কীভাবে বুঝবেন মস্তিষ্কের টিউমার

মস্তিষ্কের টিউমার অত্যন্ত জটিল একটি রোগ। তবে দেশে এখন এর সফল চিকিৎসা করা সম্ভব। আজ ১৯ নভেম্বর, এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২২১০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. সৌমিত্র সরকার।
urgentPhoto
প্রশ্ন : মস্তিষ্কের টিউমার অত্যন্ত জটিল একটি সমস্যা। সবাই এ সম্পর্কে জানি আমরা কমবেশি। মস্তিষ্কের টিউমার আসলে কী? এবং এর পেছনের কারণগুলো কী কী?
উত্তর : শরীরের অন্যান্য অঙ্গে যেমন টিউমার হয়, তেমনি মস্তিষ্কেও এক ধরনের টিউমার হয়। কী কারণে মস্তিষ্কের টিউমার হয়? আসলে মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং বেশির ভাগ লোকের মস্তিষ্কের টিউমারের আমরা কারণ খুঁজে পাইনি। তবে কিছু কিছু কারণ রয়েছে, যেগুলো থাকলে মস্তিষ্কের টিউমার হতে পারে, সেটি আমরা বলে থাকি। যেমন : পরিবারে যদি কারো মস্তিষ্কের টিউমার থাকে, তার টিউমার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে হবেই, ঠিক তা নয়। এ ছাড়া রেডিয়েশন এক্সপোজার, অর্থাৎ অনেক বেশি যার এক্স-রে করতে হয়, বারবার যদি কোনো কারণে মস্তিষ্কে এক্স-রে করা হয়, সে ক্ষেত্রে হওয়ার একটি আশঙ্কা থাকে। আবার কিছু ভাইরাস রয়েছে, এর কারণেও মস্তিষ্কের টিউমার হয়ে থাকে। আসলে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার জন্য। যে কারোই হতে পারে এটা। তবে কিছু উৎপাদক রয়েছে, যেটা এখানে কাজ করে।
প্রশ্ন : মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত হলে কী কী ধরনের উপসর্গ হবে? এবং ধীরে ধীরে সেটি কোন দিকে যাবে?
উত্তর : মস্তিষ্কের টিউমার হলে প্রথমে মাথাব্যথা হয়। মাথাব্যথা তো সব মানুষেরই হয়। তবে মস্তিষ্কের টিউমার হলে যে মাথাব্যথা হয়, সেটি একটু অন্যরকম। ঘুম থেকে ওঠার পর প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। যত সময় যেতে থাকে, ব্যথা কিছুটা কমতে থাকে। মাথাব্যথার সঙ্গে তার বমি হয় অনেকবার, বেশি করে। বমি করার পর দেখা যায় মাথাব্যথা কিছুটা কমে যায়। সে সঙ্গে কিছু রোগী অভিযোগ করে, তারা চোখে ঝাপসা দেখছে। চোখের দৃষ্টি কমতে থাকে। মাথাব্যথার সঙ্গে যখন খিঁচুনি হয় অনেক রোগীর, তখন বুঝতে হবে এটা মস্তিষ্কের টিউমার হতে পারে। এ ছাড়া মস্তিষ্কের টিউমার যখন খুব বড় হয়ে যায়, তখন মানুষের একটি পাশ অবশ হয়ে যেতে পারে বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। কথা আটকে যেতে পারে। কথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের টিউমার হলে মাথার পানি বন্ধ হয়ে মাথা বড় হয়ে যেতে পারে এবং ঘাড়ের পেছনে বা মাথার পেছনে ব্যথা করতে পারে। এই জিনিসগুলো যদি হয়, তখন মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার একটি আশঙ্কা থাকে। তবে হবেই যে, এমন নয়।
প্রশ্ন : তাহলে কোন সময়টিতে আসলে বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : মস্তিষ্কের টিউমার যখন বাচ্চাদের হয়, তখন সে ভালো করে বুঝতে পারে না। একটি বড় মানুষ যেমন বলতে পারে তার মাথাব্যথা হচ্ছে, একটি বাচ্চা সেটা বলতে পারে না। তাই বাচ্চার সমস্যা হচ্ছে, বুঝতে হলে দেখতে হবে, সে হয়তো খেতে চাইছে না। একটা খেলনা দিলে নিচ্ছে না। তার একটি অসুস্থতা ভাব। সে সঙ্গে তার মাথার পেছন দিকটা ব্যথা করে। সেটা সে বলতে না পারলেও হাত দিয়ে দেখায়। সে সঙ্গে বাচ্চাদের প্রচলিত হচ্ছে বমি। ঘন ঘন সে হয়তো বমি করছে। বাচ্চারা এমনিতেই বমি করে। তবে যদি দেখা যায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ বারের বেশি বমি করে ফেলছে, সেই সঙ্গে খিঁচুনি হচ্ছে, তাহলে আমাদের অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে মস্তিষ্কের ভেতরে কোনো টিউমার হলো কি না।
প্রশ্ন : যখন এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসে, আপনারা রোগ নির্ণয়ে কী কী করতে দেন?
উত্তর : যখন আমরা ধারণা করি, মস্তিষ্কের টিউমার হতে পারে, তখন আমরা একটি পরীক্ষা দিই, যার নাম সিটি স্ক্যান। সিটি স্ক্যানটা খুব অল্প সময়ে করে ফেলা যায়। তবে সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা হচ্ছে এমআরআই। বাচ্চারা সাধারণত এমআরআই করতে চায় না। এ দুটো পরীক্ষা দিয়েই আমরা মস্তিষ্কের টিউমার নির্ণয় করি।
প্রশ্ন : এই দুটো পরীক্ষার নাম শুনলেই অনেকে আতঙ্কিত হয়ে যান। এ বিষয়ে কিছু বলুন?
উত্তর : যেহেতু মস্তিষ্কের পরীক্ষা দিচ্ছি, তাই রোগীরা হয়তো মনে করে তার বড় কিছু হয়ে গেছে। এই জন্য সে আতঙ্কিত বোধ করে। আর এই জন্যই হয়তো চিকিৎসক পরীক্ষা দুটো দিয়েছেন। আর পরীক্ষা দুটো একটু ব্যয়বহুলও। আমরা যখন ক্লিনিক্যালি রোগীকে দেখে মনে করি তার এ রকম কিছু হতে পারে, তখনই পরীক্ষা দিই।
প্রশ্ন : যখন আপনারা নিশ্চিত হোন শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটি মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত হয়েছে, তখন আপনারা প্রথমে কী ব্যবস্থাপনা দেন? এবং সেটি নির্ভর করে কিসের ওপর?
উত্তর : মস্তিষ্কের টিউমার যখন হয়ে যায়, তার চিকিৎসা সার্জিক্যাল। এটা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেই সারাতে হয়। রোগী বলেন, ডাক্তার সাহেব, ওষুধে ভালো করে দেন। আসলে এমন কোনো ওষুধ নেই, যেটি মস্তিষ্কের টিউমার হয়ে গেলে একে ভালো করে দিতে পারবে। তাই এর চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচার করে টিউমার বের করে দিয়ে আমাদের তখন হিস্টোপ্যাথলজি করতে হয়। এটা কি ভালো টিউমার, বেনাইন? নাকি খারাপ টিউমার, ম্যালিগনেন্ট বা ক্যানসার? এসব বুঝতে হয়।
প্রশ্ন : রোগীর মস্তিষ্কে টিউমার হয়েছে—এ কথা শোনার পর সে যথেষ্টভাবে ভেঙে পড়ে এবং তার মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ে। কীভাবে সে ক্ষেত্রে তাকে আশ্বস্ত করেন?
উত্তর : মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার মানেই মৃত্যু নয়। মস্তিষ্কের টিউমার যদি প্রাথমিক অবস্থায় আমরা নির্ণয় করতে পারি, একে পুরোপুরি বের করে দিলে এবং এর মধ্যে যদি ক্যানসার না থাকে, রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। আমরা এ রকম অনেক অস্ত্রোপচার করেছি। এতে রোগী সম্পূর্ণ ভালো আছে। আর যদি মস্তিষ্কের ভেতর ক্যানসারও থাকে, প্রথম কাজ হচ্ছে একে প্রাথমিকভাবে বের করে ফেলা। বের করে ফেলার পর যদি ক্যানসার থাকে, তখন রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দিয়ে সেটি যাতে ছড়াতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়। তবে মস্তিষ্কের টিউমার হওয়া মানেই মৃত্যু বা খুব আতঙ্কের বিষয়, তা কিন্তু নয়। এর চিকিৎসা আমাদের দেশে খুব ভালোভাবেই হচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, পুরোপুরি বের করে আনলে এবং প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা হলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। অস্ত্রোপচারের পর আপনারা ফলোআপে কখন আসতে বলেন?
উত্তর : মস্তিষ্কের টিউমার অস্ত্রোপচারের পর রোগীকে ফলোআপেই রাখি। কারণ, যখন মস্তিষ্কের টিউমারকে বের করে নিয়ে আসা হয়, তখন যেহেতু মস্তিষ্কের ভেতর ছোট একটু কেটে বের করতে হয়, এতে খিঁচুনি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা খিঁচুনির জন্য একটি অ্যান্টিকনভালসন ড্রাগ তাকে নিয়মিত দিয়ে যাই। সে সঙ্গে রোগীকে ফলোআপে থাকতে বলি। যদি ভালো টিউমার হয়, তখন বেশি দিন ফলোআপ করি না। দুই থেকে তিন মাস ফলোআপ করলে হয়। তবে যদি এখানে ক্যানসার থাকে, তবে তাকে ছয় মাস, এক বছর, দুই বছর ফলোআপ করে দেখি আবার কোনো টিউমার সেখানে হচ্ছে কি না। যদি আবারো হয়ে যায়, তবে আবারো সার্জারি করে তা ফেলে দিই। সে সঙ্গে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি চলে।
প্রশ্ন : এ ধরনের সার্জারির পর কী ধরনের পরামর্শ থাকে রোগীদের ক্ষেত্রে?
উত্তর : মস্তিষ্কের টিউমার অস্ত্রোপচারের পর আমরা আসলে খিঁচুনি না হওয়ার ওষুধ দিই। এ জন্য যারা আসলে খিঁচুনি না হওয়ার ওষুধ খায়, তাদের একটু ঘুম বেশি হয়, ঝিমঝিম ভাব থাকে। তাদের বলি, গাড়ি চালানো যাবে না। কারণ, গাড়ি চালাতে গেলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। আমরা রোগীদের বলি না যে আপনাকে এই জিনিসটি এড়িয়ে যেতে হবে বা ওই জিনিসটি এড়িয়ে যেতে হবে। শুধু গাড়ি চালানো যাবে না, কখনোই নয়। এ ছাড়া সে সুস্থভাবে জীবনযাপন করবে। তার আমরা মাথার অস্ত্রোপচার করে মাথার খুলি যে লাগিয়ে দিই, সেটা আবার সম্পূর্ণভাবে জোড়া লেগে যায়। বাইরে থেকেই বোঝাই যায় না।