নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জনে করণীয় কী?

আজ বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জনে করণীয় বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪৫১তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন বিভাগে চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : নিরাপদ মাতৃত্ব একটি মেয়ের জীবনের অধিকার। নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে আমরা বুঝি সে সন্তান নেবে কি নেবে না। সন্তানের মা হবে কি হবে না। নিরাপদ মাতৃত্বের মধ্যে রয়েছে, গর্ভাবস্থা হলে তার যে অ্যান্টিনেটাল চেকআপ, তার ইন্টারপার্টাম কেয়ার, পোস্ট ডেলিভারি কেয়ার, তার যদি অ্যাবরশন হয়ে যায় পোস্ট অ্যাবরশন কেয়ার, ইনফেকশনের ঝুঁকি থেকে মুক্তি ও চিকিৎসা। এই ছয়টা হলো নিরাপদ মাতৃত্বের মূল স্তম্ভ। এই সবগুলোকে নিশ্চিত করাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে প্রতি বছর ২৮ মে এই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃত্বের অবস্থানটি কেমন?
উত্তর : এখন আমরা তো চেষ্টা করছি, সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু যেটি হচ্ছে, সেটি হলো, আমাদের দেশের মেয়েরা এখনো কিন্তু শিক্ষিত নয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা। ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন রয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ৬৫ ভাগ মেয়েদের ১৮ বছর আগে বিয়ে হচ্ছে। একে আমরা বাল্যবিবাহ বলছি। লেখে তারা অফিশিয়ালি ১৮ বছর, তবে সেই মেয়েটির বয়স ১২ বা ১৩ বছর। মা-বাবা যদি সুরক্ষা দিতে না পারে একটি মেয়েকে তখন আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়। এটি আমাদের জন্য আরেকটি সামাজিক সমস্যা।
আপনি হয়তো বিয়ে দিলেন একজন মেয়েকে। সে যদি পরিবার পরিকল্পনা করে যে আগামী পাঁচ বছর বাচ্চা নেবে না, তাহলেও কিন্তু মাতৃত্বটা নিরাপদ থাকে। বয়ঃসন্ধিকালের গর্ভাবস্থা খুব ভালো নয়। এখানে গর্ভাবস্থার জটিলতা বেশি হয়। অ্যাবরশন ঝুঁকি বেশি হয়। সে প্রি-একলামসিয়া, একলামসিয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। সে হেমোরেজের ঝুঁকিতে পড়ে। এটি তার মৃত্যুর কারণ।
প্রশ্ন : বাকি বিষয়গুলো কী?
উত্তর : আমরা বলছি, আমাদের অ্যান্টিনেটাল কেয়ার বাড়ছে। ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এটি ৭১ ভাগ। সেটা কিন্তু একটি ভিজিট। ডাব্লিউএইচওর হিসেবে আমাদের অন্তত চারটি ভিজিট হওয়ার কথা। তার গর্ভধারণকালীন চারবার সে হেলথ সেন্টারে যাবে। এটিও নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে একবার, ২৪ থেকে ২৬ সপ্তাহের মধ্যে একবার। ৩২ সপ্তাহে একবার, ৩৬ সপ্তাহে একবার। একজন ভালো চিকিৎসক যদি রোগীকে দেখে, বা ভালো স্বাস্থ্যকর্মী রোগীকে যদি দেখে, তাহলে কিন্তু সে ঝুঁকিগুলো এ সময় বের করা সম্ভব। আগেভাগেই চিহ্নিত করা যায় এবং এর সমাধানটা সহজ হয়। সমস্যা হলে তাকে রেফার করা যায়।
তবে ডাব্লিউএইচও এখন কিন্তু চার ভিজিট বাদ দিয়ে আট ভিজিট করছে। এখন আমরা সেখানে করছি এক ভিজিট। তাহলে এক ভিজিট দিয়ে আপনি কীভাবে নিশ্চিত করবেন, এই মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি কতখানি? কারণ, মৃত্যুর ঝুঁকি কিছুটা সরসরি কারণে হয়। আমরা বলছি, হেমোরেজ, একলামসিয়া, অ্যাবরশন। আবার কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো সরাসরি নয়। যেমন : তার কিডনিতে সমস্যা, তার লিভারে সমস্যা, তার রক্তের সমস্যা, রক্তনালীর সমস্যা। এগুলো হলো সরসরি নয় এমন কারণ। এই কারণগুলো কিন্তু চিহ্নিত হচ্ছে না। কারণ, আপনি যদি ভালো করে একজন রোগীর সমস্ত পরীক্ষা না করেন, তাহলে কীভাবে কারণগুলো বের করবেন।
একবার যদি চিকিৎসকের কাছে যায়, সেটা দিয়ে কিন্তু কোনো সরাসরি কারণও আপনি ফেরাতে পারবেন না। আর সরাসরি নয়, এমন কারণের জন্য সমস্যা হলেও সেটি ফেরাতে পারবেন না। এ কারণে আমাদের মায়েদের মৃত্যু কিন্তু কমছে না।
প্রশ্ন : অ্যান্টিনেটাল চেকআপে আপনারা কোন কোন বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখেন?
উত্তর : আমার কাছে যদি যায়, আমি যেমন উচ্চ ঝুঁকির গর্ভাবস্থাগুলো দেখি, আমরা জানি ১৪ সপ্তাহের মধ্যে আপনার বাচ্চার কোনো সমস্যা রয়েছে কি না। আপনার বাচ্চার কার্ডিয়াক সমস্যা বলেন বা ডাউন সিনড্রম বলেন বা অন্যান্য ক্রমোজোমাল অস্বাভাবিকতা বলেন, ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে একটি আল্ট্রাসোগ্রাম করলে এটি ধরতে পারি। এরপর ২২ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে আমরা আরেকটি আল্ট্রাসোগ্রাম করব। করে সেখানে আমরা দেখি বাচ্চার কোনো গঠনগত ঝুঁকি রয়েছে কি না।
২৪ সপ্তাহের সময় যে পরিবারে হার্টের সমস্যা রয়েছে বা আমার যদি মনে হয়, শিশুটির হার্টের সমস্যা হতে পারে, তখন আমরা ইকো করে দেখি। কার্ডিয়াক সমস্যা হলো এক নম্বর জন্মগত ত্রুটি। অনেক রয়েছে জন্মগত ত্রুটি। তবে সারা পৃথিবীতে হার্টের জন্মগত ত্রুটি যেমন বেশি, আমাদের দেশেও বেশি। এরপর শেষের দিকে আমরা দেখি রোগীর রক্তচাপ কেমন। প্রথম দিকে আমরা সম্পূর্ণ একটি ব্লাড কাউন্ট করি, তার প্লাটিলেট কম রয়েছে, না কি হিমোগ্লোবিন কম রয়েছে, তার কোষের কোনো ত্রুটি রয়েছে কি না এবং প্রস্রাব কেমন হচ্ছে, এগুলো পরীক্ষা করি। ইউরিনে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না, তার কিডনির কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, দেখি। আমরা কিডনিটা দেখে ফেলি। লিভারের কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, সেটি আমরা দেখি। প্রতিটি টেস্টে হিমোগ্লোবিন ও প্রস্রাব টেস্ট করা দরকার।
তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলো, আমি হয়তো সমস্ত গর্ভাবস্থা দেখলাম ভালো, তবে শেষের দিকে এসে খেয়াল করলাম বাচ্চার বৃদ্ধি ঠিকমত হয়নি। তাই শেষের দিকে দেখতে হবে বাচ্চার বৃদ্ধি ঠিকমত হচ্ছে কি না। এটি বেশি করে করা হয় ২৮ সপ্তাহ পড়ে। বাচ্চা ফ্লুইডের মধ্যে থাকবে, যে পানিটা সেটি ঠিকমত হচ্ছে কি না, সেটি দেখতে হবে। এটি যদি না থাকে, তখন আমাদের আবার অন্য পরীক্ষা রয়েছে। আমরা আল্ট্রাসাউন্ড করে বায়োফিজিক্যাল প্রোফাইল করি। ফ্লো দেখি। তখন আমরা ঠিক করি, তার কখন প্রসব হওয়া উচিত।
আমাদের দেশে এখন একটি ধরন হয়ে গেছে, সবাই সময়ের আগে প্রসব করিয়ে ফেলে। সিজার করিয়ে ফেলা হয়। প্রি-টার্ম প্রসব যে হয়, এর সঙ্গে অটিজম অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। কাজে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে।
প্রশ্ন : সঠিক সময়ের আগে কষ্ট কমানোর জন্য আগে যে প্রসব করাতে চান, এতে কি ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : অবশ্যই ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্ন : নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য নিরাপদ প্রসব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনেক সময় সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে অনেক মায়ের মৃত্যু হয়, বিশেষ করে তারা যখন হাসপাতালে বা প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থাকেন না তখন এমন হয়। এই ক্ষেত্রে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ?
উত্তর : প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে আমরা যদি ২০১০ থেকে গণনা করি, ১০ এ ছিল ২৩ ভাগ এবং এখন আমরা বলি ৪৭ ভাগ, মানে প্রায় ৫০ ভাগ। সরকারি পর্যায়ে মাত্র বেড়েছে ১০ থেকে ১৪ ভাগ।২০১০ সালে ছিল, ১০ ভাগ। এখন ১৪ ভাগ। এটা বেড়েছে বেসরকারি সেক্টরের জন্য। বেসরকারি সেক্টরে এটি ১১ ভাগ ছিল, ১৬ তে এসে এটি হয়ে গেলে ২৯ ভাগ। এনজিওরা প্রসব করাচ্ছে। কিন্তু বিশেষ করে যাদের আমরা বলি যে হাসপাতালে প্রসব করাব, তাদের অনিহা থাকে। এই অনিহা হয় প্রধাণত অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য। আমরা যতই বলি যে আমরা সব সরবরাহ করছি, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দুই তৃতীয়াংশ টাকা মানুষের পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এতে যেটা হচ্ছে গরির আরো গরিব হচ্ছে। গরির কিন্তু গরিবতর হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে আসলে আমরা কিন্তু খুব ভালো ব্যবহার করি না। তাদের স্বাগত জানাই না। এই স্বাগত জানানোটাও কিন্তু জরুরি।
প্রশ্ন : নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিন্তে সন্তান ধারণ থেকে জন্মদান পর্যন্ত কোন কোন বিষয় নিশ্চিত করতে হবে?
উত্তর : আমি প্রথমে বলব, একজন মেয়েকে শিক্ষিত হতে হবে। ক্লাস ফোর/ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে, এটি কিন্তু শিক্ষিত হওয়া নয়। কারণ, সেখানে সে সীদ্ধান্ত নিতে পারে না। যদি আসলেই একজন নারী শিক্ষিত হয়, সে সীদ্ধান্ত নিতে পারে, কখন সে বাচ্চা নেবে। অর্থনৈতিকভাবেও তাকে একটু দাঁড়াতে হবে। এতে তার সীদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়বে। নিরাপদ মাতৃত্ব কিন্তু কেবল মায়ের জন্য নয়। যদি মা মারা যায় অনেক সময় দেখা যায়, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে হয়তো শিশুটি মারা যায়। কাজেই এর সঙ্গে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। মা যদি সুস্থ থাকে পরিবারের অর্থনৈতিক যে উন্নতি সেটি ভালো হয়। কাজেই আমার মেয়েটাকে শিক্ষিত করতে হবে। অ্যান্টিনেটাল কেয়ার যেন সে পায়, এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। প্রত্যেকটি গর্ভাবস্থা যদি আমরা রেজিসট্রেশন করি, স্বাস্থ্যকর্মীরা রয়েছে, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা যদি রেজিসট্রেশন করে, বেশিরভাগ মৃত্যুকে প্রতিরোধ করা যায়।
কোনো হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীদের অধীনে থেকে যদি প্রসব করাই তাহলে ভালো। প্রসবের পরেও তাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি পদ্ধতি নিতে হবে। অনেকদিন পর বিরতি দিয়ে তাকে বাচ্চা নিতে হবে। অন্তত দুই বছর। তাহলে তার পুষ্টিটাও ভালো থাকে। গর্ভাবস্থার সময় যে তার আয়রনের ঘাটতি হয়, রক্তস্বল্পতা হয়, এটি সে পূরণ করতে পারে।
প্রশ্ন : গর্ভাবস্থায় পুষ্টির বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?
উত্তর : আমাদের দেশে আসলে আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতা খুব বেশি। সরকারিভাবে প্রথম থেকেই কিন্তু আয়রন ও ফলিক এসিড দেওয়া হয়। কাজেই এটি সে খাবে। একলামসিয়া যেহেতু আমাদের দেশে বেশি, তাই এটি প্রতিরোধে আমরা ক্যালসিয়ামের কথা বলছি। তিন মাস পর থেকে সে ক্যালসিয়াম শুরু করবে।
প্রশ্ন : মায়ের খাবার- দাবারের মধ্যে তো বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে আপনারা কী খেতে বলেন?
উত্তর : লাল শাক, পুঁই শাক এগুলো খেতে বলি শাকের মধ্যে। লাল ও সবুজ শাকের মধ্যে প্রচুর আয়রন রয়েছে। এরপর মাংসের মধ্যে আয়রন রয়েছে। আমরা বলি, অন্তত একটি ডিম সে প্রতিদিন খাবে। আর অন্তত সে প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ খাবে। এটি একদম নিয়মিত খাদ্যতালিকার মধ্যে চলে যাবে। গর্ভাবস্থার সময় সে যেরকম ভাত খেত, এর তুলনায় একমুঠো চাল সে বেশি খাবে।