নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যার জরুরি বিষয়গুলো জেনে নিন

Looks like you've blocked notifications!
নবজাতকের পরিচর্যার বিষয়ে আলোচনা করেছেন ডা. আবু তালহা ও ডা. সানজিদা হোসেন। ছবি : এনটিভি

পরিবারে নতুন শিশু মানেই যেন আনন্দ আর উচ্ছাসের আগমন। তবে যতটা আনন্দ, ততটা দুশ্চিন্তাও। দুশ্চিন্তা শিশুর সঠিক পরিচর্যা নিয়ে। আর এ বিষয়টি থেকে মুক্তি পেতে নবজাতকের সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৫০তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. আবু তালহা। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে শিশু বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত।

প্রশ্ন : নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যার ভেতর কোন বিষয়গুলো পড়ে?

উত্তর : প্রথমে আমাদের জানতে হবে, আসলে নবজাতক কী। সব শিশুই নবজাতক নয়। নবজাতকের একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা রয়েছে। আমরা সাধারণত বলি, জন্মের পরপর যে শিশুটি সে নবজাতক। জন্মের পর থেকে শুরু করে শূন্য থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত, যে বয়স রয়েছে, তাকে আমরা বলি নবজাতক। এই নবজাতকের পরিচর্যাটা আসলে আমরা কয়েকভাবে করতে পারি। একটি শিশু বাসায় আসবে, সেক্ষেত্রে এর পরিচর্যা কিন্তু শুরু হয় অনেক আগে থেকে। যখন দেখবেন একজন নারী গর্ভাবস্থায় থাকে, তখন থেকে নবজাতকে পরিচর্যা শুরু হয়ে যায়।

নবজাতকের পরিচর্যার জন্য প্রথমে যে বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, সেটি হলো, গর্ভবতী মায়ের পরিচর্যা করতে হবে। একজন গর্ভবতী মা সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে কি না দেখতে হবে। কারণ, এই পুষ্টি বাচ্চার শরীরের ওপর নির্ভর করবে। সেই মাকে আপনি একটি শান্ত পরিবেশ দিচ্ছেন কি না দেখতে হবে। কারণ, মা যদি চাপযুক্ত জীবনযাপন করে, সেই প্রভাবটা তার পেটে যে বাচ্চাটা রয়েছে তার ওপর পড়বে। এবং এই সময় একজন গর্ভবতী নারীকে নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। আমরা বলি, অন্তত চারটি চেকআপ করতে হবে। এই চারটি চেকআপ করে আপনাকে দেখতে হবে পেটের মধ্যে বাচ্চার কোনো সমস্যা হলো কি না। বাচ্চা ঠিকমতো নড়াচড়া করছে কি না। বাচ্চার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো তৈরি হয়েছে কি না। গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস তৈরি হলো কি না, অথবা তার উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হলো কি না, অথবা তার খিচুনি জনিত কোনো রোগ তৈরি হলো কি না। কারণ, এই জিনিসগুলো পেটে যে বাচ্চাটা রয়েছে, তার ওপর প্রভাব ফেলে। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, গর্ভাবস্থার শেষের দিকে মায়ের জ্বর বা প্রস্রাবে সংক্রমণ হলো কি না।

বাচ্চার জন্ম যেন ভালোভাবে হয়, সুস্থভাবে হয়, এ জন্য কিছু কাজ করতে হবে। আমাদের ভেতর একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকে ভাবেন, আমি বাসায় প্রসব করাব, হাসপাতালে করাব না। আমি সেই ক্ষেত্রে একটা অনুরোধ করব যে, বাচ্চার জন্মগ্রহণটা অন্তত একটি সরকারি হাসপাতালে হওয়া উচিত। সরকারি হাসপাতালে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কোনো সমস্যা হলে বুঝতে পারবেন। আমার বাচ্চা জন্ম নিয়েছে, হঠাৎ করে দেখা গেল, তার বার্থ ট্রমা হচ্ছে। অথবা জন্ম নেওয়ার পর বাচ্চাটা শ্বাস নিতে পারছে না। এগুলোর দ্রুত যদি সঠিভাবে চিকিৎসা না করেন, তাহলে হাসপাতালে প্রসব করাতে হবে।

আমরা বলি,  জন্মের পরবর্তী যে মিনিটটা সেটি হলো গোল্ডেন মিনিট। এই এক মিনিটের মধ্যে বাচ্চার যদি কোনো শ্বাসকষ্ট বা নিঃশ্বাসের কষ্ট না হয়, বাচ্চাটা আজীবন ভালো থাকবে। এই এক মিনিট থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাচ্চাটা যদি শ্বাস না নেয়, মারাত্মক নিউরোলজিক্যাল রোগ হবে। দ্বিতীয় যেটি হলো, হাসপাতালে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার পরপরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেখা হয়, সেটি হলো, বাচ্চার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ, ওই সময় বাচ্চা মায়ের যে জরায়ু থাকে সেটি দিয়ে ভেজা থাকে। কাজেই সেই পানিটা যদি ভালোভাবে মুছে দেওয়া না হয়, তাহলে ওই বাচ্চার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া কিন্তু বাচ্চার মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ।

গ্রামে অনেক ক্ষেত্রে একটি বিষয় এখনো প্রচলিত রয়েছে যে বাচ্চার জন্মের পরপরই গোসল করিয়ে দেওয়া। এই গোসল করানো যাবে না, অন্তত তিন থেকে চার দিন। এরপর আপনি আস্তে আস্তে শরীর মুছে দিতে পারেন। গ্রামে আরেকটি বিষয় রয়েছে। জন্মের পরপরই দেখা যায় বাচ্চাকে মধু খাওয়ানো হয়। আসলে এটি কিন্তু একটি ভ্রান্ত ধারণা। আমরা বলি, বাচ্চা জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছু দেবেন না। এক ঘণ্টার মধ্যে অন্তত মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সিজার করা শিশুকেও এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

বুকের দুধ খাওয়ালে সুবিধাগুলো কী? বাচ্চা যখন বুকের দুধ খাবে, তখন মায়ের শরীর থেকে কিছু হরমোন বের হয়। হরমোনগুলো বুকের দুধের গতি বাড়িয়ে দেয়। এই এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ার জন্য যে মাড়ির নড়াচড়া সেটিতে সমস্যা হয়। এই সময় যদি বুকের দুধ খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন, তাহলে দেখা যায়, এই বাচ্চাটা ছয় মাসের মধ্যে খুব ভালো বুকের দুধ খেতে পারে। এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ এক ঘণ্টার মধ্যে শাল দুধটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা যেটি বলি, এই শাল দুধটা প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। শাল দুধের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর যে উপাদানগুলো রয়েছে, আপনি পৃথিবীর অন্য কোনো দুধে বা অন্য কোনো খাবারে এটা পাবেন না। সাধারণত শাল দুধ নবজাতকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আরেকটি বিষয় বলব, অনেক সময় দেখা যায় ছোট বাচ্চা রয়েছে, পরিবারের সবাই আনন্দে আছে। বাচ্চা জন্মের পর পরিবারের সবাই আনন্দ- উচ্ছাস করতে থাকে। বাচ্চাকে ধরার আগে হাতটা ভালো করে দুই মিনিট করে সাবান দিয়ে ধুতে হবে। গবেষণায় যেটা বলে শুধু মাত্র হাতটা ধুয়ে যদি কেউ বাচ্চাকে ধরে, তাহলে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৬০ ভাগ কমে আসবে। এটা এতো গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি বাচ্চা হলে, তার পরিবারের সবাইকে কাউন্সেলিং করি। বলি, এই এক  থেকে দেড় মাস আপনি অবশ্যই বাচ্চাকে ধরার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোবেন।