ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব এ বছর বেশি কেন?
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। রোগটি এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে হয়। ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে এই জ্বর পরিচিতি লাভ করে। এ বিষয়ে জনগণ বেশ সচেতন হলেও এ বছর ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি। আজ ২৮ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৮৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু জ্বর অত্যন্ত পরিচিত একটি বিষয়। আমাদের দেশের মানুষ এখন মিডিয়ার কল্যাণে বা চিকিৎসকদের মাধ্যমে এ রোগ সম্বন্ধে জানে এবং অনেকটা সচেতন। তবে এই সচেতনতার মধ্যেও এ বছরের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে সংখ্যার বিবেচনায় সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর কারণ কী?
উত্তর : বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে ডেঙ্গু জ্বর আমাদের দেশে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। ২০০০ সালের আগে চিকিৎসকদের কাছে বা জনগণের কাছে ডেঙ্গু জ্বরের পরিচয় তেমনভাবে ছিল না। প্রথম দিকে একটা-দুটো কেসের পর চিকিৎসকসমাজ সচেতন হয়ে গেল ডেঙ্গু জ্বরকে নিবারণ করার জন্য। এই জ্বরকে চিকিৎসা করার জন্য। মোটামুটি আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তবে এবার দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য বছরের তুলানায় এবার ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি। যদিও এর ভোগান্তি কম, মৃত্যুহার তেমন নেই, তবে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ এবং প্রভাব এই বছর বেশি। এর দুটো কারণ হতে পারে। একটি হতে পারে পরিবেশগত। আসলে ডেঙ্গু জ্বর তো পরিবেশগত কারণে হয়। আরেকটি হতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিবর্তন। পরিবেশগত কারণে বলা যায়, যেকোনো কারণে হয়তো মশার উৎপাদন বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশার উৎপাদন হয়তো বেড়েছে। আর দ্বিতীয় হলো, প্রথম ডেঙ্গু জ্বর দিয়ে শরীর যে প্রাইম হয়ে আছে, আবার কামড় দিলে ভাইরাস অ্যান্টিজেন হয়ে গেলে তার প্রকাশ হয়তো খুব দ্রুতগতিতে হচ্ছে। এ দুটোকেই আমার কাছে এই বছরের ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবের কারণে হিসেবে মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন : মূলত ডেঙ্গু জ্বর ছড়ায় কীভাবে?
উত্তর : এই জ্বর ছড়ায় মশার কামড়ের মাধ্যমে।
প্রশ্ন : কী ধরনের মশা?
উত্তর : এটি বিশেষ এক ধরনের মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ম্যালেরিয়ার জন্য যেমন মশা রয়েছে, তেমনি ডেঙ্গু জ্বরও এক ধরনের মশাবাহিত রোগ। যেখানে ফুলের টব থাকে, পরিষ্কার পানি জমে থাকে সেখানে এটি হয়ে থাকে। যেখানে বৃষ্টির পানি জমা থাকে, সেখান থেকেও এটি হতে পারে। মশা ছাড়া ডেঙ্গু জ্বর ছড়ায় না।urgentPhoto
প্রশ্ন : দিনের বেলায় কি এটি বেশির ভাগ ছড়ায়?
উত্তর : দিনের বেলা ডেঙ্গু মশা বেশি কামড় দেয়।
প্রশ্ন : তবে আমরা তো মশারি টাঙিয়ে শুই রাতের বেলায়। তাহলে?
উত্তর : মশারি তো টাঙাতে হবে। মশা কামড় দিলে তো আমরা অনেক সময় টের পাই না।
প্রশ্ন : তাহলে এটি থেকে বাঁচার উপায় কী?
উত্তর : এটি থেকে বাঁচার উপায় হলো মশার প্রজনন কমানো। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কোনো ধরনের পানি জমা না থাকে। ব্যক্তিগতভাবে খেয়াল রাখতে হবে, ফুলের টব বা বিভিন্ন জায়গায় যেন পানি না জমে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, প্রথম দিকে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটত। এখন নেই বললেই চলে। এখন রোগী ভোগান্তিও অনেক কমেছে, কারণ চিকিৎসকদের দক্ষতা বেড়েছে। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ছে। তবে ডেঙ্গু জ্বর এবার বেশি হচ্ছে। এটা কি যখন-তখন বৃষ্টি হলে ঢাকা শহরে পানি জমা হয়, এর কারণে হতে পারে। বিষয়টি এই রোগের জন্য কোনো ভূমিকা রাখে কি?
উত্তর : রোগটি তো খারাপ পানি থেকে হয় না, ভালো পানি থেকে হয়। বৃষ্টি হলে তো ভালো জায়গায়ও পানি জমে থাকে। প্রথম কথা হলো ঢাকা শহরে মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের আবহাওয়া প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু এটি পরিবেশগত একটি কারণ, তাই সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটি মশার প্রজননের পক্ষে চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবার সচেতন হওয়ার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে কি না?
উত্তর : কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রশ্ন : কী করতে হবে কর্তৃপক্ষকে?
উত্তর : কর্তৃপক্ষের সব সময় পদক্ষেপ নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর যেন না হয়, এ রকম পোস্টার ছড়িয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। টেলিভিশন, রেডিওর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলোকে মশা নিধনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব যেন না থাকে, সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে কর্তৃপক্ষকেই।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু জ্বর এক ধরনের মশাবাহিত রোগ। এটি এক ধরনের ভাইরাল রোগ। সাধারণ ভাইরাস জ্বরগুলোর থেকে ডেঙ্গুকে আলাদা করার উপায় কী?
উত্তর : মানুষ একে আতঙ্কের সঙ্গে দেখে। এর কারণ, প্রথম দিকে এই রোগে কিছু মানুষ মারা গেছে। যে রোগে মানুষ মারা যাবে একে তো মানুষ আতঙ্ক হিসেবে দেখবেই। আর ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাস। আমি তো বলি, এটি একটি জংলি ভাইরাস।
একটি ভাইরাস যদি ত্রাস হয়ে থাকে, তাহলে ডেঙ্গু ভাইরাস হবে সন্ত্রাস। আরো উচ্চ পর্যায়ের ত্রাস সৃষ্টি করবে সে। ভাইরাস জ্বরের যে ধরনটি আরো বড়সড় হয়ে ডেঙ্গু জ্বরের বেলায় দেখা যায়।
প্রশ্ন : সেগুলো কী?
উত্তর : ভাইরাস জ্বরে হঠাৎ করে জ্বর আসে। জ্বরের একটি পর্যায় থাকে। তবে ডেঙ্গু জ্বর হলে হঠাৎ করে আসবে এবং অনেক বেড়ে যাবে। আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে ১০৩-১০৪ ডিগ্রি জ্বর বেড়ে যাবে। ভাইরাস জ্বরে মাথা ব্যথা থাকে, ডেঙ্গু জ্বরে মাথা ব্যথা চূড়ান্তভাবে থাকবে। ভাইরাস জ্বরে চোখে ব্যথা থাকে না। ডেঙ্গু জ্বরে চোখে ব্যথা থাকে। চোখ নাড়ানোর সময় এখানে ব্যথা মনে হয়। ভাইরাস জ্বরে সারা শরীরে ব্যথা থাকে, ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে প্রচণ্ড রকম ব্যথা থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের সময় মেরুদণ্ডে এমন ব্যথা থাকে মনে হয়, হাড় ভেঙে যাচ্ছে। আসলে সাধারণ ভাইরাস জ্বরে যে রকম অবস্থা থাকে, তার থেকে বেশি গুণ খারাপ অবস্থা এই জ্বরে থাকে।
এ ছাড়া ডেঙ্গু জ্বরে প্রচণ্ড বমি বমি ভাব থাকে। মুখে তেতো একটি ভাব হয়। এর পর তিন-চার দিন পর ডেঙ্গু জ্বর যখন চলে যায়, তখনই উচ্চ ঝুঁকির সময় শুরু হয়।
প্রশ্ন : মানে জ্বর কমে যাওয়ার পর উচ্চ ঝুঁকি হয়! সেটি কেন হয়?
উত্তর : জ্বর কমে গেলে রোগীরা খুশি হয়ে যায়, জ্বর ভালো হয়ে গেছে। আমি তখন রোগীদের বলি, এই সময়টিই হলো ঝুঁকির সময়। জ্বর চলে যাওয়ার পর ডেঙ্গুর বিভিন্ন রকম পর্যায় শুরু হয়। একটা পর্যায়ে দেখা যায়, রক্তচাপ কমে রোগী কলাপস করছে। এটি ডেঙ্গু জ্বরের মারাত্মক একটি চিহ্ন। সাধারণ ভাইরাস জ্বরে রোগী শকে চলে যায় না। তবে ডেঙ্গু জ্বরে শকে চলে যেতে পারে। এ ছাড়া সাধারণ জ্বরে রক্তপাত হয় না। তবে ডেঙ্গু জ্বরে রক্তপাত হয়। প্লেটলেট কমে গিয়ে রক্তনালির দেয়ালের নমনীয়তা নষ্ট হয়ে রক্তপাত হতে পারে। সাধারণত ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এটি হয় না। এগুলো ডেঙ্গু জ্বরের খুব নেতিবাচক দিক। এসব কারণের জন্য ডেঙ্গু জ্বরের বেলায় সচেতন হতে হবে। চিকিৎসার বেলায় ভালোভাবে চিকিৎসা দিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের বেলায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট চিকিৎসা এবং বিছানায় বিশ্রাম (বেড রেস্ট) নিতে হবে।
প্রশ্ন : একজন মানুষের জ্বর হলে কী ধরনের লক্ষণ দেখলে তার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে? এবং তার প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত?
উত্তর : আসলে বাংলাদেশের মধ্যে ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বর বেশি হয়ে থাকে। ঢাকার মানুষ এই আবহাওয়ায় জ্বর হলেই মনে করে ডেঙ্গু জ্বর। ডেঙ্গু জ্বর না হলেও তার মনে আগে থেকে একটি ভয় থাকে। ভাবে, আমার মনে হয় ডেঙ্গু জ্বর হয়ে গেছে, এটি এক। দ্বিতীয় কথা হলো, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ হলো, এই জ্বর অল্প সময়ের মধ্যে খুব বেড়ে যাবে। মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, পিঠে ব্যথা, হাত-পা ব্যথা এগুলো হবে। তিন-চার দিনের মাথায় শরীরে লাল লাল র্যাশ উঠতে পারে। এগুলো দেখলে চিন্তা করতে হবে, রোগীর হয়তো ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। তখন রোগীকে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে কি না, সেটি নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা করতে হবে। এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো তাকে চলতে হবে। এর বাইরে গেলে আরো বড় ঝুঁকি হতে পারে।