গরমে শিশুদের ত্বকের যত্নে কী করবেন?
কখনো গরম, কখনো বৃষ্টি। আবহাওয়ার একটি ভীষণ তারতম্য চলছে এখন। এই গরমে শিশুদের ত্বকে বাড়তি যত্ন প্রয়োজন।
গরমে শিশুদের ত্বকের যত্নের বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন। বর্তমানে তিনি শিওর সেল মেডিকেলের ডার্মাটোলজি বিভাগে পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : আজকের দিন শেষে আগামী দিনের সূর্যদ্বয় একটি বিশেষ দিন। বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা সবাইকে। এখন আবহাওয়াটায় দেখা যায়, প্রচণ্ড গরম, আবার হঠাৎ করে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে কিন্তু ত্বকের ওপর অনেক বড় প্রভাব পড়ে। শিশুদের ত্বক একটু নাজুক এবং অতি সংবেদনশীল, বড়দের তুলনায়। আমি একটু জানতে চাইব, শিশুদের ত্বকের যত্নটা এ সময় কীভাবে করতে হবে ?
উত্তর : আমাদের ত্বকের মতো শিশুদেরও ত্বকে স্তর থাকে, তবে আমাদের ত্বকের স্তরগুলো যেমন একটু পুনর্গঠিত, শিশুদের ক্ষেত্রে কিন্তু একটু দুর্বল। এই জন্য শিশুদের ত্বক নাজুক, সংবেদনশীল। আর পরিবেশে যে ঋতু বদলের খেলা হয়, এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের নানা রকম রোগ দেখা দেয়।
এখন তো গরম, সঙ্গে একটু বৃষ্টি, এতগুলো পরিবর্তনে, শিশুর ত্বক হয়ে ওঠে আরো সংবেদনশীল। তবে আমরা যদি একটু বিশেষ যত্ন নিই, একটু খেয়াল রাখি, তাহলে কিন্তু এই সমস্যাগুলো সেভাবে দেখা দেবে না। শিশুদের ত্বক থাকবে সুরক্ষিত।
প্রশ্ন : সাধারণত কী কী সমস্যা হয় এই গরমে?
উত্তর : একটি ডাটায় দেখা গেছে, গরমে শিশুর ৩০ ভাগ ত্বকের সমস্যা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে সংক্রামক, অসংক্রামক দুই ধরনের রোগই হয়। গরম, সঙ্গে একটু বৃষ্টি- সবার ধারণা থাকে সংক্রামক রোগগুলোই হয়তো বেশি হয়। তবে অসংক্রামক রোগের আশঙ্কা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর সংক্রামক রোগগুলো হয় স্পর্শ থেকে।
প্রশ্ন : কী ধরনের রোগ থাকতে পারে যেগুলো সংক্রামক?
উত্তর : আমরা যদি জীবাণু দিয়ে ভাবি-ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ইস্ট ও ফাঙ্গাস সঙ্গে নানা রকম প্যারাসাইট দিয়ে তৈরি হয় ত্বকের প্রদাহ।
সেই ক্ষেত্রে ভাইরাস দিয়েই শুরু করি। যেমন : চিকেন পক্স। এটি খুব প্রচলিত একটি রোগ।
প্রশ্ন : এখন প্রচুর চিকেন পক্স হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পানির মতো দানা। অনেকে একে মাসিপিসি ভাবে। পরে দেখা যায়, সম্পূর্ণ শরীরে ছড়িয়ে গেছে। শিশুদের সঙ্গে মায়েদের হচ্ছে বা মায়েদের থেকে শিশুদের হচ্ছে। যেহেতু এটি একটি সংক্রামক রোগ। পরে এই পানি পানি দানাগুলো পুঁজযুক্ত হয়ে ব্যক্টেরিয়াল সংক্রমণ হয়ে যায়। শুরু হয়েছে কিন্তু ভাইরাস দিয়ে। শেষ হচ্ছে ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে।
প্রশ্ন : ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে পুঁজ কি সব শিশুর ক্ষেত্রে হতে পারে?
উত্তর : একটু যদি সচেতন থাকা যায়, একটু মেনে চলা যায়, এসব সময় শিশুদের খাবারে অরুচি দেখা দেয়। কারণ, নবজাতক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের চিকেন পক্স হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সেই ক্ষেত্রে তাদের একটু আলাদা থাকা দরকার। আর যেসব শিশু স্কুলে যাচ্ছে, এদের আমরা বলি যে, বাসায় বিশ্রাম নিতে। এই ভাইরাস থেকে পানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, আর সেখান থেকেই শুকিয়ে যায়। এখানে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দিয়ে থাকি। অনেক সময় ভ্যাক্সিনেশনের কাজ করে।
আর আরেকটি রোগ রয়েছে, সেটি হলো হাম, মিসেলস।এখানেও পুরো শরীরের র্যাশ হয়, র্যাশগুলোর সঙ্গে একটু চুলকানি হয়। নাক দিয়ে পানি পড়ে। শিশুদের একটু ঠাণ্ডা লাগে।একটু জ্বর জ্বর থাকে। অস্বস্তি লাগে। এ ধরনের রোগগুলো এমনি এমনি ঠিক হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন একটু আলাদা থাকা, বিশ্রাম নেওয়া এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা। পানি পান করবে বেশি করে। নবজাতকরা বেশি করে বুকের দুধ খাবে।
অস্বস্তির জন্য আমরা কিছু ক্যালামাইন লোশন ব্যবহার করি, যাতে চুলকানি না হয়, সেই জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন দিতে বলি। এগুলো কিছু লক্ষণের ওপর নির্ভর করবে।
প্রশ্ন : যেই রোগগুলো ছড়ায় না, শিশুদের ক্ষেত্রে সেগুলো কী হতে পারে?
উত্তর : অসংক্রামক রোগের মধ্যে একটি হলো পোকামাকড়ের কামড়। আমরা কিন্তু শুনে এসেছি, গরমে কীটপতঙ্গের আনাগোনা বাড়ে। শীতকালে তারা বিশ্রাম নেয়, কোনো একটি গর্তে থাকে বা কোনো একটি ফাটলে থাকে। গরমকালে তারা বের হয়ে আসে। সেই ক্ষেত্রে মাছি, মশা নানা ধরনের ইঁদুর, তেলাপোকা সব কিছুর উপদ্রব বেড়ে যায়। এই ক্ষেত্রে পোকামাকড়ের কামড় থেকে নানা ধরনের সমস্যা বেড়ে যায়। পোকা মাকড় যেই জায়গায় কামড় দেয়, সেখান থেকে একটি সংক্রমণ হয়, প্রদাহ হয়। পরে অ্যালার্জি ও অ্যাক্সিমার দিকেও মোড় নেয়।
কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিশুদের পোশাক একটু সুতি হলে ভালো এবং সন্ধ্যার পরে তাকে যেন একটু ঢাকা পোশাক পরানো হয়। বিশেষ করে এ সময় যেহেতু মশার উপদ্রব বাড়ছে।
এরপর শিশুর পোশাকের সঙ্গে তার পরিচ্ছন্নতা, তার ঘরের পরিচ্ছন্নতা দরকার। বিছানার চাদর, পর্দাগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। তেলাপোকা, ইঁদুরের বসতি কিন্তু রান্না ঘরে। বা এগুলো বাথরুমে থাকে। এগুলো একটু পরিষ্কার করতে হবে। তেলাপোকা, ইঁদুর যে সবসময় কামড় দেবে তা কিন্তু নয়।
কিন্তু কিছু ডাটা অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে, ঘরের একটি কোণায় যদি ইঁদুর বা তেলাপোকা থাকে, সেই শিশুটির যদি অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়,এগুলো মারাত্মকভাবে দেখা দেয়।
প্রশ্ন : ওই অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনটা বোঝা যাবে কীভাবে?
উত্তর : শুরুটা এমনভাবে হয়, কোনো পোকা কামড় দিয়েছে বা দেয়নি। শিশু খুব অস্বস্তিবোধ করছে। শিশু আমরা কাদের বলব? নবজাতক থেকে ১০ বছরের বয়সকেই আমরা শৈশব বলি। যারা একেবারেই নবজাতক তারা তো প্রকাশ করতে পারে না, দেখা যাচ্ছে, অস্বস্তিবোধ করছে বা হাত – পা ছোড়াছুড়ি করছে, খাচ্ছে না, একটু র্যাশ হচ্ছে, গলায়, কপালে, ভাঁজে ভাঁজে। একটু যারা বড় তাদের ক্ষেত্রে হয়তো চিকিৎসকরাও অভিযোগ করে তারা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে না। শিক্ষকও অভিযোগ করে, তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে না। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, হাতে নানা রকম র্যাশ দেখা দিচ্ছে। এর সঙ্গে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এগুলো হলো অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন।
আমাদের যে অ্যালাজিগুলো হয়, ক্লোরিন আলার্জি হয়। সুইমিংপুলে অনেকে গোসল করতে পছন্দ করে, এখান থেকে ক্লোরিন অ্যালার্জি হয়।
আরেকটি কারণে শিশুর অ্যালার্জি হয়। সেটি হলো ঘাম। অতিরিক্ত ঘাম এবং সে ঘাম যদি না মোছা হয়, তাদের অ্যালার্জি হয়।
প্রশ্ন : শিশুদের ত্বক ভালো রাখতে গরমে কীভাবে গোসল করা উচিত?
উত্তর : কক্ষ তাপমাত্রায় থাকা পানি বা হালকা গরম পানি ব্যবহার করে করতে হবে। পানি বেশি ঠাণ্ডা হওয়া যাবে না। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরম কোনোটিই কিন্তু শিশুর নাজুক ত্বকের জন্য যথেষ্ট নয়।
আর সাবানের ক্ষেত্রে হালকা ধরনের সাবান ব্যবহার করতে হবে। ক্ষারযুক্ত সাবান অস্বস্তি তৈরি করে। অনেকে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য দেখা যায়, অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল কঠিন সাবান ব্যবহার করছে। সে ক্ষেত্রে তাদের উপরিভাগের লেয়ারটা নষ্ট হয়। শিশুদের কিন্তু প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার ফ্যাক্টর কম থাকে। শিশুর ত্বক যেমন কোমল, যেমন মসৃণ এটি কিন্তু সেরকম নাজুক।
প্রশ্ন : শিশুর ত্বক ভালো রাখতে পরামর্শ কী?
উত্তর : শিশুর নখ ছোট রাখতে হবে। চুল ছোট রাখতে হবে যেন ঘাম হলে এটি আমরা মুছতে পারি। গোসলের পর চুলকে সুস্থ রাখাটা যেন কঠিন কিছু না হয়। খেয়াল রাখতে হবে কোনো জায়গা ঘেমে গেছে কি না। আর শীতকালে ত্বকের ম্যাসাজের একটি প্রবণতা রয়েছে। শুষ্ক ত্বকে সারা বছর তেল, ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারবে। তবে ব্যবহারের পর সেটি মুছে দিতে হবে। ভাঁজে ভাঁজে তেলগুলো থেকে ঘাম ও তেল মিলিয়ে যেন কোনো ফাঙ্গাল ইনফেকশনের সৃষ্টি করতে না পারে।
প্রশ্ন : শিশুর ফাঙ্গাল ইনফেকশন বোঝার উপায় কী?
উত্তর : ফাঙ্গাল ইনফেকশনতো সংক্রামক রোগ, সেক্ষেত্রে নানাভাবে, নানা রূপে আসে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে হয়। মাথার চুলে হয়। শরীরে দেখা যায়, গোল গোলভাবে বা চাকার মতো ফাঙ্গাস। ফাঙ্গাল ইনফেকশনের প্রধান চিকিৎসা টপিক্যাল অ্যান্টি ফাঙ্গাল দিয়ে করি।আর শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ট্রপি দিয়ে থাকি।
প্রশ্ন : শিশুদের ত্বক ভালো রাখতে স্থূলতা নিশ্চয়ই একটি বড় সমস্যা। সেই ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : স্থূলতা থেকে এক্সিমা, অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস এই সমস্যাগুলো দেখা দেয়। স্থূলতার কারণ কিছুটা আমাদের খাবার। জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড। শিশুদের ক্ষেত্রে ওয়াকিং আউট না বলে এক্সারসাইজ প্লে বলতে পারি। সম্পূর্ণটাই একটি আনন্দ। খেলার মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে তারা যেন এই শরীর চর্চাকে উপভোগ করতে পারে।