শীতে কীভাবে শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণ করবেন

শীতে শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো সাধারণত বেড়ে যায়। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট। এই সময়েই কেন শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় আর এটি নিয়ন্ত্রণে শীতের আগে প্রস্তুতি কী হবে- এ বিষয়ে কথা বলেছেন এম এইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ। আজ ২৫ নভেম্বর এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২২১৬তম পর্বে এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়।
urgentPhoto
প্রশ্ন : ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের রোগের মধ্যেও কিছু কিছু রোগ বেড়ে যায়। কোন রোগগুলো বেড়ে যায়?
উত্তর : শীত আসি আসি করছে। কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো শীত পড়ে যাবে। এই সময়ে আবহাওয়ার একটি তারতম্য হচ্ছে। এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগ, শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জিজনিত রোগ- এসবের প্রকোপ খুব বেশি হয়। কারণ দেখা যাচ্ছে, ঢাকা মহানগন বলুন বা বিভিন্ন বিভাগীয় মহানগর, সবখানেই বাতাস এত দূষিত হয়ে গেছে যে কার্বনমনোক্সাইড, ভাসমান বস্তুকণা বা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে সবটাই। আমরা তো একটু ভালো করে শ্বাসও নিতে পারি না। পরিচ্ছন্ন বা স্বাস্থ্যকর শ্বাস আমরা নিতে পারি না। সেজন্য বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটছে এই সময়ে।
প্রশ্ন : রোগীদের এই সময়ে কী ধরনের সমস্যা বাড়ে?
উত্তর : আমি বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখি যে, এই সময়ে শ্বাসকষ্টের রোগীরা বেশি আসে। অনেক কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তার মধ্যে হাঁপানি একটি, যাকে আমরা ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বলি। এ ছাড়া সিওপিডি রয়েছে। ফুসফুসের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে নিউমোনিয়া রোগীরা আর আগের চেহারা নিয়ে আসে না। নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলে। এরপর রয়েছে গলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ তার মধ্যে সংক্রমণ। যেমন ফেরিনজাইটিস হতে পারে, লেরিনজাইটিস হতে পারে, ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। এ ছাড়া শিশুরা দেখা যাচ্ছে এই সময়ে বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ব্রঙ্কিউলাইটিস হচ্ছে। শিশু মৃত্যুর একটি বড় কারণ এটি। দেখা যাচ্ছে প্রচুর শিশু হাঁপানিতে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। হাঁপানির সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়। প্রচুর শিশু হাঁপানিতে ভুগছে।
আপনি বলেছেন লক্ষণ ভিত্তিক আলোচনা করতে। হাঁপানির কথায় আসি। হাঁপানি সব থেকে পুরোনো দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। এটি পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। এর মূল সমস্যা হচ্ছে শ্বাস ফেলতে কষ্ট হবে। নিতে মোটামুটি পারছে। তবে ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। রোগীর মনে হচ্ছে বুকটা একেবারে আঁটসাট হয়ে আছে। চেপে ধরে আছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, কাশি আছে। সেইসাথে দূর থেকে একটা শাঁ শাঁ আওয়াজ পাওয়া যায়। এগুলো হলো লক্ষণ। এর সঙ্গে ধূমপানের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এটা প্রধানত অ্যালার্জিজনিত কারণে হয়। এই যেমন শীত আসছে, গত বছরের বাক্স বন্দি করা কাপড়, সেগুলো আবার না ধুয়ে, না লন্ড্রিতে দিয়ে সরাসরি আমরা পরছি। সারাবছর সেগুলোতে মাইট বলে এক ধরনের অণুজীব বাস করে। এটি খালি চোখে দেখা যায় না। সারা বছর এটি বংশ বিস্তার করে। যেই মাত্র ব্যক্তি সোয়েটারটা পরল বা গরম কাপড় পরল সেই মাইট তার নাক দিয়ে শ্বাসতন্ত্রে ঢুকছে। অনেক ধরনের অ্যালার্জি আছে। যেকোনো কারণে অ্যালার্জি যদি শ্বাসতন্ত্রে ঢোকে একটি অতিস্পর্শকাতরতা তৈরি হয়। অতি সংবেদনশীলতা তৈরি হয়। তখন শ্বাসনালিগুলোতে খিঁচুনি হয়। তখনই শ্বাসকষ্ট হয়। ওই কাপড় পরলে তাৎক্ষণিক হাঁচি, কাশি হতে থাকবে। অনেক সময় দেখা যায় চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, লাল হয়ে যাচ্ছে, শরীর চুলকাচ্ছে- এগুলো সব অ্যালার্জির লক্ষণ। হাঁপানি হলো অ্যালার্জির একটি বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া শীত আসছে, ফুলের পরাগরেণু বাতাসে ভাসছে। বিভিন্ন ধুলা হচ্ছে। আবার অনেকে বাসায় পোষা প্রাণী রাখেন- যেমন কুকুর, বিড়াল। অনেক শিশু এমন খেলনা দিয়ে খেলে যেগুলো পশমে ভর্তি। এগুলোর মধ্যেও মাইট বাস করে। এই কুকুর-বিড়ালের লোমও শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে ক্ষতি করতে পারে।
এ ছাড়া এই শীতকালে সিগারেট খাওয়ার একটি মহোৎসব শুরু হয়ে যায়। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, সিগারেট খাওয়া যাবে না। কারণ সিগারেট থেকে অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যদিও হাঁপানির সঙ্গে সিগারেটের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। তবুও যাদের হাঁপানি হচ্ছে সিগারেট খেলে দেখা যায় তাদের অস্বস্তি হচ্ছে, কাশি বাড়ছে।
হাঁপানির আরেকটি বিষয় রয়েছে। দেখা যাচ্ছে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না তবে কাশি লেগে থাকছে। এখন আমরা কীভাবে বুঝব তার হাঁপানি হচ্ছে? একে বলে কফ ভেরিয়েন্ট অ্যাজমা। অ্যাজমার একটি ধরন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না, তবে কাশি হচ্ছে। আমরা যদি কিছু পরীক্ষা করি। তখন দেখা যায়, তার ফুসফুসে বাধা আছে। এটা হচ্ছে কফ ভেরিয়েন্ট অ্যাজমা। সব কিছুর জন্য অ্যালার্জি হচ্ছে এ্কটি বড় কারণ। আবার কিছু কিছু হাঁপানি রয়েছে নন এটোইবিক অ্যাজমা। এগুলো অ্যালার্জির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এগুলো দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দুর্ভাবনা, বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যা, উৎকণ্ঠা। হয়তো দেখা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করছে। নারীরা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন। চল্লিশোর্ধ্ব কোনো নারী, হঠাৎ করে তার হয়তো শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে, হাঁপানি হচ্ছে। এগুলো অ্যালর্জির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যদি কাউন্সেলিং ( পরামর্শ) করি ভালোমতো, রোগীকে বুঝাই, মানসিক চাপ কমানোর ওষুধ দেই, তাহলে এটি ভালো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : কোল্ড অ্যালার্জির কারণে কী কী সমস্যা বাড়ে?
উত্তর : শীত নিজেই একটি অ্যালার্জি। দেখা যাচ্ছে একদম ছোট বাচ্চা এবং একজন বয়স্ক, যখন শীত একটু বেড়ে যায় বা কুয়াশা পড়ছে তার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। তাই ঠাণ্ডা নিজেই একটি অ্যালার্জি হিসেবে কাজ করে। দেখা যায় খুব গরমও একটি অ্যালার্জি হিসেবে কাজ করে। ঘাম হয়ে শ্বাসকষ্ট হয়। অনেকের দেখা যায় গরমকালে শ্বাসকষ্ট হয়। শীতকালে হয়তো সে ভালো থাকে। তবে শীতকালেই রোগীদের শ্বাসকষ্ট প্রচণ্ড পরিমাণে বেড়ে যায়। আর এমনিতেও অ্যাজমার রোগীদের শ্বাসতন্ত্রটাই সংবেনশীল। একটা খাবার থেকেই হয়তো তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য যদি কারো গরুর মাংসের প্রতি অ্যালার্জি না থাকে বা বেগুনের প্রতি অ্যালার্জি না থাকে, তার আবার সমস্যা হবে না। এগুলো খাদ্যের অ্যালার্জি। অনেকের দেখা যায় ওষুধের প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে। যেমন একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগী বা একজন প্যালপিটেশনের রোগীকে যদি বিটা ব্লকার দেওয়া হয়, হাঁপানি পরীক্ষা না করে তখন দেখা যাবে তার শ্বাসকষ্ট অনেক বেড়ে গেছে।
প্রশ্ন : শীতের সময় যারা শ্বাসকষ্টের রোগী, তাদের জন্য প্রস্তুতি কী হওয়া উচিত? কী করতে হবে এই প্রকোপ যাতে না বাড়ে?
উত্তর : একজন হাঁপানি রোগী যাতে শীতকালকে উপভোগ করতে পারে, তার উচিত গরম কাপড় এখনই বাক্স থেকে বের করে লন্ড্রিতে দিয়ে দেওয়া। কিংবা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ভালো করে রোদ্রে শুকিয়ে নিলেও হয়। ভালো করে আয়রন করে নিতে হবে যাতে মাইট না থাকে। ঘরে কার্পেট রাখবেন না। কাপের্টের মধ্যে মাইট বাড়ে। আর ঘর ঝাড়ু না দিয়ে মুছে ফেলবেন। অনেকে রয়েছে যাদের ঝুল ঝাড়ার অভ্যাস আছে, ঝুল ঝাড়বেন না। এখানেও মাইট বাস করে। এগুলো থেকে সাবধান হতে হবে। যাদের অ্যাজমা নেই তাদের দিয়ে ঝুল পরিষ্কার করাতে হবে। যাদের অ্যাজমা আছে তারা ঝুল পরিষ্কার করার অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা পর ঘরে ঢুকবে। জোরে ফ্যান ছেড়ে দেবে। যাতে করে মাইটগুলো চলে যায়। সূর্যের আলো যাতে ঘরে প্রবেশ করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘরের ধুলো বাইরের ধুলো থেকে বেশি খারাপ। ঘরের ধুলো বংশ বিস্তার করে। তবে রোদে মাইট মরে যায়।
অনেকের মধ্যে ইনহেলার ভীতি আছে। এটি কিন্তু খুবই একটি কার্যকরী প্রযুক্তি। এর মধ্যে ওষুধ আছে যা তাৎক্ষণিক কাজ করে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম, দামও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই ইনহেলার দিয়ে চিকিৎসা করাটাই হাঁপানির জন্য শ্রেয়।