রোগীদের রোজার প্রস্তুতি কেমন হবে?

Looks like you've blocked notifications!
রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখা ভালো। ছবি : সংগৃহীত

রোজা প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর জন্য ফরজ ইবাদত। রোজা রাখা নিয়ে অনেক রোগীরাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। তবে রোজার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিলে এবং সে অনুযায়ী চললে সুস্থভাবে  রোজা রাখা যায়।

দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত রোগীদের রোজার প্রস্তুতির বিষয়ে  কথা হয় গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাকিল মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগের মধ্যে রোজার রাখার বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ও ক্রনিক লিভার ডিজিজের রোগীরা। তবে একটু নিয়ম-কানুন মেনে চললে তারাও কিন্তু  ভালোভাবে রোজা রাখতে পারবেন।’

ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার প্রস্তুতির বিষয়ে ডা. শাকিল মাহমুদ বলেন, ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা,  নিয়মানুবর্তী জীবনযাপনের মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। সাধারণত কিছু নিয়ম- কানুন মেনে রোজা রাখলে ডায়াবেটিস রোগীদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রাখার কিছুদিন আগে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা (খালি পেট/ভরা পেট), লিপিড প্রোফাইল, রক্তের সিরাম ক্রিয়েটিনিন, লিভার ফাংশন ইত্যাদি পরীক্ষা করে নেবেন। এসব পরীক্ষাগুলোর ফলাফল স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলে ডায়াবেটিস রোগীরা নির্দ্বিধায় রোজা রাখতে পারবেন।’

তবে ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে ওষুধের মাত্রাগুলো আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যারা ইনসনুলিন নেয়, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ মতো মাত্রাটা জেনে নেবেন।’

যেসব ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন নিয়ে থাকেন রমজানের সময় তাঁরা লং একটিভ ইনসুলিন নিতে পারেন জানিয়ে  তিনি বলেন, ‘এই ধরনের ইনসুলিন দিনে একবার নিতে হয় এবং এ ধরনের ইনসুলিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম। তাই এটি রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য উপযোগী।’

ডা. শাকিল মাহমুদ বলেন, যাঁরা ইনসুলিন নেন না, কেবল ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাঁরা রমজান মাসে চিকিৎসককে দেখিয়ে ওষুধের ডোজ কমিয়ে নেবেন। কারণ, রমজান মাসে খাবারের মধ্যে লম্বা বিরতি থাকে। সেজন্য শরীরে ওষুধের পরিমাণ কম লাগে।’

ডা. শাকিল মাহমুদ আরো বলেন, ডায়াবেটিসের রোগীরা যেহেতু  দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকে, এ জন্য তাঁদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় বা রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এটি হলে হাত পা কাঁপতে থাকবে , শরীর ঘামতে থাকবে, মাথাব্যথা করতে থাকবে, মনোযোগের ঘাটতি হবে। এ ছাড়া প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে, পানি শূন্যতাও দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা দেখা দিলে গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা মেপে নিতে হবে।’

এই ধরনের সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং  আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে বলে পরামর্শ তাঁর। 

হার্টের রোগী 

ডা. শাকিল মাহমুদ বলেন, হার্টের রোগীদের রোজা রাখার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত রোজা পালনের মাধ্যমে হার্টের রোগীরা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল, অতিরিক্ত ওজন, অতিরিক্ত খাওয়া, ধূমপান ইত্যাদি  নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’

ডা. শাকিল মাহমুদ আরো বলেন, ‘বেশিরভাগ হার্টের রোগীরা দুবেলা প্রেশারের ওষুধ খায়। এ ছাড়া লিপিড লোয়ারিংয়ের ওষুধ, এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খেয়ে থাকে। এ ধরনের ওষুধের ডোজ অবশ্যই পরিবর্তন করে অথবা পুনর্নিধারণ করে রোজা রাখতে হবে। তবে অবশ্যই ওষুধের ডোজের পরিবর্তনের পাশাপাশি ইফতার ও সেহরিতে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।  বিশেষ করে ইফতারের সময় তৈলাক্ত ভাজা-পোড়া মুখরোচক খাবার বাদ দিতে হবে। খাদ্যতালিকায় সহজপাচ্য, কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার, বেশি আঁশযুক্ত খাবার রাখবেন। বাজারে প্রচলিত ছোলা, বেগুনি, আলুর চপ ইত্যাদি না খেয়ে ঘরে তৈরি কম তেলের স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।’

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেলের এই চিকিৎসক আরো বলেন, রোজা রাখা অবস্থায় হার্টের রোগীদের সিস্টোলিক প্রেশার ২০০ মিলিমিটার অব মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ১১০-এর ওপর থাকলে এবং বুক ব্যথা থাকলে রোজা ভেঙে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। এ ছাড়া রোজার আগে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা (খালি পেট/ভরা পেট), লিপিড প্রোফাইল, রক্তের সিরাম ক্রিয়েটিনিন, লিভার ফাংশন স্বাভাবিক রয়েছে কি না দেখে নেবেন।’

রোজার দিনগুলোতে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি  ইফতার ও সেহরির মাঝখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল খাবার খাবেন যেন পানি শূন্যতা প্রতিরোধ হয়।’

কিডনি রোগীদের রোজা

কিডনি বিপাকীয় বর্জ উপাদান শরীর থেকে বের করে। শরীরের অম্ল-খারের ভারসাম্য রক্ষা করে। ইউরিন উৎপাদন করে। প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীরের অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিপাকীয় পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয়। কিডনি রোগীদের কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। প্রস্রাব উৎপাদন কমে যায়।

কিডনি রোগীদের রোজা রাখার বিষয়ে ডা. শাকিল মাহমুদ বলেন, ‘কিডনি রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ মতো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হয়। এই ক্ষেত্রে রোজার রাখার কারণে, দীর্ঘ সময় পানি পান করা থেকে বিরত থাকার কারণে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এটি তাদের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এই জন্য কিডনি রোগীদের রোজা শুরু হওয়ার আগে কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো দৈনিক পানির তালিকা নির্ধারণ করতে হবে।’

তবে যাদের ডায়ালাইসিস পর্যায়ে চলে গেছে তাঁরা রোজা রাখবেন কি না, এটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে জেনে নেওয়াই ভালো বলে পরামর্শ তাঁর। 

লিভার ডিজিজ

লিভার দেহের বিপাকীয় অঙ্গ। খাদ্য যেমন খাদ্যনালিতে পরিপাক ও হজম হয়, তেমনি খাদ্যকণিকা পরিপাক ও হজম প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর লিভারে এসে জমা হয়। এই লিভার শরীরে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন কোষে শক্তি সরবরাহ করে। শরীরের কার্যক্রম ভালো রাখার জন্য লিভারের সুস্থ থাকা খুবই জরুরি। লিভারকে সুস্থ রাখার জন্য বিশুদ্ধ পানি, নিরাপদ খাবারের কোনো বিকল্প নেই।

লিভারের রোগীদের রোজা রাখার বিষয়ে ডা. শাকিল বলেন, ‘লিভারের রোগীরা লিভারকে সুস্থ রাখার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাবেন এবং  নিরাপদ পানি, বিশুদ্ধ খাবার দিয়ে ইফতার তৈরি করবেন;  খাদ্যতালিকা থেকে  তৈলাক্ত খাবার অবশ্যই বাদ দেবেন।’

জটিল লিভারের রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে রোজার আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া ভালো বলে পরামর্শ তাঁর।