শিশুর জ্বর হলেই অ্যান্টিবায়োটিক নয়

এই ঋতুতে শিশুরা বিভিন্ন কারণে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ভাইরাসের কারণে শিশুদের অনেকেই এখন জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক মা-ই জ্বর হলে আতঙ্কিত হন এবং শিশুকে দ্রুত সুস্থ করার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করান। না বুঝে এসব অ্যান্টিবায়োটিক সেবন হিতে বিপরীত হয়ে উঠতে পারে। আজ ৯ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের এপিডিমিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রিয়াজ মোবারক।
প্রশ্ন : ঋতু পরিবর্তনের এই সময় পানিজনিত সমস্যা, ডেঙ্গু জ্বর বা ফ্লুজনিত জ্বরে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন?
উত্তর : এখনকার সময়ে আমরা সবাই শিশুদের অনেক যত্ন নিই। তবে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে আমাদের তুলনায় অনেক কম। এটি বৃদ্ধি পেতে একটু সময় লাগে। তাই সমস্যা হয়ে যায়। এখন ঋতুর জন্য ডেঙ্গু মশা জন্ম নিচ্ছে। বাচ্চারা যখন বাইরে খেলাধুলা করছে, পা খোলা রাখছে, তখন হয়তো দিনের বেলা মশা কামড় দিচ্ছে। এ ছাড়া টাইফয়েড হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে টাইফয়েড হচ্ছে। কারণ, বন্যা বা পরিবেশগত কারণে বিশুদ্ধ পানির একটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া এখন ফ্লুর সময় চলছে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের জ্বরের মৌসুম চলছে এখন। এতে বেশির ভাগই ক্ষেত্রেই শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ, তাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তিটা বড়দের তুলনায় কম।
প্রশ্ন : একটি শিশুর জ্বর হলে বোঝার উপায় কী এটি টাইফয়েড, ডেঙ্গু, না সাধারণ জ্বর। এবং কখন চিকিৎসকের কাছে তাকে নিয়ে যেতে হবে?
উত্তর : আসলে ডেঙ্গুর একটি বিশেষ চরিত্র রয়েছে। টাইফয়েডেরও একটি বিশেষ চরিত্র রয়েছে। তবে আজকাল অনেক জ্বরেরই চরিত্রগুলো ঠিকমতো প্রকাশ পায় না, বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। যেমন : ডেঙ্গুর চরিত্র হলো প্রথম দুই-তিন দিন জ্বর থাকবে, এর পর হঠাৎ দুই দিন জ্বর থাকবে না। এর পর আবার জ্বর শুরু হলো। এটাকে বলে বাইফেজিক ফিভার। আর এর সঙ্গে একটা র্যাশ দেখা দেবে। এই জিনিসগুলোকে নির্ণয় করা একজন মায়ের জন্য দুষ্কর।
আর টাইফয়েডে আগে যেটা ছিল যে একটু একটু করে জ্বর বাড়ত। তবে এটা এখন আর সেভাবে হয় না। টাইফয়েড এখন অল্প জ্বর নিয়েও হয়, বেশি জ্বরেও হয় এবং জ্বর অনেক বেশি হয়। এ ছাড়া ভাইরাসের কারণে জ্বরগুলোও এখন অনেক উচ্চ তাপমাত্রায় হচ্ছে। এখন মায়েদের এই জ্বরগুলোকে আলাদা করা খুব কঠিন।
প্রশ্ন : তাহলে তাঁরা জ্বর হলে কী করবেন?
উত্তর : যদি আমরা দেখি, জ্বর হওয়ার পর বাচ্চার অবস্থা অতিরিক্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছে, খাচ্ছে না, বাচ্চা বেশি বমি করছে, তখন আন্দাজ করতে হবে সেটা একটি খারাপ জ্বর হতে পারে। আর আমরা যদি দেখি হাত-পা লাল হয়ে গেছে বেশি, বাচ্চার পেট ফুলে গেছে, বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সেটি বিপদ চিহ্ন। তখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। টাইফয়েডের বিষয় হলো অনেক দিন যদি জ্বর থাকে, প্যারাসিটামল খাইয়ে মায়েরা জ্বর কমাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কমছে না। এটা যদি ছয়-সাত দিনের বেশি বা পাঁচ দিনের বেশি হয়ে যায়, তখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
ভাইরাসের কারণে জ্বরগুলো অনেক উচ্চ তাপমাত্রার হয়। সেটা অনেক সময় সাত দিন থাকে। তবে আস্তে আস্তে জ্বরের মাত্রা অনেক কমে আসে। দুই-তিন দিন থাকার পর একেবারেই শেষ হয়ে যায়। অনেকগুলো প্যারাসিটামল খাওয়ার পর আর আসে না। সুতরাং এভাবে কিছুটা রোগের পার্থক্য বোঝা যেতে পারে যে কোনটা ভাইরাল বা সাধারণ জ্বর। এবং এতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাচ্চাকে দেখে বুঝতে হবে, যদি অবস্থা অনেকখানি খারাপ হয়ে যায়, তাহলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে প্রায়ই আমরা শুনি, কিছু কিছু মা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গিয়ে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন। আবার অনেকে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তাকে জোর দেন উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
উত্তর : আজকাল যেটা আমরা দেখতে পাই, প্রত্যেক মা চান শিশুটি তাড়াতাড়ি যেন ভালো হয়ে যায়। তিনি বলেন, বাচ্চার কষ্ট সহ্য করতে পারব না। ডাক্তার সাহেব একটা ভালো ওষুধ দিয়ে দেন। ভালো ওষুধ মানে হলো অ্যান্টিবায়োটিক। আমার মনে হয়, অ্যান্টিবায়োটিক একটা মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি হিসেবে কাজ করে। তাঁরা ভাবেন, অ্যান্টিবায়োটিক দিলেই বোধ হয় ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু মা এবং পরিবারের লোকদের অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে। সব জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন পড়ে না। যেমন ডেঙ্গু জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। ভাইরাস জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু টাইফয়েড হলে বা ডায়রিয়াজনিত যদি কোনো জ্বর হয়, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের দায়িত্ব মা বা পরিবারের কারোরই নিজের হাতে নেওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, অ্যান্টিবায়োটিক খুব ভালো জিনিস নয়।
আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিক যেকোনো লোক কিনতে পারে। অন্য দেশের মতো এ রকম না যে চিকিৎসাপত্র লাগবে। মা হয়তো গেলেন ফার্মেসিতে। বললেন, বাচ্চার জ্বর হয়েছে, একটা ভালো অ্যান্টিবায়োটিক দেন। তখন তারা হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিল। এই জিনিসগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের মায়েদের, পরিবারের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
প্রশ্ন : অনেকে তো মনে করছেন, এতে তিনি সুফল পাচ্ছেন। ক্ষতিটা আসলে কী?
উত্তর : ক্ষতি হলো যদি অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন না হয় এবং আপনি অযথাই একটা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলেন, পরবর্তীকালে হয়তো ওই অ্যান্টিবায়োটিক আর ওই অসুখের জন্য ব্যবহার করতে পারব না। করলে এটা আর কাজ করবে না। ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়। এর ফলে ওষুধের সংখ্যা কমে আসছে। ভাইরাস জ্বরেও অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে কিডনিতে চাপ পড়বে। তাই অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা ঠিক নয়।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু জ্বর, টাইফয়েড এবং ভাইরাস জ্বরে যেন শিশুরা আক্রান্ত না হয়, এ বিষয়ে করণীয় কী?
উত্তর : ভাইরাস জ্বর প্রতিরোধে বাচ্চাকে নিয়ে মার্কেট, বিয়েবাড়ি এসব জায়গায় যাওয়া যাবে না। এতে করে ভাইরাস জ্বর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। কারণ, অন্যের দেহের ভাইরাস তখন ছড়ায়। শিশুদের যেহেতু রোগ প্রতিরোধ শক্তি কম, তাই তাদের নিয়ে এসব উৎসবে, ভিড়ের ভেতর না যাওয়াই ভালো।
টাইফয়েড প্রতিরোধে পানির বিষয়ে আপনাকে সচেতন হতে হবে। এটা পানিবাহিত রোগ বা খাবারবাহিত রোগ। বাচ্চাদের খাবারগুলো যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
ডেঙ্গুর প্রতিরোধে স্কুলে যায় যেসব বাচ্চা, তাদের ফুল প্যান্ট বা ফুল স্লিভ পোশাক পরাতে হবে। খোলা জায়গায় বাচ্চাদের খেলাধুলা করতে না দেওয়াই ভালো। মশা নিধনের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বাগান, জমানো পানি, ফুলের টব এগুলো পরিষ্কার রাখা ভালো।