নেত্রনালির সমস্যা ও প্রতিকার

Looks like you've blocked notifications!

চোখের নেত্রনালির সমস্যা একটি বড় সমস্যা। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আজ এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২২২৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বজলুল বারি।

urgentPhoto

প্রশ্ন : নেত্রনালির অবস্থান চোখের কোন দিকে এবং এর কাজ কী? এটি গুরুত্ব্পূর্ণ কেন?

উত্তর : নেত্রনালি কথাটির মধ্যেই এর অর্থ নিহিত আছে। চোখের মধ্যে যে পানি থাকে সেটির প্রবাহের জন্য একটি রাস্তা দরকার। আমাদের চোখ থেকে প্রতিনিয়ত পানি তৈরি হচ্ছে এবং সেটি চোখের কিছু কাজ কর্ম করে একটি নালি পথে নাকের মধ্যে চলে যায়। এটি এত অল্প পরিমাণে চলে যায় যে আমরা টেরই পাই না। কোনো কারণে ওখানে যখন নেত্রনালিটি বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমরা দেখি চোখের মধ্য থেকে প্রতিনিয়ত পানি ঝরছে। আরেকটি বিষয় খেয়াল করবেন, আমরা যখন কাউকে কাঁদতে দেখি বা আমরা যখন কাঁদি তখন নেত্রনালি তার ধারণ ক্ষমতার বেশি পানি উৎপন্ন হয় বলে সেটাকে বের করতে পারে না। সে কারণে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যখন মানুষ কাঁদে, রুমাল বা টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে, তখন নাকও মুছে। কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রবাহ, তখন চোখ দিয়েও বের হচ্ছে, নাক দিয়েও বের হচ্ছে। অর্থাৎ, চোখের সাথে নাকের যোগাযোগের জন্য যে নালীটা সেটাকে আমরা বলি নেত্রনালি।

প্রশ্ন : নেত্রনালি কোনো কারণে ব্লক হয়ে গেলে কী সমস্যা হতে পারে এবং এই ব্লক হওয়ার কারণ কী?

উত্তর : সহজভাবে বলি, ঢাকা শহরের সুয়ারেজ লাইন যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কী সমস্যা হতে পারে? সবকিছু উপচে উঠবে। রাস্তাঘাট ডুবে যাবে, নোংরা পানিতে ভরে যাবে। আপনার চলাচল, জীবন যাপন অসহনীয় হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনি চোখের ময়লা ও আবর্জনাগুলো চোখের মধ্য দিয়ে, নাকের মধ্য দিয়ে বের হয়ে যায়। একে আমরা টের পাই না। কোনো কারণে নালিটি বন্ধ হয়ে গেলে এই প্রতিদিনকার ময়লাগুলোসহ আমাদের চোখ দিয়ে এটা বাইরে দিয়ে আসবে। তখন দেখবেন চোখে পিঁচুটি জমে আছে। চোখ ভেজা আছে এবং ময়লা ও আবর্জনায় ভরে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। একই সাথে এই চোখের আবর্জনার মধ্যে যদি থেমে যায়, তাহলে ওখানে কিছু জীবাণু জন্মায়। তখন জীবাণুগুলো সংক্রমণ করে। আমরা যদি ছবিতে দেখি, এই মানুষটির চোখের দিকে নাকের কাছে, নাকের গোড়ায়, প্রদাহ হয়ে আছে বা ফুলে গেছে; তখন বুঝি এটা নেত্রনালির কারণে হয়েছে। নেত্রনালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এখানে জীবাণু জন্মে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটা থেকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এই সংক্রমণ মস্তিস্ক পর্যন্ত চলে গিয়ে রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

প্রশ্ন : এর মানে চিকিৎসা খুব জরুরি?

উত্তর : চিকিৎসা অবশ্যই জরুরি। রোগীরা নিজেরাই দৌড়ে চিকিৎসকের কাছে চলে আসবে। কারণ তার এতই কষ্ট হয়, যেটা কাউকে বোঝানোও কঠিন পড়ে।

প্রশ্ন : চিকিৎসার ক্ষেত্রে আপনারা কী করে থাকেন?

উত্তর : আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করি। যেমন শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় জন্মগতভাবে নেত্রনালি বন্ধ থাকে। তখন এক বছর পর্যন্ত আমরা একটা চোখের কোণে আঙুল দিয়ে মায়েদের ম্যাসাজ করতে বলি। এক বছরের মধ্যে যদি ভালো হয়ে যায়, তাহলে ভালো। আর যদি না হয় এক বছর পর বাচ্চাকে একটু অজ্ঞান করে এই নালি আমরা খুলে দেই। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫ ভাগ বাচ্চা ভালো হয়ে যায়। বড়দের বেলায় যদি এটা বন্ধ হয়, এটা সাধারণত খুলে দিতে হয় না। তখন অস্ত্রোপচার করতে হয়। এই পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে অস্ত্রোপচারের বেলায় নাকের এবং চোখের মাঝখানে কেটে চ্যানেল তৈরি করতে হয়, যেটা কৃত্রিম চ্যানেল। এতে একটা সমস্যা হয়। অনেকেরই নাকের এবং চোখের মাঝে কালো দাগ পড়ে যায়। এটা তখন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয় না। সারা জীবনই সে এই কষ্ট নিয়ে থাকে। আরো কারো কারো ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালোভাবে অস্ত্রোপচার করলেও ১০ ভাগ জায়গায় এটি সফল হয় না।

প্রশ্ন : সেক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি কী?

উত্তর : বিকল্প হিসেবে একটি ভালো জিনিস এসেছে। ২০০৭ সালে আমিই প্রথম বাংলাদেশে এটি চালু করি। সেটা  হচ্ছে লেজারের মাধ্যমে চিকিৎসা। অর্থাৎ বাইরের চামড়া, হাড়, মাংস কোনো কিছু না কেটে স্বাভাবিক যে রাস্তাটা ছিল, লেজার বিমের মাধ্যমে এর একটি চ্যানেল তৈরি করে দেওয়া। তাহলে বাইরের কোনো সমস্যা হলো না। এটা সব ক্ষেত্রেই করা যায়। মধ্য বয়সী, ছোট, অতিবৃদ্ধ- যাদের নাকের সমস্যা থাকলে অস্ত্রোপচার করা যায় না, তাদের ক্ষেত্রেও করা যায়। এটি একটি আধুনিক পদ্ধতি। একে আমরা বলি লেজার ডিসিআর।

প্রশ্ন : এটি কীভাবে করেন, যদি একটু দেখাতেন আমাদের?

উত্তর : ছবিটি নাকের ভেতরে। খেয়াল করবেন একটি লেজার বিম আসছে। ছিদ্র করে ওখানে আমরা একটা সিলিকন টিউব বা সিলিকন নালি বসিয়ে দেই। সাথে আমার একটি আবিষ্কার আছে এই বিষয়ে, প্রায় ছয় সাত বছর কাজ করার পর জিনিসটি আবিষ্কার করেছি, ওই জায়গাতে বসিয়ে দেই। বসিয়ে দেওয়ার পর একটি সময় খুলে নিয়ে এলে যে চ্যানেলটা করে দিলাম, সেটা স্বাভাবিক পর্যায়ের মতো কাজ করে। খেয়াল করুন, এখানে কোনো রক্তপাত নেই। আর কেটে অস্ত্রোপচার করার আমাদের যে স্বাভাবিক পদ্ধতি সারা বিশ্বে যে পদ্ধতি- এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো,  প্রচুর রক্তপাত হতে পারে। অস্ত্রোপচারের সময় তো রক্তপাত হতেই পারে, এরপরও তিনদিন পর্যন্ত ভীষণ রকমের রক্তপাত হতে পারে।

তবে এই পদ্ধতিতে রক্তপাত একেবারে নেই বললেই চলে। সিলিকন টিউব বা নালীটা বের করার পরে একটা চ্যানেল হয়ে গেল এবং সেটা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে এই পানির প্রবাহ চলে গেল।  বাইরে দিয়ে কাটাকাটির কোনো বিষয় থাকল না। এই ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক চ্যানেলের মতোই হয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন : যদি একজন মানুষ এই অস্ত্রোপচার না করান, তাহলে তার আরো গুরুতর জটিলতার আশঙ্কা আছে কী?

উত্তর : নেত্রনালির সমস্যা হলে মানুষ চোখে কম দেখে, তা নয়। অনেকে এটা মেনে নিয়ে থাকে। চোখে পানি মুছে ফেলে, ভয়টা হলো সংক্রমণ যদি হয়ে যায়, জীবাণু জন্মে ওখানে যদি সংক্রমণ করে তাহলে ওই সংক্রমণটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যেমন চোখের কর্নিয়াকে সে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কর্নিয়ার ক্ষতি করে সে এটাকে অন্ধ করে দিতে পারে। এ রকম অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। দ্বিতীয়ত যদি রোগীর ডায়াবেটিস থাকে, যদি সে স্টেরয়েড জাতীয় ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ খায়, তাহলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তখন সেখান থেকে দ্রুত সংক্রমণটা চোখের ভেতরে বাইরে, মস্তিষ্কে পর্যন্ত চলে যায়। এতে জীবনের ঝুঁকি চলে আসে।