মহৎ পেশার মানুষ

রোগীর সহায়তার জন্যই ‘প্যাশেন্ট এইড’ : অধ্যাপক রেজা বিন জায়েদ

Looks like you've blocked notifications!
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রেজা বিন জায়েদ। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

ছোটবেলায় ইনজেকশন দেখলে ভয় পেতেন তিনি। প্রতিবছর স্কুলে যখন ইনজেকশন দিতে আসত, তখন পালাই পালাই একটি ভাব। তবে পালালেও তো লাভ নেই, বাড়িতে ফিরে গেলে আবার যে ফেরত পাঠাবে। ইনজেকশন দেওয়ার সময়টি তাই বেশ খারাপ যেত।

ইনজেকশন দেওয়ার পর যখন ব্যথা হতো আর কয়েক দিন সেই ব্যথা থাকত, বেজায় বিরক্ত হতেন তিনি। তবে বড় হয়ে তিনি যেই পেশায় এলেন, সেটি ইনজেকশন সম্পর্কিত। ইনজেকশন আর কাটছেঁড়া নিয়েই এখন তাঁর কাজ।

যাঁর কথা বলছি, তিনি বিশিষ্ট চর্ম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রেজা বিন জায়েদ। প্রায় ২৯ বছর ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি করছেন গবেষণার কাজ। বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবামূলক মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছেন। ‘প্যাশেন্ট এইড’ নামে এ অ্যাপে ওষুধের মূল্য, ওষুধ খাওয়ার নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কোনো চিকিৎসকের বিস্তারিত তথ্য, অ্যাম্বুলেন্স সেবাসহ বিভিন্ন জরুরি তথ্য রয়েছে।

সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবনযাপন, গবেষণার বিষয় ও অ্যাপটি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

বাবা-মা ও মেডিকেলের শিক্ষকরা আমার অনুপ্রেরণা

আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, স্বাধীনতার পড়ে, দেশে তখন ডায়রিয়া, কলেরা ও পক্স। এটি ছিল মূলত স্মল পক্স। তখন দেশে অর্থ সংকটও ছিল, মানুষ অভাবে ছিল। তখন রোগে আক্রান্তের পরিমাণ বেড়ে গেল। আমি পত্রিকা পড়তাম; ইত্তেফাক পড়তাম। ইত্তেফাকের শিরোনামে একদিন দেখলাম, রাশিয়ার চিকিৎসকরা এখন বাংলাদেশে। এরপর আমি রাশিয়ার সেই চিকিৎসকদের চোখে দেখলাম। তাঁরা ভ্যাক্সিন দিচ্ছেন কলেরার, স্মল পক্সের। আমি তখন খুব ছোট। সম্ভবত ঘটনাটি ঘটেছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। স্টেশনে তাঁরা টিকা দিচ্ছেন, ইনজেকশন দিচ্ছেন। এটি দেখে আমার খুব ভালো লাগল। রাশিয়ার মানুষ এমনিতেই সুন্দর। তাঁদের দেখে আমার এত ভালো লাগল যে মনে হলো, পেশাটা একটি গর্বের বিষয়। তবে এটি অনেক আগের ব্যাপার।

চিকিৎসা পেশায় আসার ইচ্ছাটা তখন হলো, সেটি বলব না। তবে ভালো লাগল বিষয়টি। এরপর এ পেশায় আসার জন্য অনুপ্রেরণা দিলেন বাবা-মা। তাঁরা বললেন ডাক্তার হতে। কারণ, আমার পরিবারে কোনো চিকিৎসক নেই। এভাবে আমার মনের অজান্তেই কেমন যেন ইচ্ছা তৈরি হলো। এরপর ম্যাট্রিক পাস করলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ১০টি বিষয় ছিল। এর মধ্যে একটি ঐচ্ছিক। আমাদের দুটো ঐচ্ছিক বিষয় ছিল—উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞান। দুটির মধ্যে একটি নেওয়া যাবে। আমি ডাক্তারি পড়ব বলে জীববিজ্ঞান নিলাম। পরে ডাক্তারিতে ভর্তি পরীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে গেল চিকিৎসাছাত্র জীবনের শুরু।

আমার জন্মসাল ১৯৬২-এর ২২ অক্টোবর। আমি সিলেট মেডিকেল থেকে পাস করেছি। ১৯৭৮-এ ম্যাট্রিক পাস করেছি, ১৯৮০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। ’৮১-তে মেডিকেলে ঢুকলাম এবং ছয় বছর মেডিকেলে পড়লাম ইন্টার্নশিপসহ। ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা করা তখনই শুরু করলাম। ইন্টার্নশিপের সময় সাধারণত চিকিৎসকরা ক্যারিয়ার পরিকল্পনা করে থাকেন। আমার ইচ্ছা ছিল, একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবো। আমি ডার্মাটোলজিস্ট হতে চাইলাম।

আমার এসব কিছুতে প্রথম দিকে অনুপ্রেরণায় ছিলেন মা-বাবা ও পরে মেডিকেলের শিক্ষক। ডার্মাটোলজির শিক্ষকদের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।

কাটছেঁড়া সহ্য করতে পারতাম না

ছেলেবেলায় অনেক কিছুই ভয় পেতাম। এর মধ্যে খুব ভয় পেতাম ইনজেকশনকে।

আরেকটি মজার বিষয় হলো, আমি কাটছেঁড়া সহ্য করতে পারতাম না। এখন তো মুরগি বাজার থেকে কেটে আনা হয়। তবে আগে বাসায় এনে কাটা হতো। আমি কাটাকাটি দেখতে পারতাম না, রক্ত দেখতে পারতাম না। এখন আমার পেশা এটির সঙ্গেই জড়িত।

আমি খেলতে ভালোবাসতাম। মাঠে খেলতাম। আমাদের খেলার উপকরণ খুব কম ছিল। বড়জোর একটি টেনিস বল বা ফুটবল ছিল। এই হলো আমাদের উপকরণ। তাও আট থেকে দশজন মিলে কেনা। তখন একজনের পক্ষে কেনার মতো অবস্থা ছিল না। একটি উপকরণ পেলে সেটি নষ্ট হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আরেকটা কেনা হতো না।

আমার বাবার নাম জায়েদ মোল্লা, মা রিজিয়া বেগম। তাঁরা পাবনার অধিবাসী। বাবা চাকরির কারণে পাকিস্তানে ছিলেন। আমার স্কুল শিক্ষাজীবনের অর্ধেক অংশ পাকিস্তানে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাকিস্তানে পড়েছি। স্বাধীনতার পর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আমি বাংলাদেশে। পাকিস্তানে আমি এয়ারফোর্স পিএএফ স্কুল থেকে পড়ালেখা করি। এরপর বাংলাদেশে শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। নটর ডেম কলেজে কলেজজীবন। এরপর সিলেট মেডিকেলে পড়াশোনা করি। পরে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তখন এর নাম ছিল আইপিজিএমআর। ওখান থেকে আমার পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ও পিএইচডি দুটোই।

আমার কর্মক্ষেত্র শুরুই হচ্ছে ডায়াবেটিস হাসপাতাল থেকে। প্রথম আমার চাকরি হয় মেডিকেল অফিসার হিসেবে। ডায়াবেটিস হাসপাতালে অধ্যাপক হিসেবে আমি পদত্যাগ করি। বর্তমানে শুধু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছি।

ব্রণের ওপর গবেষণা করছি

বর্তমানে আমি মূলত ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস করছি, রোগী দেখার কাজ। তবে আমি এখন যে বিষয়টির সঙ্গে জড়িত, সেটি হলো মেডিকেল রিসার্চ (চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণা)। আমার কিছু প্রকাশনা রয়েছে। কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টায় আছি। গবেষণার বিষয়ের মধ্যে একটি হলো অ্যাকনি বা ব্রণ। ব্রণের ওপর আমি গবেষণা করছি। কারণ, বর্তমানে এর প্রাদুর্ভাব সব জায়গায়। সারা পৃথিবীময়। ব্রণ সাধারণত বয়ঃসন্ধিতে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে। চেহারা খারাপ দেখায় বলে এটি রোগী গ্রহণ করতে পারে না। অনেকে ব্রণ নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মানসিক রোগে পর্যন্ত ভোগে।

আমি প্র্যাকটিসের একটি অংশ ইমেজ (ছবি) দিয়ে অ্যানালাইসিস (পর্যবেক্ষণ) করি। প্রত্যেক রোগীর আক্রান্ত অংশের ছবি তুলি। এ ছবি তোলার বিষয়টি আমি ১২ বছর ধরে করছি। এ ছবিগুলো দেখে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করি। এ ছবিগুলো যখন আমি দেখি, ভাবি, আরো কীভাবে এর ব্যাখ্যা করা যায় সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ইমেজ অ্যানালাইসিসের (ছবি পর্যবেক্ষণ) ওপর আমি বেশি মনোযোগ দিই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করার চেষ্টায় রয়েছি। কিছুটা অগ্রসর হয়েছি। বিষয়টি অনেকের কাছে হয়তো নতুন মনে হবে। সহজভাবে বলছি, আজকাল মেশিন লার্নিং সিস্টেম চালু হয়েছে। মেশিন লার্নিং সিস্টেম হলো যন্ত্র নিজে নিজে শিখে নেবে রোগ কীভাবে নির্ণয় করা যায়। একবার যদি প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় মেশিনকে, তাহলে সে নিজে রোগ নির্ণয় করে, এর চিকিৎসা নির্ধারণ করতে পারে। একে কম্পিউটার সায়েন্সে বলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। একে এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়। এটি এখন অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে এর ব্যবহার রয়েছে। এর ওপর কাজ করছি আমি।

কারণ, যে পরিমাণ ব্রণ সারা পৃথিবীতে হচ্ছে, চিকিৎসকরা এর চিকিৎসা দিয়ে কুলাতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অনেকটুকু পূরণ করতে পারবে। মেশিন নিজেই নির্ধারণ করে দেবে ব্রণের কী জাত এবং এর চিকিৎসা কী হতে পারে। এটি মানুষের চেয়ে কয়েক গুণ ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি অত্যন্ত দ্রুত কাজ করতে পারে। এর ওপরে আমি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এটি সফল হলে মানুষের খুব কাজে লাগবে। তবে একটি কথা বলে রাখি, এটি চিকিৎসকের প্রতিস্থাপক নয়। ত্বক বিশেষজ্ঞ বা অন্য কোনো চিকিৎসকের প্রতিস্থাপক নয় এটি।

আজকাল সবার হাতে মোবাইল রয়েছে। এতে ক্যামেরা রয়েছে। ক্যামেরার ছবিই যথেষ্ট। এটি প্রশিক্ষিত মেশিনকে পাঠিয়ে দেওয়া গেলে সে রোগকে পর্যবেক্ষণ করে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা দেবে। মেশিনের যথাযথতা চিকিৎসকের সমান বা বেশি।

অল্পশিক্ষিত মানুষের কাছে টেলিমেডিসিনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি

আমার পেশা ডার্মাটোলজি। এটি নন-ইমার্জেন্সি, অর্থাৎ রোগীর এমন কোনো অবস্থা হয় না যে সব সময় তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ভর্তি হতে হয়। এখানে একটি স্মরণীয় বিষয় রয়েছে। আমি এ ছবি নিয়ে কাজ করার সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগ শুরু করি, বিশেষ করে ইউরোপে। আপাতত আমি টেলিমেডিসিন সফটওয়্যার দিয়ে চলছি। টেলিমেডিসিন ব্যবহার করে আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছি। বলতে গেলে ন্যূনতম অথবা বিনা পয়সায়। এভাবে আমি চারটি সেন্টারে সেবা দিতে পারছি। ২০১১ সাল থেকে আমি টানা এ স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে এবং শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে, তারাই বেশি টেলিমেডিসিন গ্রহণ করে। তবে একজন শিক্ষিত মানুষকে টেলিমেডিসিনের কথা বললে সে সহজে গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যারা শিক্ষিত নয়, তাদের বিশ্বাস অগাধ। অল্পশিক্ষিত মানুষের কাছে টেলিমেডিসিনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি শিক্ষিত মানুষের তুলনায়।

চর্মরোগের চিকিৎসক বাড়ানো দরকার

আমি বলব, চর্মরোগ চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। চর্মরোগী বেশি। বেশিরভাগ চর্মরোগের চিকিৎসা জেনারেল প্র্যাকটিশনার দিয়ে করা হয়। জেনারেল প্র্যাকটিশনাররা আরো একাডেমিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিয়ে চিকিৎসা করলে বিষয়টি আরো ভালো হবে। কারণ, আমার হিসাব অনুযায়ী, ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ রোগী এখনো জেনারেল প্র্যাকটিশনার দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন।

চিকিৎসাক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তি হচ্ছে, তা বলব না। আমি বলছি, আরো দক্ষ হলে এ চিকিৎসা ভালো করা সম্ভব। চর্মরোগের চিকিৎসক বাড়ানো দরকার এবং জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের চর্মরোগের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। আমার মনে হয়, এতে আরো ভালোভাবে চিকিৎসা করানো যাবে।

প্যাশেন্ট এইড অ্যাপের কথা

আইটি বা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে আমার শখ অনেক আগে থেকে। আমি টেলিমেডিসিন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির সঙ্গে জড়িত। আমি কিছু অ্যাপ তৈরি করি। এটি স্বাস্থ্যসেবার কাজে লাগবে। সে রকম একটি অ্যাপ রয়েছে। এর নাম ‘প্যাশেন্ট এইড’। এটি এমন একটি অ্যাপ, এখানে শুধু রোগী নয়, রোগীর পরিবারে সবারই কাজে লাগতে পারে।

এ অ্যাপটা কোন সময় কাজে লাগে? যখন পরিবারে একজন সদস্য রোগাক্রান্ত হয়, যখন পরিবারে রোগীসহ অন্য সদস্যরা রোগের ব্যাপারে সচেতন হয়। অর্থাৎ রোগের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে যায়। এবং পরে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া পর্যন্ত এই যে একটি সময় থাকে, এটি হতে পারে সেই দিনই, হতে পারে চার দিন, হতে পারে আরো বেশি দিন—এই যে সময় থাকে এর ভেতরে রোগী বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে যে আমার এ রকম উপসর্গ হচ্ছে, কেন হচ্ছে—পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, অন্যান্য সবার সঙ্গে আলোচনা করে। এই আলোচনার পরে মোটামুটিভাবে সে বুঝতে পারে চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। এটি এক নম্বর।

দুই নম্বর হলো, কোন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করলে তার ভালো হবে, সেটি দেওয়া রয়েছে অ্যাপে। অনেকে উপদেশ দেয়, তুমি সার্জারির চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করো। অনেকে বলে, তুমি মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাও। এসব উপদেশ থেকে রোগী মোটামুটিভাবে ধারণা করতে পারে যে কোন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত হবে। এই যে সময়টি, এ সময়ের বন্ধু হলো আত্মীয়স্বজন, তার বন্ধু-বান্ধব ও আশপাশের সহকর্মীরা। এখানে ‘প্যাশেন্ট এইড’ আরেকটি বন্ধু হতে পারে। এই অ্যাপটি সে ব্যবহার করে এসব জিনিস জানতে পারবে। অ্যাপটি রোগীকে সাহায্য করবে। চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত এ অ্যাপের ব্যবহার।

এরপর এ অ্যাপের আরো কিছু ব্যবহার রয়েছে। যখন চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিরে এলো, যখন বুঝতে পারল, তার অসুখটা কী, তখন আবার এ অ্যাপের ব্যবহার শুরু হয়।

তখন এ অ্যাপের ব্যবহার কী? প্রেশক্রিপশনে অনেক ওষুধ দেওয়া থাকে। এ অ্যাপের মাধ্যমে সে ওষুধগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে। অনেক সময় প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকে না ওষুধটি খাওয়ার আগে খাবে, নাকি পড়ে। অনেক সময় লেখা থাকে না যে ওষুধটি কত দিন খেতে হবে। সে ক্ষেত্রে অ্যাপে গাইড দেওয়া রয়েছে। এমনকি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও জানানো হয়েছে।

যেমন ধরুন, হিস্টাসিন। এটি অ্যালার্জি, সর্দি-কাশির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। হিস্টাসিন খেলে ঘুম ঘুম ভাব হতে পারে। এটি রাতে খেলে ভালো। কারণ, এর সিডেটিভ অ্যাকশন রয়েছে। এটি রাতে খেলে সারা রাত ঘুম ভালো হবে। এই বিষয়টি কিন্তু সে জানতে পারবে। তাই এ বিষয়গুলো জানার জন্য এ অ্যাপের সাহায্য নিতে পারে।

আরেকটি হচ্ছে, রোগ সম্পর্কিত বিষয়ে কথা থাকে। রোগী চিকিৎসকের কাছে জেনে আসে কী রোগ হলো তার। অ্যাপের মধ্যে বাংলায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষা ব্যবহার না করে রোগের বিবরণ রয়েছে। ধরুন, আমার একটি রোগ ধরা পড়ল। সেটি হলো অ্যাজমা। অ্যাজমা সম্পর্কে অ্যাপে লেখা রয়েছে। অ্যাজমা থেকে কী হতে পারে, কী করলে ভালো থাকবে, কী খাওয়া-দাওয়া করতে হবে ইত্যাদি। সাধারণ যে প্রশ্নগুলো রোগীর মাথায় সব সময় ঘোরে, সেগুলোর উত্তর অ্যাপটিতে রয়েছে। অথচ চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নেওয়ার সময় হয়তো রোগী জিজ্ঞেস করতে ভুলে যায়, হয়তো চিকিৎসকের নিজেরও সময় থাকে না, এত বিস্তারিতভাবে বলার। কিন্তু তথ্যগুলো এ অ্যাপে পেয়ে যাবেন।

অ্যাপটি চালু রয়েছে দেড় বছর ধরে। এখনো এর প্রচারণায় আমার অতটা যাইনি। তবে বর্তমানে এর নিয়মিত ব্যবহারকারী ২০ হাজার। এ অ্যাপটি পাওয়া যাবে গুগল প্লেতে। এটি ফ্রি অ্যাপ। খুব সহজে ডাউনলোড করা যায় এবং ইনস্টল করা যায়। অ্যাপটি সম্পর্কে একটি ভিডিও রয়েছে অ্যাপের সঙ্গে। ভিডিও দেখেও বোঝা যাবে, অ্যাপটিতে কী রয়েছে এবং কীভাবে ব্যবহার করবে। প্যাশেন্ট এইড নামে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে। https://goo.gl/nbVswh থেকে বিনামূল্যে অ্যানড্রয়েড ব্যবহারকারীরা ডাউনলোড করতে পারবেন।

এই অ্যাপের আরেকটি বিষয় রয়েছে। রোগীরা সাধারণত ইনভেস্টিগেশন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে স্পর্শকাতর। আমার চিকিৎসা পেশার অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। আমি সহজভাবে দু-একটি কথা বলি। রোগীরা ভাবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিসের জন্য দেওয়া হলো? না জানি কী ফল আসবে? এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। অথবা পরীক্ষা কোথা থেকে ভালোভাবে করা যাবে, ভালো পাওয়া যাবে, এসব বিষয়ে ভাবে। রোগীর এসব মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বুঝে এ অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ পরীক্ষা কেন দিল, ওখানে লেখা রয়েছে এবং এর ফল কী হলে কী হতে পারে, লেখা রয়েছে। পরীক্ষাগুলো কোথায় করা যেতে পারে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া রয়েছে এবং কী প্রস্তুতিতে যাওয়া উচিত, সেটি দেওয়া রয়েছে। গাইডলাইন, ম্যাপ সব দেওয়া রয়েছে। চেষ্টা করছি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টিতে খরচ কমানোর। আসলে অনেক কিছুরই খরচ কমানো যায় অ্যাপের মাধ্যমে। অ্যাপ দিয়ে পরীক্ষার খরচও কমানো যেতে পারে। যদি তথ্য দিই এক জায়গায় পরীক্ষার খরচ এত, অন্য জায়গায় খরচ অত। এটি হিসাব করে খুব সহজে খরচ কমানো যায়। এর কাজ চলছে। একটি জায়গায় হয়তো খরচ দুই হাজার টাকা। অন্য জায়গায় খরচ এক হাজার টাকা। তাহলে খরচ এক হাজার টাকা কমানো গেল। এই জিনিসটি কিন্তু আমি করতে যাচ্ছি। এ অ্যাপটি বাংলাদেশে এখনো কেউ করেনি। এ অ্যাপটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হয়নি। আমি মনে করি, অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লে এর সুবিধাগুলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।

রোগীদের মানসিকতা বোঝা জরুরি

আমার স্ত্রী চিকিৎসক। তিনি গাইনোকোলজিস্ট। আমার এক মেয়ে, দুই ছেলে। আমার মনে হয়, রোগীদের মানসিকতা বোঝা এবং সে অনুযায়ী মানসিক সহযোগিতা করা খুব জরুরি। অর্থাৎ রোগীরা যখন রোগে ভুগে, তখন রোগী নিজে বুঝে এবং পরিবারের সদস্যরা বুঝে যে তারা কতটুকু বিপদের মধ্যে রয়েছে। আমার মতে, রোগ হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপদ। এ বিপদ কেবল নিজের জন্য নয়, পরিবারের সব সদস্যের জন্য। তাই রোগী ও রোগীর পরিবারের চিন্তাভাবনা বোঝা, বুঝে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, কীভাবে কমানো যায় সেটি নিয়ে কাজ করতে চাই। এটি আমার সবচেয়ে বড় জীবনদর্শন।