বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

রোগীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে

Looks like you've blocked notifications!

আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ’। ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এই প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রতিবছর নির্ধারিত করে দেয়। মানসিক রোগীরা আমাদের আপনজন। তারা বিপজ্জনক নয়। এই রোগগুলোর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ চিকিৎসা রয়েছে। রোগীদের রয়েছে চিকিৎসা পাবার অধিকার। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১৫ পালিত হচ্ছে আজ।

আমাদের সমাজে মানসিক রোগীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। সমাজ মানসিক রোগীদের অনেক সময় সহজভাবে নিতে পারে না। মানুষ মানসিক রোগীদের বলে ‘পাগল’। মানসিক রোগীদের পাগল বলা সামাজিক অপরাধ। সমাজ মানসিক রোগীদের নিয়ে নানা ধরনের কৌতুক করে।  কারো মানসিক রোগ হলে তার কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় না। মুহূর্তে মানুষ হিসেবে তার দাম কমে যায়। সে উত্তরাধিকার থেকেও অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়ে যায়। তাকে পরিবারের কোনো সুস্থ সদস্যের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। সেই আত্মীয়ই তার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ তত্ত্বাবধান করে। অনেক সময় ওই আত্মীয় রোগীকে অবহেলা করে। তার যত্ন ও চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়।

যখন পরিবারের কারো মানসিক রোগ হয় তখন গোটা পরিবারই ভয় পেয়ে যায়। তারা কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি হয় না যে তাদেরই একজন মনসিক রোগী। যে পরিবারে মানসিক রোগ আছে তাদের বিয়ে হতে সমস্যা হয়। মানুষ ভাবে- ‘ওর ভাই একটা পাগল। ও-ও পাগল হয়ে যাবে। ওর ছেলেপুলেও পাগল হবে। তাই এখানে বিয়ে না করাই ভালো।’ বয়স হলে হয়তো মানসিক রোগীদের বিয়ে করার ইচ্ছা হয়। এদিকে জেনেশুনে কেউ মানসিক রোগীকে বিয়ে করবে না। সবাই ভয় পায়। বিশেষত গুরুতর মানসিক রোগীরা আয়-রোজগার করতে পারে না। তারা নিজের যত্ন নিজে নিতে পারে না। পরিবারের সদস্যরা তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ভাবে, আমরা যখন থাকব না তখন ওর একটা পরিবার থাকলে ওর দেখভাল করতে পারবে। তারা মানসিক রোগ গোপন করে বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলে অনেক সময় বিয়ে টিকে না। তবে গুরুতর রোগ যাদের আছে তাদেরই এই সমস্যাটি বেশি হয়।

এ ছাড়া মানসিক রোগীরা প্রায়ই অপচিকিৎসার শিকার হয়। তথাকথিত কবিরাজ ও ফকিররা তাদের মেরে, পিটিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে, নানা ভাবে অত্যাচার করে। তাবিজ-কবজ ও পানি পড়ায় কাজ তো হয়ই না, শুধু বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিতে দেরি হয়ে যায়। ফলে রোগ ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং চিকিৎসা দেওয়া জটিল হয়ে উঠে। অনেক সময় রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। তাকে বাড়িতে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তাকে জীব-জন্তুর মতো ছোট্ট কোনো ঘরে আটকে রেখে জন্তুর মতোই অবহেলায় খাবার খেতে দেওয়া হয়। তাকে কেউ ডাকে না, সামাজিক অনুষ্ঠানে নেয় না, তার সাথে গল্প করে না। তার ছোটরাও তাকে আর সম্মান করে না।

 

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৬২.৩৭% রোগীর যত্নগ্রহণকারী রোগীদের চিকিৎসার জন্য কবিরাজ ও ঝারফুককারীদের কাছে নিয়ে যায়। গবেষণায় মানসিক রোগ বিষয়ে অনেক ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে বলে পাওয়া যায়। অর্ধেকের বেশি অংশগ্রণকারী মনে করে যে, মানসিক রোগের সঠিক চিকিৎসা হলো ধর্মীয়, কবিরাজি, ইউনানী, হেকেমী ও হোমিও চিকিৎসা। এক গবেষণায় অর্ধেকের বেশি অংশগ্রহণকারী মানসিক রোগের কারণ হিসেবে বিভিন্ন অতিন্দ্রীয় ও অতিপ্রাকৃত কারণকে দায়ী করে। গবেষণায় ৭৭.১% অংশগ্রহণকারী মনে করে যে, মানসিক রোগীর সাথে সম্পর্ক রাখলে বা তাদের সাথে একসাথে বসবাস করলে অন্যরাও মানসিক রোগী হয়ে যায়। ৫১.৮% মনে করে বিয়ে দিলে মানসিক রোগ সুস্থ হয়ে যায়।

মানসিক রোগী যখন চিকিৎসার জন্য যায় তখন আরেক সমস্যা। মানসিক ডাক্তার নন এমন অন্যান্য বিষয়ের ডাক্তাররা অনেক সময় বলেন - ‘তোমার কোনো সমস্যাই নেই। তুমি ভালো আছ। বাসায় যাও।’ ফলে পরিবারের সদস্যরা ভুল বোঝে। তারা মনে করে যে, রোগী শয়তানি করছে। তখন তার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে। অনেক সময় যাদের মানসিক  রোগ বিষয়ে ধারণা কম এমন ডাক্তাররা ভয় দেখিয়ে রোগী সুস্থ করার চেষ্টা করেন।

মানসিক রোগীরা যখন মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায় তখনো বেশ কিছু সমস্যা হয়। একজন ডাক্তারকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে বহুসংখ্যক রোগীকে দেখতে হয়। ফলে তারা সময় কম পান। ফলে ডাক্তার রোগীর সমস্যা সময় নিয়ে শুনতে পারেন না। এ ছাড়া যখন ওষুধ লিখছেন তখন কেন কোন ওষুধ দিচ্ছেন এবং তা কতদিন ধরে খেতে হবে, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে কী করতে হবে, কতদিন পর আবার ফলোআপে আসতে হবে, রোগী ওষুধ খেতে না চাইলে কী করতে হবে, রোগের লক্ষ্মণ বেড়ে গেলে কী করতে হবে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে কী প্রক্রিয়ায় করতে হবে, রোগী আক্রমণাত্মক হলে কী করতে হবে, রোগীর যত্ন কীভাবে নিতে হবে— এই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেন না ডাক্তার। পরিবারের সদস্যদের মনে নানা প্রশ্ন থাকে— ‘ও ভালো হবে কি না? ওর কী রোগ হয়েছে? ওকে বিবাহ দিতে পারব কি না? কেন এই রোগ হলো? ...।’ কোনো জবাবই মেলে না। ফলে মানসিক রোগীর যত্ন ও চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়ে যায়।

মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় শুধু ওষুধ যথেষ্ঠ নয়। দরকার  বহুসংখ্যক পেশাজীবীর একটি দল মিলে একজন রোগীকে সেবা দেওয়া। এই ধরনের দলকে বলে ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম’। রোগীর সাথে কথা বলা দরকার। যাতে তারা প্রাণখুলে কথা বলে মনে শান্তি পায়। এ জন্য সাইকোথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সাইকোথেরাপি দলীয়ভাবে দিলে তাকে বলে গ্রুপ সাইকোথেরাপি আর ব্যক্তিগতভাবে দিলে তাকে বলে ইন্ডিভিজ্যুয়াল সাইকোথেরাপি। পারিবারিক অশান্তি দূর করার জন্য রয়েছে ফ্যামিলি থেরাপি আর বৈবাহিক অশান্তি দূর করার জন্য ম্যারিটাল থেরাপি প্রয়োগ করা হয়।

মানসিক রোগীদের সেবা দেবার মতো দক্ষ জনবল খুবই সীমিত। দেশে মানসিক রোগের ডাক্তার রয়েছে ১৯৫ জন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রয়েছেন প্রায় ৫০ জন। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট রয়েছেন ১০০ জনের বেশি। দেশে সাইকিয়াট্রিক নার্সিং বা সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কের ওপর কোনো প্রশিক্ষণ কোর্স নেই। ইদানীংকালে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সোস্যাল ওয়ার্ক নামে একটি কোর্স চালু হয়েছে। দেশের মানুষ ষোল কোটির ওপর। পূর্ণবয়স্কদের শতকরা ষোল দশমিক এক ভাগ মানসিক রোগী। আর শিশুদের শতকরা আঠারো দশমিক চার ভাগ মানসিক রোগী। এদের সেবা দেওয়ার জন্য দেশে বিদ্যমান জনবল অনেক সীমিত। এ ছাড়া এটাও একটা বাস্তবতা যে, যতটুকু চিকিৎসাসেবা আছে তার প্রায় সবটুকুই হচ্ছে মেডিকেল সেবা। অর্থাৎ ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা। কিন্তু যারা মনোবৈজ্ঞানিক সেবা দেবে, যারা সামাজিক ও পেশাগত সেবা দেবে তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। সাইকিয়াট্রিক নার্সিং কোর্স  না থাকায় আমাদের নার্সরা মানসিক বিষয়ে ততটা জানেন না। এই রোগীরা অন্যান্য রোগী থেকে অনেকটা অন্য রকম। মানসিক রোগীদের সেবা দিতে নিবিড় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের বিকল্প নেই।

একজন মানসিক রোগীকে সুস্থভাবে জীবনযাপন করাতে তার মর্যাদা সমুন্নত করতে হবে। কারণ সে-ও সমাজেরই অংশ। তাদের জবরদস্তি করা চলবে না। তাদের মানুষ হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে। তাদের উত্তরাধিকার বঞ্চিত করা যাবে না। মানসিক রোগের কারণে কাউকে চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া যাবে না। তাদের পরিবার গঠন করার অধিকার আছে। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।

বর্তমানে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত অতি প্রাচীন ‘লুনাসি অ্যাক্ট'-কে প্রতিস্থাপনের জন্য- ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন’ -এর খসড়া সরকারের বিবেচনায় আছে। এ ছাড়া ‘মানসিক স্বাস্থ্য পলিসি’ প্রণয়ণের কাজ চলছে। এগুলো প্রণীত হলে মানসিক রোগীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এগুলো সহায়ক হবে। মানসিক রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়াও খুব জরুরি। রোগ হয়ে যাওয়ার থেকে হওয়ার আগে প্রতিরোধ করাই উত্তম। এর জন্য পরিবারে, স্কুলে ও সমাজে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সঠিকভাবে শিশু প্রতিপালন করতে হবে, শিশুকে মাঠে সমবয়সীদের সাথে খেলতে দিতে হবে, ভালো স্কুলে পড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই আমরা পারি মানসিক রোগীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে।  

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট