মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে দেখতে হবে

Looks like you've blocked notifications!
ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব।

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে আজ ১০ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৭০তম পর্বে আলোচিত হয়েছে ‘মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদা’- বিষয়টি নিয়ে। আজ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব।

প্রশ্ন : এবারের মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় কী?

উত্তর : ১৯৯২ সালে প্রথম মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা শুরু হয়। মানসিক স্বাস্থ্য অন্যান্য স্বাস্থ্যের তুলনায় এখন পর্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে। তখন মানুষের মধ্যে চিকিৎসা এবং সচেতনতার বিষয়টি পিছিয়ে ছিল। তখন কাজ ছিল, একটি বড় অনুষ্ঠান করে টেলিভিশনে প্রচার করা। এরপর ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়। প্রত্যেক বছর আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য হয়। এই বছর যেটা ঠিক করা হয়েছে, আমি মনে করি, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের সাথে সেটা ভালো যায়। এটি হলো, ডিগনিটি ইন মেন্টাল হেলথ। বাংলায় বলতে পারি, মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ।

আমরা প্রায় প্রতিদিনই দেখি, যারা মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত- হয়তো রোগী বা রোগীর আত্মীয় স্বজন, অথবা আমরা যারা চিকিৎসক, অথবা এই বিষয়ে যারা জড়িত তাদের অন্য সব ডিসিপ্লিনের মতো একই চোখে দেখা হয় না। এটা আমরা স্পষ্টভাবেই বুঝি। রোগী অথবা রোগীর আত্মীয়স্বজন বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝেন। তারা সরাসরি এর শিকার হন। শারীরিক অন্য রোগগুলোকে মানুষ রোগ হিসেবে দেখে, তবে মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে এখনো গুরুত্ব দেয় না।  

সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারে সেই কারণে এবার এই প্রতিপাদ্যটি ঠিক করা হয়েছে। এজন্য আমি মনে করি এটি খুব দরকারি বিষয়।

প্রশ্ন : কী করছেন আপনারা আজকের এই দিনে?

উত্তর : আমাদের দেশে তো করা হয়ই, সারা পৃথিবীতে দিবসটি পালন করা হয়। এই দিবস পালন করার জন্য অনেক রকম কাজ হয়। টেলিভিশন অনুষ্ঠান, মিডিয়াতে কাজ, নিজস্ব ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠান, মানসিক রোগীদের ফ্রি চিকিৎসাও করা হয়। এ ছাড়া  রাষ্ট্রীয়, সামাজিক অ্যাসোসিয়েশনগুলো তো বিভিন্নভাবে কাজ করে। বিশেষত সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই কাজ। কারণ এখনো কেবল আমাদের দেশ নয় পুরো পৃথিবীতে এই বিষয়গুলোর প্রতি সচেতনতা কম।

আমাদের একটি পত্রিকা রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক যেসব অনুষ্ঠান হবে  সেখানে আমরা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে উল্লেখ করার চেষ্টা করব।

প্রশ্ন : এই যে বলছিলেন রোগীর মর্যাদা বা রোগীর পার্থক্য করতে পারছি না। এটি কেন হচ্ছে? এর পেছনে কারণ কী?

উত্তর : এর তো আসলে অনেক কারণ। এককথায় বলা যাবে না। বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কম এটা যেমন সত্য তেমনি যারা সুগঠিত করবেন তাদেরও এই বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকে না। এটা আমি কাউকে ছোট করার জন্য বলছি না। বাস্তব কথা বলছি।

আজকে থেকে প্রায় ১০০ বছর আগেও মানসিক রোগীকে অসুস্থ ভাবা হতো না। ভাবা হতো সে একটা সামাজিক নিয়ম-রীতি ভঙ্গ করছে, সুতরাং সে অপরাধী এবং একটা শব্দ ব্যবহার করতো ‘পাগল’। যেটা এখনো আছে। অপরাধী ভাবার কারণে, ব্যক্তিটি যে অসুস্থতার কারণে খারাপ কাজ করছে সেটা বুঝতে পারত না। এমনও হতো তাদের বন্দি করে রাখা হতো। বা দ্বীপান্তর করা হতো। বা আরো অনেক রকমের শাস্তি দেওয়া হতো।

এখন এ রকমও বলা হয়, তুমি যদি এ রকম আচরণ কর, তোমাকে সাইক্রিয়াটিকের কাছে পাঠানো হবে। এটাও যেন একটা ভয়ঙ্কর বিষয়।

প্রশ্ন : এই যে বলছিলেন মর্যাদাবোধ এটা যাতে বাড়ানো যায় সেজন্য সমাজের মানুষের কী ভূমিকা রয়েছে? আপনারা যারা কাজ করছেন কতটা ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন?

উত্তর : আমি যদি ভুক্তভোগী হই বা পরিবারের কেউ যদি ভুক্তভোগী হয় সাধারণত সামাজিক চাপের কারণে আমি একটু পিছনে থাকি। পিছনে থাকি ঠিক আছি। কিন্তু আমার সত্যটা নিয়ে যদি দাঁড়াতে পারি, এটা আমরা রোগ, আমার চিকিৎসা করতে হবে, এই বিষয়টি বোঝা জরুরি। আর যারা আমাদের মতো কাজ করেন তাঁদেরও অনেক কাজ করার আছে। যেমন : তাদের ভরসা দেওয়া এবং সচেতনতা বাড়ানো। পাশাপাশি সঠিক বিষয়টিকে বলা, ‘চিকিৎসা করলে এটা ভালো হয়ে যাবে— এটা অপরাধ বোধের বিষয় নয়, এটা রোগের বিষয়।’   চিকিৎসা নিলে সে ভালো হয়ে আসবে। সামাজিক ভাবে সে বিভিন্ন কাজে অংশ নিতে পারবে। সেটা বোঝানো আমাদের কাজ।

এখানে মিডিয়ারও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে যে সঠিক বিষয়টি মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলেন, বা যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন প্রত্যেকেরই এখানে ভূমিকা থাকবে।

আমরা এইডস আক্রান্তকে এখন রোগী হিসেবে দেখি যে সে অসুস্থ। ক্যানসার বা আরো ১০টা রোগকে রোগ হিসেবে দেখি। এখানে শুধু রোগ হিসেবে দেখার আগেই অনেক চিন্তাভাবনা চলে আসে। পরেও আরো বিষয় থাকে। এটা দূর করা দরকার। এটিই হলো মর্যাদাবোধের জায়গাটি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন এ বিষয়ে কাজ করছে।  

এ ছাড়া যাঁরা কাজ করছেন তাঁদেরও মানুষ একটু ভিন্ন চোখে দেখেন। আমাদেরও বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। তবে ক্ষতিটা কিন্তু যারা অসুস্থ রোগী রয়েছেন তাঁদেরই হচ্ছে।

আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমি যখন প্রশিক্ষণ নিতে আসি। আমার বাবা দেখতে এসেছিলেন কোথায় এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মানে উনার ইচ্ছে ছিল না প্রথম দিকে আমি সাইক্রিয়াটিস্ট হই। এতে উনাকে তো আসলে দোষ দেওয়া যায় না। এই যে সামাজিকভাবে একটি নেতিবাচক বিষয়  তৈরি হয়েছে— এখান থেকে সমস্যাটি হয়। এখান থেকে সরে আসতে হবে। কেউ তো ইচ্ছে করে এই কাজ করে না যে আমি অসুস্থ হই বা আমি একটি খারাপ জায়গায় থাকি। এখন অনেকেই চিকিৎসার জন্য আসে। যদি না আসত তাদের চিকিৎসা কি দরকার হতো না। তাহলে চিকিৎসা কোথায় করত? বৈজ্ঞানিকভাবে কোথাও না কোথাও তো সাহায্যটা পেতে হবে। এই মর্যাদাবোধ যখন বেশি থাকবে তখনই আমরা সুবিধাটা বেশি পাব।