রোজা রাখতে ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয় কী?
ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারির নাম। দুই ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে। টাইপ ওয়ান ও টাইপ টু।
ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার বিষয়টি নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীরা কীভাবে রোজা রাখবেন? বা রোজা রাখতে ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয় কী, এসব বিষয় নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪৩৩তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. শাহজাদা সেলিম। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : অনেক ডায়াবেটিস রোগীই রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগীরা কি রোজা রাখতে পারবেন? ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : আসলে ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যেটি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে নির্দিষ্ট সময় পর পর খাবার খেতে হবে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর পর খাবারটা খাওয়া উচিত। রোজা হলো এমন ধর্মীয় অনুশাসন, যেখানে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হবে। এবারের রমজানে প্রায় সাড়ে ১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার সময় আসবে। তাহলে দুটো কিন্তু সাংঘর্ষিক একটি অবস্থানে রয়েছে। এবারও প্রায় ৯০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা রাখছেন। সে ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা যাঁরা রাখছেন, তাঁদের তুলনায় চিকিৎসকদের কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে। তাই আমি মনে করি, এই অনুষ্ঠানগুলো সহায়তা করবে। কারণ, সবাইকে তো ব্যক্তিগতভাবে বলা যাচ্ছে না।
আসলে যদি বলি ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখা নিষেধ, এটি কিন্তু কোনো চিকিৎসকের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ, ধর্মীয় এই বিষয়টিতে রোগী নিজের তাগিদ থেকে কাজটি করছেন। আমার অবস্থান হবে একজন ডায়াবেটিসের চিকিৎসক অনুযায়ী, রোগীকে কতটা নিরাপদে রমজান মাসটুকু পার করে দেওয়া যায়, সেই বিষয়টি ভাবা।
যাদের কিডনির সমস্যা রয়েছে এবং পর্যায় তিন পার হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা চরম ঝুঁকির। আবার সারাপৃথিবীতে ডায়াবেটিসে টাইপ ওয়ানের কিছু রোগী রয়েছে, টাইপ টু-এর রোগী রয়েছে। টাইপ টুয়ের রোগীর সংখ্যা অনেক। টাইপ ওয়ানের রোগীরা চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন। টাইপ টুয়ের রোগীর রোজার আগে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ কেমন ছিল, এটি নিরূপণ করা তাকে সাহায্য করবে যে তিনি ডায়াবেটিস নিয়ে কতটা নিরাপদে রোজা রাখতে পারবেন। যাদের ঘন ঘন হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে যায়, তারা যদি ১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকেন, তাহলে এই ঝুঁকি বেশি। আবার হয়তো গত তিন মাসে রক্তের গ্লুকোজ অনেক বেড়ে গিয়েছে এবং এর জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে তারাও কিন্তু ঝুঁকিতে রয়েছে। হৃদরোগ যাদের হয়েছে, বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক তারা কিন্তু ঝুঁকিতে রয়েছে। অথবা গত তিন মাসের মধ্যে স্ট্রোক করেছেন, তাঁরাও ঝুঁকিপূর্ণ। রোজা রাখার ক্ষেত্রে চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন যাঁরা গর্ভকালীন রোজা রাখছেন তাঁরা।
আবার ধরুন, ডায়াবেটিস রয়েছে, ডায়রিয়া হয়েছে এই সময় কিন্তু রোজা রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ। অথবা তীব্র জ্বরের রোগী। এটা তো আমরা সাধারণভাবেই বুঝতে পারি তাঁর পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : তাহলে কোন ধরনের ডায়াবেটিসের রোগীরা রোজা রাখতে পারছেন?
উত্তর : আসলে রোজা কিন্তু প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়েই আসে। তাই রোগী যেই চিকিৎসকের আওতায় রয়েছেন, তাঁকে কিন্তু প্রশ্ন করলে তিনি বলে দেবেন সুন্দর করে ঝুঁকি কোনটিতে কম, কোনটিতে বেশি। একটি জিনিস আমাদের বুঝে নিতে হবে যে ডায়াবেটিসের রোগী রোজা রাখলে ঝুঁকি থাকবেই। তবে ওই যে বললাম, চিকিৎসকের অবস্থান হলো, ওই ঝুঁকিটা কমিয়ে রোজাটাকে পার করতে রোগীকে সহায়তা করা যায়।
এ ক্ষেত্রে ওষুধগুলো সমন্বয় করতে হবে। রোজার সময় যেই পরিবর্তনটি হবে সেটি হলো, তিনি সারা দিন কাজ করবেন। কারণ, তাঁর অফিস টাইম তো রাতের বেলা চলে যাচ্ছে না। কিন্তু খাওয়ার সময় তো রাতের বেলা চলে যাচ্ছে। কাজ করছেন সারা দিন কিন্তু খেতে পারছেন না। আবার খাচ্ছেন সারা রাত, কিন্তু কাজ করবেন না, তাহলে সম্পূর্ণ বিষয়টি কিন্তু পাল্টে গেল। এই পাল্টানোকে মাথায় রেখে কিন্তু তাঁর সারা দিনের খাবার এবং ওষুধের ডোজ ঠিক হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে যেই ওষুধগুলো আগে চলছিল, কোনটা কোনটা এর মধ্যে চলবে, কোনটা কোন সময়ে পরিবর্তন হবে, এটি ঠিক করে নিতে হয়।
যেমন ইংরেজিতে ব্রেক ফাস্ট, বাংলায় সকালের নাশতা। রমজান মাসে কিন্তু ইফতার হলো সকালের নাশতার মতো। এটি বলছি এই কারণে যে এটি করলে ওষুধগুলো বোঝা একটু সহজ হবে। সকালের ওষুধগুলো কিন্তু ইফতারের ঠিক আগে বা পরে চলে আসবে। অনেকগুলো ইনসুলিন রয়েছে, যেগুলো দিনে একবারই নেওয়া হয়। সেগুলো একবারে নিতে হবে। এতে কিন্তু কোনো সমস্যা নেই। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো রোজার সময় দিনের বেলা ইনসুলিন নিলে কোনো সমস্যা হবে না। রোজা রেখে যদি কেউ রক্তের গ্লুকোজ মাপে, তাহলেও রোজা ভাঙবে না। এটি নিয়েও কিন্তু অনেকের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে। তাহলে যে ইনসুলিনটা তিনি একবার নিতেন, সেটি দিনেও নিতে পারবেন, রাতেও নিতে পারবেন। কিন্তু যে ইনসুলিনগুলো নাশতার আগে এবং রাতে খাবার খাওয়ার আগে নিতে হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। সকালের যে পরিমাণ ইনসুলিন ছিল প্রায় সমান পরিমাণ ইফতারের আগে নিতে হবে। কিন্তু রাতে যে পরিমাণ নিতেন, সেটিকে কমিয়ে নিতে হবে। এটি নির্ভর করবে তার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের ওপর। যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে একটু কমিয়ে নেওয়াটা নিরাপদ। যদি এমন হয় উনি রাতে ২০ নিতেন, একে কমিয়ে ১২ বা ১৪ করা যাবে।
তবে যাদের রক্তের নিয়ন্ত্রণ ভালো ছিল না, তাদের ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ খুব বেশি কমাবার প্রয়োজন পড়বে না। তবুও আমরা কমিয়ে ফেলি এই কারণে যে সারাদিন তো তিনি না খেয়ে থাকছেন। রোজার সময় আমরা কিন্তু ডোজ কমিয়েই ফেলি আসলে। আমরা মনে করি, দুই/চার দিন কমই থাকুক। কারণ, রোজার সময় কিন্তু আমরা খুব ভালোভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না, পারিও না আসলে। তাহলে হাইপো হয়ে যাবে।
আমরা চাই, একটু অনিয়ন্ত্রিত থাকুক, তবে হাইপোগ্লাইসেমিয়া না হোক। হাইপোগ্লাইসেমিয়াটা তখন তাঁর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, হাইপোগ্লাইসেমিয়া থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে।
এবারের কথা যদি ধরি, এবার যে রোজা এসছে, তীব্র গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া। তাহলে দিন যত গড়াতে থাকবে, দুপুর ও তার পরের সময়টাতে যেকোনো মানুষেরই ঘাম হবে এবং পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। রোজা না থাকলেও হতে পারে। কিন্তু যে রোজা রেখেছেন তিনি তো সেহরির সময় খাবার খেয়েছেন। সারাদিন তো পানি পান করার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু অন্য সময় তো পানি পান করতে পারতেন। তাহলে কিন্তু অন্য সময় একে আমরা ব্যবস্থাপনা করতে পারতাম।