটু লজ্জিত হলেন তাঁর পোশাকের জন্য।
পরে অবশ্য তাঁর অধ্যাপক বললেন, ‘তুমি আর এমন পোশাক পরে এসো না। সাধারণ পোশাকেই এসো।’ সাধারণ পোশাকেই অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে পরবর্তীকালে তিনি গবেষণা চালিয়ে গেছেন এবং মন জয় করেছেন অধ্যাপকদের।
যাঁর কথা বলছি, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড বায়োমেডিকেল রিসার্চের প্রধান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষক ডা. খোরশেদ আলম। সম্প্রতি তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছে তাঁর গবেষণা, গবেষণাগার ও জীবনের গল্প।
ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার
টাঙ্গাইলে আমার জন্ম। বাবা পিডিবি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এখান থেকেই এসএসসি পাস করি। এরপর কুমিল্লা রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল থেকে এইচএসসি পাস করি। এসএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে চলে যাই। পরে আবার সেখান থেকে ফিরে আসি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়া শুরু করি। তবে আমার ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। সেটি হলো না।
এমবিবিএস পাস করার পর মনে হলো এমফিল করব। বায়োক্যামেস্ট্রিতে এমফিল করলাম। এমফিল করার পর জাপানে পিএইচডি করি। এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশে এসে পিজিতে যোগ দেই। এরপর ইউএসএতে গিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য সময় দেই।
আমি সাধারণত গর্ভকালীন সমস্যা, ভ্রূণের বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়, গর্ভাবস্থা ব্যবস্থাপনা, প্লাসেন্টা সংক্রান্ত গবেষণা করি। মূলত, জেনেটিক্স টেকনিক গবেষণায় ব্যবহার করি। এগুলো মৌলিক গবেষণার জার্নাল, ‘ডেভলপমেন্ট’, ‘দ্য জার্নাল অব বায়োলজিক্যাল ক্যামেস্ট্রি’, ‘অ্যান্ড্রোকাইনোলজি’তে প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে স্বতন্ত্র গবেষণাগার নির্মাণ
বর্তমানে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র গবেষণাগার চালুর কাজে হাত দিয়েছি। এর নাম সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড বায়োমেডিকেল রিসার্চ। হ্যাকেপ-এর প্রোজেক্ট ছিল এটি। এটি ইউনিভার্সিটির গ্র্যান্ড কমিশনের প্রোজেক্ট। ২০১৪ সালে শুরু হয়। শেষ হয় ২০১৭ সালে। পরে একে বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার করার জন্য প্রোজেক্ট হিসেবে পাঠাই। ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর সেন্টার পরিচালনার জন্য নীতিমালা অনুমোদন হয়।
আসলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাধীনভাবে গবেষণা করবার জন্য রিসার্চ সেন্টার দরকার। গবেষণার জন্য নির্দিষ্টভাবে ডেডিকেটেড কিছু নেই।
আসলে আমার মনে হয়, আমাদের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি গবেষণা অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের দেশে গবেষণার অংশটা পিছিয়ে রয়েছে। রোগী দেখতেই ব্যস্ত থাকতে হয়। বাইরের দেশগুলোতে গবেষণার জন্য সময় দেওয়া হয়।
আমার মনে হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি রিসার্চ সেন্টার করা দরকার। যেখানে সবাই গবেষণা করতে পারবে, দলগতভাবে বা একা। এটাই ছিল এই রিসার্চ সেন্টার করার লক্ষ্য। বায়োক্যামিস্ট্রি বিভাগে যোগ দেওয়ার পর থেকেই গবেষণাগারটি করার বিষয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম ইকবাল আর্সলান আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন এবং এখনো উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।
কেউ গবেষণা প্রোজেক্ট নিয়ে এলে আমি সে প্রোজেক্ট তৈরি করতে সাহায্য করব। যারা গবেষণা করতে চায়, আমরা তাদের উৎসাহিত করতে চাই। এখানে এমন কিছু যন্ত্র রয়েছে এবং ভবিষতেও থাকবে যেগুলো গবেষণা করার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। যারা গবেষণা করতে চায়, একাও করতে পারে আবার দলগতভাবেও করতে পারে। আবার কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েও কাজ করতে পারে।
কখনো টাকার পেছনে ছুটিনি
আমি কখনো টাকার পেছনে ছুটিনি। তবে এখন মনে হয় টাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার দর্শন হয়তো ভুল ছিল। টাকা থাকলে আজ আরো অনেক কাজ করা যেত। এখন মনে হয় জীবনে হয়তো একটু স্বার্থপর হওয়া প্রয়োজন। আমার এক মেয়ে। আমার স্ত্রী ডা. নিরু নাজমুন নাহার রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ।
আমার জীবনে সফলতাও নেই, ব্যর্থতাও নেই। আসলে আমি মনে করি, কাজ করে যেতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষের কোথাও না, কোথাও অবদান রয়েছে। কৃষক, শ্রমিক সবারই অবদান রয়েছে। নির্মাণ শ্রমিক যখন কাজ করে তখন এত বড় বিল্ডিংয়ের কিছু অংশে হলেও তার অবদান থাকে।
বর্তমানে গবেষণাগার নিয়ে কাজ করছি। ভবিষ্যতেও গবেষণা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। যদি সম্ভব হয় ভবিষ্যতে প্রি-একলামসিয়ার ওপর গবেষণা করতে চাই।
ছাত্রদের গবেষণায় উৎসাহ দিতে হবে
আমাদের শিক্ষকদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। ছাত্রদের গবেষণা করতে উৎসাহ দিতে হবে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া, সময় দেওয়া, শিক্ষকদের এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ সাহায্য করতে হবে। গবেষণা করার জন্য আলাদা সময় দিতে হবে।
যারা গবেষণাতে অংশ নেবে তাদের আলাদাভাবে সম্মানিত করা দরকার সরকারের পক্ষ থেকে। সরকার যেসব জায়গায় গুরুত্ব দিতে চায়, সেসব জায়গায় অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে হবে। যারা গবেষণা করবে তাদের দুই বছর আগেই হয়তো পদোন্নতি দিল, এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে হয়তো ছাত্র, শিক্ষকরা গবেষণা করতে আগ্রহ পাবে।