জয়েন্ট মচকে গেলে কী করবেন?

জয়েন্ট মচকে যাওয়া, বিশেষ করে পায়ের জয়েন্ট মচকে যাওয়া একটি প্রচলিত সমস্যা। সাধারণত হাঁটাচলা করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত পায়ের জয়েন্ট মচকে যেতে পারে।
পায়ের জয়েন্ট মচকে গেলে করণীয় বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪২১তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক কাজী শহীদুল আলম। বর্তমানে তিনি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : মচকে যাওয়া বিষয়টি কী? মচকে গেলে জয়েন্টের কোন কোন বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
উত্তর : আসলে পা মচকে যাওয়া যখন বলা হয়, তখন আমরা অ্যাঙ্কেল স্রেপেইন বুঝি। স্রেপেইন হলো ভাঙেনি, কিন্তু ভাঙার মতো হয়েছে।
আসলে আমাদের জানতে হবে, পায়ের গোড়ালিটা কীভাবে থাকে। দুটো হাড় গিয়ে সেখানে মেশে। মাঝখানে একটি হাড় রয়েছে, এটি তার ভেতরে ঘোরে। যে দুটো হাড় রয়েছে একটির নাম টিভিয়া, আরেকটির নাম আলনা। এগুলো একটি খাঁচ তৈরি করে। আর এর ভেতরে টেলাস ঘোরে। এটি হলো আমাদের অ্যাঙ্কেল। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্ট। সম্পূর্ণ শরীরের ভার এটি বহন করে। বহন করে পায়ের মধ্যে নেয়। এর পর মাটিতে যায়। এ কারণে এটি অনেকগুলো টিস্যু দিয়ে লাগানো রয়েছে। টিস্যু মানে কাপড়ের মতো জিনিস লাগানো রয়েছে, খুবই শক্ত। এগুলোকে আমরা লিগামেন্ট বলি। শুধু তাই নয়, এর পাশ দিয়ে চলে গেছে টেনডন। আমরা একে রগ বলি। কোনো কোনো টেনডন বাইরে দিয়ে গেছে, কোনো কোনোটি ভেতর দিয়ে গেছে। লিগামেন্ট, টেনডন ও তাদের ক্যাপসুল—এরা জয়েন্ট তৈরি করে। এই জয়েন্টটা দুই রকম কাজ করে। একটি হলো ফ্লেক্সন, আরেকটি এক্সটিনশন। ভাঁজ করে এবং সোজা করে। এর জন্য আমরা হাঁটাচলা করি।
এখন অসুবিধা হলো, এটি আবার একটু দোলও খায়। এপাশে-ওপাশে নাড়া খায়। এতে আমাদের পায়ের কিছু হয় না। কিন্তু তখনই অসুবিধা হয় যখন দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন, হয়তো অসাবধান হয়ে ইটের ওপর পড়ে গেলেন, আপনার জুতাটা ভালো নয়, জায়গাটা ভালো নয়—এসব ক্ষেত্রে আপনার পা কিন্তু মচকে যেতে পারে।
প্রশ্ন : আমাদের পা তো নড়াচড়া করবে। তাহলে কোন পর্যায়ে গেলে একে মচকে যাওয়া বলি?
উত্তর : একটি দিক রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দিক বা ডিগ্রি পর্যন্ত এটি ঘুরবে। এর বেশি চলে গেলে মচকে যায়। একটি হলো বাইরের দিকে যেতে পারে, আরেকটি হলো ভেতরের দিকে যেতে পারে। সাধারণত পা যখন ভেতরের দিকে বেঁকে যায়, তখন বেশি ব্যথা পাই। বাইরের দিকে গেলে তখনও ব্যথা পাই। এ ছাড়া আরেকটি জিনিস হতে পারে, রোটেশন হতে পারে। এটি প্যাঁচ খেয়ে যেতে পারে। কাপড় মোচড়াতে গেলে যেমন প্যাঁচ খায়, তেমন হতে পারে। তখন হাড় ভেঙে যেতে পারে। মচকে গেলে পা ফুলে যায়। তখন ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। জয়েন্টের মধ্যে রক্ত যায়। জয়েন্টের মধ্যে আমরা রক্ত কখনোই চাই না। জয়েন্টের মধ্যে এক ধরনের তেলের মতো জিনিস থাকে, একে আমরা বলি সাইনোভিয়াল ফ্লুইড। এই সাইনোভিয়াল ফ্লুইডের জায়গায় যদি রক্ত যায়, ওইখানে আমাদের যে হাড় রয়েছে, যাকে কড়মড়ি হাড় বলি, কার্টিলেজ এগুলো নষ্ট হতে থাকে। এটি যদি বহুদিন থাকে, শেষ পর্যন্ত আমাদের হাঁটতে গেলে খুবই অসুবিধা হয়।
ছোটখাটো মচকে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়িতেই চিকিৎসা করা যেতে পারে। প্রথমে মচকে গেলে গরম পানি নয়, ঠান্ডা পানি দেবে। বরফ দেবে, যেন সেখানে রক্তপাত না হয়। এতে ব্যথাটা কমে যায়। হয়তো মচকে যাওয়ার বিষয়টি রাস্তায় হয়েছে, পথেঘাটে হয়েছে এ রকম অবস্থায় যদি দিতে না পারেন, তাহলে পা ফুলে যাবে এবং ভীষণ ব্যথা হবে। যত ফুলবে, তত ব্যথা হবে। কারণ, ওই যে ক্যাপসুল রয়েছে, সেগুলোর মধ্যেই রয়েছে স্নায়ুগুলো। এগুলো স্ট্রেচ করে, স্নায়ুগুলো ফুলে যায়। এগুলোতে চাপ লাগে। তখন ব্যথা হয়। এ রকম ব্যথা হলে খুবই অসুবিধা হয়। এই জন্য নিজে যদি করেন, তাহলে ঠান্ডা পানি দেবেন। ব্যথার জন্য কিছু ওষুধ খেতে পারেন, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ। এবং পা উঁচু রাখতে হবে। হার্টের থেকে উঁচু রাখলেই ভালো।
রাস্তাঘাট খারাপ থাকলে পা মচকে যেতে পারে, খেলতে গেলে হতে পারে, প্রবীণদের হতে পারে। প্রবীণদের হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তারা সাধারণত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। প্রবীণ বয়সে পা হয়তো আগের মতো চলে না।
এ ছাড়া আরেকটি বিষয় রয়েছে। অনেকে হাই হিলের জুতা পরেন। অনেকে খারাপ জুতা পরেন। এসব কারণেও হঠাৎ করে পা পিছলে যেতে পারে।
প্রশ্ন : কী কারণে পা মচকে গেছে, এটি বোঝার উপায় কী? কখন ব্যথাকে গুরুত্ব দিয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : একটি বিষয় হলো হাইহিল জুতা সাধারণত মানুষ অল্প কিছুক্ষণের জন্য পরে, কোনো ফাংশনের জন্য পরে। কিন্তু তার সতর্ক থাকতে হবে। এর মধ্যে যেন শাড়ি বেঁধে না যায়, কাপড় বেঁধে না যায়, তাহলে মচকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এ ছাড়া যেসব জুতা পায়ের সঙ্গে লেগে থাকে এবং হাঁটুকে সুরক্ষা দেয়, এ রকম জুতা অনেক ভালো। এগুলো উপকারী। কিন্তু অনেক সময় সৌন্দর্যের জন্য এটি অনেকে পছন্দ করে না। কিন্তু না করলেও তাদের সতর্ক থাকতে হবে। হাই হিল পরলে কোমরে ব্যথা হয়। অনেক সময় হাঁটুতেও ব্যথা হতে পারে।
প্রতিটি অঙ্গবিন্যাস, যা প্রকৃতিগত এর বিকল্প করতে গেলেই কিন্তু অসুবিধা হবে। আর এই জন্য যদি রোটেশন হয়, তাহলে কিন্তু সেখানে দুটো হাড় ফেটে যেতে পারে। ভেতরের দিকে যে উঁচু হাড় রয়েছে, একে আমরা বলি মিডিয়াল ম্যালিউলাস। বাইরের দিকে যেটি রয়েছে, একে বলে লেটারাল ম্যালিউলাস। এ দুটো হাড়ের মধ্যে কাপড় দিয়ে থাকে যেন বাইরে না যায়, ওই খাঁচটা যেন ব্যবস্থাপনা করা হয়। তবে অনেক সময় ভেতরের দিকে রয়েছে ইন্টারওশিয়াল লিগামেন্ট। এটি ছিঁড়ে যেতে পারে, হাড় ভেঙে যেতে পারে।
প্রশ্ন : পা মচকে যাওয়ার পর সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে কি গুরুতর সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : যদি দেখেন পা মচকে গেছে, কিন্তু দু-তিন দিন পরেও ব্যথা যাচ্ছে না, অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাবেন। কারণ, লিগামেন্টগুলো ছিঁড়েছে, আপনার পক্ষে কেবল কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিয়ে, পা উঁচু রেখে, ওষুধ খেয়ে ব্যথা যাবে না।
এসব ক্ষেত্রে পা প্লাস্টার করে দিই। পা উঁচু রাখতে বলি। অনেক সময় প্রথম এক্স-রেতে নাও ধরা পড়তে পারে। ১০ দিন পরে এক্স-রে করলে দেখা যায় সেটি প্রকোট হয়। যেই ফাটা ছিল, সেটি এখন বড় হয়ে দেখা যায়। সাধারণত সমস্যা এক্স-রেতেই ধরা পড়ে।
এক্স-রে করে যদি আমরা দেখতে পারি, তাহলে সিটি স্ক্যানের খরচটা না করাই ভালো। তবে মাঝেমধ্যে করতেও হতে পারে। পেছনের অনেক জায়গা অনেক সময় এক্স-রেতে বোঝা যায় না। এক্স-রে করলেও সেটি দেখা যায় না। এসব জায়গায় সিটিস্ক্যানের দরকার রয়েছে। এসব জায়গায় হয়তো আমাদের অস্ত্রোপচারেরও প্রয়োজন পড়তে পারে। অস্ত্রোপচার করলে কী ধরনের অস্ত্রোপচার দরকার, সেটিও একটি বিষয়। এই ভাঙাকে বলে প্রস ফ্র্যাকচার। এটি একটি খারাপ ধরনের ফ্র্যাকচার। এটি ভালো হতে সময় লাগে। এর ওপর আমাদের সম্পূর্ণ শরীরের ওজন নির্ভর করে। পরে যখন খারাপ ভাঙা হয়, এখানে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়। একে বলে ট্রমেটিক অস্টিওআর্থ্রাইটিস; আঘাতজনিত সমস্যা হয়। পরে হাঁটতে গেলে অসুবিধা হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে টেলাসও বেড়ে যেতে পারে। যেমন, কেউ যদি ওপর থেকে পড়ে যায়, তাহলে সমস্যা হতে পারে। এগুলো কিন্তু মচকে যাওয়া নয়, মচকে যাওয়া অনেক সামনের কথা।