স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কাদের বেশি

Looks like you've blocked notifications!
ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

বয়স বাড়তে থাকলে নারীর  স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আরো অনেক কারণ রয়েছে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি  হওয়ার। তবে সংকোচ না করে প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলে মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়। আজ ৯ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২০০ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের, ক্যানসার ইপিডিমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার কী? কিছু কারণ স্তন ক্যানসারের জন্য দায়ী। সেগুলো কী?

উত্তর : শরীরের অন্যান্য জায়গার মতো স্তনেও টিউমার হয়। টিউমার তো দুই ধরনের হয়। একটি হলো বিনাইন টিউমার, অন্যটি ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। আমাদের যে কোষ বৃদ্ধি হয়, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হই, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি কোনো অস্বাভাবিকতা হয়, অনেক কোষ যদি একসাথে বাড়তে থাকে নিয়ম ছাড়া- এ রকম অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির কারণে যে চাকা বা পিণ্ড হয় একে বলি টিউমার। এটা অন্য জায়গার মতো স্তনেও হতে পারে। এই টিউমার দুই রকম। টিউমার যে অঙ্গে বা যে টিস্যুতে (অনেকগুলো কোষের সমন্বয়ে বলি টিস্যু) হয়, যদি টিস্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং অন্য কোথাও না ছড়ায় একে বলি বিনাইনি টিউমার। অর্থাৎ এটা ক্ষতিকর নয়। কারণ এটি অন্য কোথায়ও ছড়ায় না। আক্রান্ত করে না।এটা অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিলেই চিকিৎসা করা হয়ে যায়।

আরেকটি হলো ম্যালিগনেন্ট টিউমার, যেটা নিয়ে আমাদের মূল মাথা ব্যথা। সেটা হলো, এই টিউমার বড় বা ছোটো হতে পারে। তবে এর প্রকৃতিটা হলো সে এক জায়গায় চুপচাপ থাকবে না। এটি আশপাশের গঠনগুলোকে ধরবে, শরীরে যে লসিকা নালি রয়েছে এর মাধ্যমে আশপাশের গ্রন্থি এবং লসিকা গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে। এমনকি রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে শরীরের দূরের কোনো অঙ্গের ওপর আঘাত করতে পারে। এটি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়। এটিও হলো ম্যালিগনেন্ট টিউমারের বৈশিষ্ট্য। আর সহজে বোঝার জন্য শরীরের যেকোনো ম্যালিগনেন্ট টিউমারকে আমরা বলি ক্যানসার। স্তনেরটাও একই রকম।urgentPhoto

স্তনের মধ্যে যে টিউমার হয় বা ক্যানসার হয় সেটিতো নয়, ছোটোখাটো আরো অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। ফোড়া হতে পারে, ত্বকে সমস্যা হতে পারে, নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।

আরেকটি হয় টিউমারের ভেতরটি ভরাট থাকে। ভেতরটি একদম ভরাট। কোনো ফাঁকা নেই। তবে এক ধরনের বিষয় হয়, সিস্ট বলি আমরা, একটি বস্তা বা থলের মতো। এর মধ্যে পানি জমতে পারে, পুঁজ জমতে পারে। এটাকে আমরা সিস্ট বলি। স্তনে এ রকম সিস্টও হতে পারে।

স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে জীবন যাপনে কিছু পরিবর্তন আনলে ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায়। ঝুঁকির কারণ আমরা বলি, খুব মুটিয়ে যাওয়া। এটি কীভাবে হয়? যাদের খাওয়া দাওয়ার রুচি খুব বেশি, মাংস ও লাল মাংস, চর্বি জাতীয় মাংস বেশি খায়, তবে পরিশ্রম করে না, কাজ করে না, ব্যায়াম করে না তাদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এটি স্তন ক্যানসারের একটি ঝুঁকির কারণ।

খুব অল্প বয়সে বিয়ে হলে যেমন জরায়ুমুখের ক্যানসার বাড়ে। আবার খুব বেশি বয়সে বিয়ে বা প্রথম  বাচ্চা যদি ৩০ থেকে ৩২ বছরের পরে নেয় তাহলে স্তন ক্যান্সারে ঝুঁকি বাড়ে। বিয়ের বয়স একটি ঝুঁকির কারণ। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। আগেও নয়, পরেও নয়।

আর সবচেয়ে বেশি জোড় দিতে চাই স্তনপান করানোর ওপর। একজন মা তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াবেন, এটা স্বাভাবিক। যাঁরা সন্তানকে স্তন পান করান না তাঁরা দুই ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন। প্রথমত নিজের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেন। আর দ্বিতীয়ত শিশুর যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেটা মায়ের দুধের মধ্য থেকে আসে সেটি কমিয়ে দেন। এই জন্য আমরা বলি কিছু জিনিস চাইলেই আমরা পরিবর্তন করতে পারি।

আর কিছু ঝুঁকির কারণ রয়েছে যেগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নাই। এগুলো আসলে অপরিবর্তনযোগ্য। এর মধ্যে এক নম্বর  হলো বয়স। আর কোনো ঝুঁকির কারণের দরকার নেই। কেবল বয়স বাড়তে থাকবে একজন মহিলার স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। পশ্চিমা বিশ্বে বলা হয়, পঞ্চাশের বেশি বয়সে ঝুঁকি বেশি। তবে আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ৪০ বছরের পর থেকেই রোগী আসতে থাকে। পরিবেশগত কারণেও এটি হতে পারে।

এ ছাড়া কারো পরিবারে যদি মা,খালা নানি, বড় বোন এ রকম কারো স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা থাকে তাহলে ঝুঁকি বেশি থাকে।

আরো কিছু বিষয় রয়েছে, খুব অল্প বয়সে যাদের মাসিক হয়ে যায় এবং দেরিতে বন্ধ হয়। ইসট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের সাথে যেহেতু স্তন ক্যানসারের সম্পর্ক রয়েছে, যত বেশি লম্বা সময় ধরে কেউ এই হরমোনের সংস্পর্শে থাকবে, ততো বেশি ঝুঁকি হবে। আরেকটি হলো মাসিক দীর্ঘস্থায়ী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হতে পারে। অথবা কারো অস্ত্রোপচারের পর যদি ইউটেরাস ফেলে দেওয়া হয় তখন অনেকের অনেক ধরনের সমস্যা হয়। এ সময় কখনো কখনো চিকিৎসক রিপ্লেসমেন্ট হরমোন থেরাপি দেন। এটা দীর্ঘদিন নিলে তাদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

প্রশ্ন : রোগ নির্ণয় কীভাবে করা হবে?

উত্তর : আমরা যে বলি প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় এটারও দুটো ধাপ রয়েছে। একটি ধাপ হলো যখন স্তন ক্যানসারের কোনো লক্ষণ ফুঁটে উঠেছে। যেমন লক্ষণগুলো কী? একটি চাকা বা পিণ্ড যদি হয়, আরেকটি হলো চামড়ার মধ্যে যদি কুচকানো হয়, স্তনের বোটা যদি ভেতরে ঢুকে গিয়ে থাকে  অথবা সেখান থেকে যদি রক্ত বা রক্ত মিশ্রিত পানি বের হয়। এ ধরনের যদি লক্ষণ থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

উন্নত বিশ্বে রোগটি নির্ণয়ের জন্য ম্যামোগ্রাম করা হয়। ম্যামোগ্রাম এমন ধরনের এক্সরে যেটা করলে স্তনের ভেতর কোনো সূক্ষ্ম পরিবর্তন হলে সেটা ধরা পড়ে।  তবে আমাদের দেশে তো এটি গ্রামেগঞ্জে বা জেলা পর্যায়ে নেই।

আরেকটি হলো ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন। একজন চিকিৎসককে দিয়ে স্তন পরীক্ষা করা। আর সর্বশেষ হলো নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা। একজন মহিলা যদি প্রতি মাসে নিজের স্তন পরীক্ষা করেন তখন করতে করতে একটা সময় ঠিকই টের পাবেন। কীভাবে করবে সেটি? মাসিক শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে একটি তারিখ ঠিক করে নিতে হবে। প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট সময় ওই নারী  স্তন পরীক্ষা করে দেখবেন। প্রথমে দেখবেন চামড়ার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আছে কি না। ডান হাত দিয়ে বাম স্তন এবং বাম হাত দিয়ে ডান স্তন অনুভব করতে হবে। স্তন পরীক্ষার সাথে সাথে অবশ্যই তাঁর বগলতলা পরীক্ষা করবেন। কারণ আমরা জানি স্তনের ক্যানসার হলে সর্বপ্রথম বগলতলা আক্রান্ত হয়। এইভাবে একজন মহিলা যদি প্রতি মাসে একবার পরীক্ষা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন।

অবশ্যই হাতের মাঝের তিন আঙ্গুল ব্যবহার করতে হবে। ঘড়ির কাটার মতো চার দিকে হালকা চাপ দিতে হবে। এরপর মাঝখানে চাপ দিতে হবে। এতে যদি মার্বেল বা সুপারির মতো কিছু টের পাই তাহলে বুঝব এটা টিউমার হতে পারে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই আপনি আপনার কাছে যে চিকিৎসক রয়েছেন তাঁর কাছে যাবেন।

প্রশ্ন : একটু জানতে চাইব আতঙ্কহগ্রস্ত হওয়ার আগে, আমাদের দেশের নারীদের সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টি প্রভাবিত করে লজ্জাবোধ সামাজিকভাবে। এমনও অনেকে রয়েছেন স্বামীর সাথে কথা এ বিষয়ে কথা বলতেও লজ্জাবোধ করেন। তাঁদের জন্য কী পরামর্শ?

উত্তর : তাদের জন্য একটি কথাই বলব, যেহেতু রোগটি চিকিৎসা না করলে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে, তাই চিকিৎসা করাতে হবে। এটি এমন একটি রোগ যেটা চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়া সম্ভব, আবার চিকিৎসকের কাছে  না গেলে প্রাণঘাতী হিসেবে ধরি। সেই রোগের জন্য সংকোচ করব না। টের পেলে স্বামী বা সন্তানদের বলব। আর চিকিৎসকের কথা যখন আসবে তখন নারী চিকিৎসক যদি হাতের কাছে থাকেন তাঁর কাছে যাবেন তবে এর মানে এই নয় যে আপনি পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যাবেন না। কারণ জীবন বাঁচানো ফরজ। যত দেরি করবেন ততই ঝুঁকির দিকে রোগটি চলে যাবে।