শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ সিওপিডি রোধে কী করবেন

Looks like you've blocked notifications!

সিওপিডি শ্বাসতন্ত্রের একটি জটিল রোগ। এই রোগে রোগীকে ভীষণভাবে শ্বাসকষ্টে ভুগতে দেখা যায়। আজ ১৬ ডিসেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৩৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপাইরেটোরি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ।

প্রশ্ন : সিওপিডি মানে কী?

উত্তর : সিওপিডির পুরো নাম ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। এটা হচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের একটি সমস্যা। সেখানে শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় এবং একে ঠিক করা যায় না। কেন বললাম ঠিক করা যায় না, অ্যাজমা বা হাঁপানির একজন রোগীর ওষুধ খেলে আগের মতো শ্বাসকষ্ট বিহীন হয়ে যায়। তবে সিওপিডি রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় সে শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ভুগতে ভুগতে এটা আর ভালো হয় না। আস্তে আস্তে খারাপের দিকে চলে যায়। আস্তে আস্তে কবরের দিকে হাঁটছে। সমগ্র বিশ্বের মৃত্যু হারের অন্যতম কারণ হচ্ছে সিওপিডি। ১৯৯০ সালের হিসাব মতে এর অবস্থান ছিল ষষ্ঠতম। আশঙ্কা করা যাচ্ছে, ২০২০ সালে এর অবস্থান এসে দাঁড়াবে তৃতীয়তে। তাহলে চিন্তা করেন কত ভয়ঙ্কর একটি সমস্যা। সিওপিডি একটি জটিল রোগ; যেটা জিনগত, পরিবেশগত এবং আচরণগত কারণে হয়। কারো যদি জিনগত এই সমস্যা থাকে তাহলে তারও হতে পারে। আচরণগত এজন্য বললাম, কেউ যদি ধূমপান করে তাহলে হতে পারে। আর পরিবেশগত হলো, এমন একটি পরিবেশে সে কাজ করছে যে ধুলিময়, গাড়ির কালোধোঁয়া আসছে, বায়ু দূষণ হচ্ছে- এমন অবস্থায় হতে পারে। একটি লোক যদি প্রতিদিন কমপক্ষে ২০টি করে সিগারেট অনেক বছর ধরে খেয়ে যায়, তাহলে তার সিওপিডিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া নিম্ন আর্থ সামাজিক অবস্থান এবং পুষ্টিও এ বিষয়ে বড় কারণ।

প্রশ্ন : আমাদের যখন কাশি বা শ্বাসকষ্ট হয়, সাধারণ অর্থে আমরা ধরে নেই অ্যাজমা হয়েছে। সিওপিডি থেকে অ্যাজমাকে আলাদা করার উপায় কী?

উত্তর : আমাদের কাছে যখন রোগী আসে, সিওপিডিতে আক্রান্ত রোগী বলেন, আমি অ্যাজমায় আক্রান্ত। সিওপিডি একটি রোগ। হাঁপানি আরেকটি রোগ। সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। সিওপিডি প্রধাণত ধূমপানের জন্য দায়ী। তবে অ্যাজমার সঙ্গে ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। সিওপিডির সঙ্গে অ্যালার্জির কোনো সম্পর্ক নেই। অ্যাজমার অ্যালার্জির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।  সিওপিডি মধ্য বয়সের একটি রোগ। মধ্যবয়সে এটি দৃশ্যমান হয়। তবে অ্যাজমা যেকোনো সময়, যেকোনো মানুষের হতে পারে। ইনহেলার দিলে, সালবিউটামল জাতীয় ওষুধ খেলে সে ভালো হয়ে যায়। তবে সিওপিডি রোগীর বেলায় এগুলো দিলে ভালো হয় না। সিওপিডিতে বংশগত ধারার খুব একটা ইতিহাস থাকছে না, যেটা অ্যাজমাতে থাকছে। এগুলো হচ্ছে পার্থক্য। এর চিকিৎসাও সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন, স্টেরয়েড সিওপিডিতে ভালো কাজ করে না, যেটি অ্যাজমাতে ভালো কাজ করে। বেশির ভাগ সময় কোলিন-বিরোধী যে ইনহেলার, সেগুলো ব্যবহার করা হয়। আসলে সিওপিডি রোগের চিকিৎসার ধরন এবং কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই রোগে রোগী শ্বাস কষ্টে ভুগছে। এমন শ্বাসকষ্ট যে একটু টয়লেটে যাবে সেটিও পারছে না। এতে লোকটা কোনো কাজ করতে পারছে না। এতে আমাদের জাতীয় ক্ষতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষতি। আমরা চাই না একটি মানুষও সিওপিডিতে আক্রান্ত হোক। কারণ রোগটি কিন্তু তার হাতেই নির্ভর করে। আমি ধূমপান করব না; আমি সিওপিডিতে আক্রান্ত হবো না, যদি সুন্দর পরিবেশে বাস করি।  

প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, সিওপিডি একবার হলে আমৃত্যু  তাকে ভুগতে হয়। তাহলে এটি থেকে বাঁচার উপায় কী?

উত্তর :  হ্যাঁ, আসলে জীবনমানকে তো বাড়াতে হবে। সেজন্য আমরা বলি, যখনই ধূমপান বন্ধ করতে বলি, বন্ধ করে দেন। যা খেয়েছেন, সেটা খেয়েছেন, তবে এখন বন্ধ করে দেন। এতে কিছুটা হলেও উপকার হবে।

আর শীতে দেখা যায় যে, হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোকক্কাস – এই দুটি জীবাণু দিয়ে ফুসফুস, শ্বাসনালি আক্রান্ত হচ্ছে এবং সিওপিডি রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কফ পেকে যাচ্ছে, কফ হলুদ হয়ে যাচ্ছে। জ্বর হচ্ছে, কফের সঙ্গে একটু রক্ত যেতে পারে। এখন ভ্যাকসিন বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায়, নিউমোকক্কাসের বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিন তিন বছর পরপর নিতে হয় এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন প্রতিবছর একটি করে নিতে হয়। পাশাপাশি তাকে একটি সুন্দর পরিবেশে রাখতে হবে। এমন পরিবেশে রাখতে হবে যেখানে খুব বেশি ঠান্ডা থাকবে না, ঠান্ডা থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে, সিওপিডি রোগীরা বেশি আক্রান্ত হয়। আর পরিবেশটা স্বচ্ছ থাকতে হবে, সুন্দর থাকতে হবে। খোলামেলা বাতাস থাকতে হবে। তাহলে একজন সিওপিডি রোগী কিছুটা হলেও ভালো থাকবে। এ ছাড়া ওষুধ যেগুলো আমরা দেই সেগুলো ব্যবহার করলে রোগী কিছুটা ভালো থাকবে।

প্রশ্ন : একজন মানুষ এসব নিয়মকানুন মানলেন, তাহলে কী বলা যায়, বাকি জীবন তিনি এই কষ্ট থেকে কিছুটা মুক্ত থাকবেন?

উত্তর : কিছুটা হলেও তো কষ্ট থেকে মুক্ত থাকবেন। আমি বলেছি এটি পুরোপুরি সেরে যায় না। হাঁপানি রোগীর মতো একেবারে ভালো হয়ে যাচ্ছে, ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে সেটি তো হচ্ছে না। তবে আমরা জীবনের মানকে বাড়ানোর চেষ্টা করছি। সিওপিডিতে আমাদের দেশের চেয়ে বিদেশের লোকেরা বেশি ভুগছে। বিশেষ করে ব্রিটেনে। আমাদের দেশের আবহাওয়া খুব সুন্দর। তবে পরিবেশ দূষণটা খারাপ। দিন দিন এটি ভয়ঙ্কর অবস্থা ধারণ করছে। এ ছাড়া আমরা অনেক কিছুর নিয়ম মানি না। যেখানে সেখানে ধূমপান করছি। আমি হয়তো ধূমপান করি না, তবে পাশে একজন করছে। সেই ধোঁয়াগুলো তো আমার ফুসফুসে ঢুকছে। আমরা যদি নিয়ম মানি তবে আমাদের দেশের মতো সুন্দর আবহাওয়া পৃথিবীর কোনো দেশে পাওয়া যাবে না। তবে জনসংখ্যার আধিক্য, পরিবেশ দূষণ, সচেতনতার অভাব— এসবের কারণে আমরা নিজেরাই পরিবেশকে দূষণ করছি। পরিবেশ দূষণ একটি অন্যতম কারণ সিওপিডি হওয়ার। আরেকটি কারণ রয়েছে, আমাদের অনেক মা-বোনেরা ঘরে লাকড়ির চুলা দিয়ে রান্না করে। এর কারণেও সিওপিডিতে আক্রান্ত হতে পারে। লাকড়ি এড়িয়ে অন্য কিছু দিয়ে রান্না করার চেষ্টা করুন। সে অন্য চুলায় রান্না করলে তো এসব সমস্যা হচ্ছে না।

প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন সিওপিডিতে টিকা বা ভ্যাকসিন কাজে আসে। এটি কি যেকোনো বয়সে নিতে পারবে? কতদিন পরপর নিতে হবে? এর খরচ কেমন?

উত্তর : খুব বেশি খরচ নেই। নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন তিন বছর পরপর নিতে হয়। দাম খুব বেশি নয়। আগে যখন বিদেশ থেকে আনাতাম রোগীদের জন্য, তখন অনেক টাকা খরচ হতো। এখন বাংলাদেশের বাজারে এটা পুরোপুরি পাওয়া যায়। আমাদের বাংলাদেশের বাজারে এখন অনেক ভালো ওষুধ এসে গেছে।

প্রশ্ন : সিওপিডির জন্য একটি বড় কারণ ধূমপান।  যে ধূমপান করবে  শুধু সে-ই কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? নাকি যিনি ধূমপান করছেন না, তবে পাশে থাকছেন, তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ বিষয়ে একটু বলেন?

উত্তর : যিনি অনেক বছর ধরে প্রতিদিন ধূমপান করছেন তিনি তো সিওপিডিতে আক্রান্ত হবেনই, তবে যদি কেউ পাশে বসে ধূমপান করেন, তাহলে যে ধূমপান করছেন না তিনিও আক্রান্ত হবেন। তিনি পাঁচভাগ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, শুধু ধূমপায়ীর পাশে বসে থাকার জন্য। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ধূমপান শুরু করার ১৫ বছর পর হতে ধূমপানের হার ৩০ শতাংশ হয়ে যায়। যত দিন যত বেশি ধূমপান করবে, তার সিওপিডিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি। যত অল্প বয়স থেকে ধূমপান করছে, তার সিওপিডিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি এবং এটি মধ্য বয়সে এসে প্রকাশিত হবে। এ ছাড়া জিনগত কারণে সিওপিডিতে আক্রান্ত হয়। আর দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিবেশটা সুন্দর হতে হবে। বায়ু চলাচল ভালো হতে হবে। ধূমপান মুক্ত পরিবেশ হতে হবে। যেখানে সেখানে কফ ফেলবেন না। এই থুথু, কফগুলো শুকিয়ে বাতাসে মিশে আরেকজনকে আক্রান্ত করছে। যক্ষ্মা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। সুন্দর পরিবেশে থাকলে একজন মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত হবেন না এবং সুন্দর জীবন যাপন করতে  পারবেন।