হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ কী?
হার্ট অ্যাটাক একটি ভীতিকর বিষয়। যার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায় তাকে প্রায় সারাজীবনই বেশ সতর্কভাবে জীবনযাপন করতে হয়। আজ ১৬ জানুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৬৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : হার্ট অ্যাটাক বলতে কী বোঝায়?
উত্তর : হার্ট অ্যাটাক সত্যিই একটি বিশেষ রোগ। এই রোগটি আসলে সবার মধ্যে খুব ভীতি সঞ্চার করে থাকে। এর কারণ হলো হার্ট অ্যাটাক রোগে যারা মৃত্যুবরণ করে তাঁদের বেশির ভাগ লোকই কিন্তু প্রথম ঘণ্টার মধ্যে মারা যান।
তাই হার্ট অ্যাটাক সম্বন্ধে আমাদের একটি ব্যক্তিগত ধারণা থাকা দরকার। এর কারণ হলো, হার্ট অ্যাটাক যেই রোগীর হয় তাঁকে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে রোগীর পাশে যাঁরা থাকেন তাঁদের কিছু বিষয় জেনে রাখা দরকার। তাঁদের কিছু দায়িত্ব থাকে।
আমরা সবাই জানি হার্ট আমাদের সারা শরীরের রক্ত সঞ্চালন করে পাম্পের মাধ্যমে। যেহেতু হার্ট নিজে একটি পাম্প, তাকে কাজ করতে হয়, তাই তার নিজস্ব একটি রক্ত চলাচলের পদ্ধতি রয়েছে, রক্তনালি আছে। এই রক্তনালিগুলো মধ্যে কোনো একটি বা একের অধিক নালি যদি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হার্টের বেশ কিছু অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে গেলে হার্টের কাজ করার ক্ষমতাও বন্ধ হয়ে যায়। এটিই হলো হার্ট অ্যাটাক। মূলত, রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হার্টের কার্যক্ষমতা যে বন্ধ হয়ে গেল, সেটিই হলো হার্ট অ্যাটাক।urgentPhoto
প্রশ্ন : রোগীর কোন কোন লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?
উত্তর : সাধারণত দুইভাবে বিষয়টি হতে পারে। কোনো কোনো লোকের হয়তো আগে থেকে কিছু কিছু লক্ষণ থাকে। যেমন : অনেকের হয়তো পরিশ্রম করতে গিয়ে বুকে ব্যথা হতো, বিশ্রাম করলে তিনি ভালো থাকতেন। এভাবে কয়েক মাস বা কয়েক বছরও চলে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো লোকের ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই হার্টের রগটি বন্ধ হয়ে যায়।
আসলে আগে থেকে রোগ থাকুক বা না থাকুক যদি কোনো কারণে হঠাৎ করে হার্টের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, হার্টের রোগ হয়, একে সাধারণত হার্ট অ্যাটাক বলা হয়ে থাকে।
তবে যদি সামগ্রিকভাবে চিন্তা করি, হার্টের রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, এই সম্পূর্ণ রোগটিকে সাধারণত বলা হয়ে থাকে, ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ। যেহেতু এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি এবং রোগটি ভয়াভহ, সেক্ষেত্রে সাধারণভাবে হৃদরোগ বলতে এই জিনিসকে বোঝানো হয়ে থাকে। যদিও এই জিনিসটির অন্য কারণও রয়েছে।
সাধারণত বুকে ব্যথা হওয়াটা সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ। হঠাৎ করে বুকটা ভীষণ চেপে ধরে। মনে হয় বুকটি ভেঙ্গে পড়ল। অনেক ওজন চেপে গেছে। এটা হয় শুরুতে এবং এর সাথে সাথে অনেকের শরীরে ঘাম হতে থাকে। পাশাপাশি অনেক সময় মাথা ঘুরতে থাকে, বমি হতে থাকে। আবার বমি নাও হতে পারে। তবে বুকে ব্যথা হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তার হয়তো আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো রোগ ছিল, সেখান থেকে হার্ট অ্যাটাক হলো। এগুলোই তার প্রধান উপসর্গ।
এই সময়ে আমাদের করণীয় কী? এ রকম হলে তাৎক্ষণিকভাবে কী করব? তাহলে এই ধরনের লক্ষণ যদি দেখা যায়, আপনি ৯০ ভাগ নিশ্চিত হতে পারেন এখানে হার্ট অ্যাটাকের প্রক্রিয়া চলছে। সেই সময় সঙ্গে সঙ্গে এসপিরিন ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। এটি ৩০০ মিলিগ্রামের পাওয়া যায়- এটি খেয়ে নিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।
এর কারণ প্রাথমিক চিকিৎসার মধ্যে প্রথম চিকিৎসা হলো, ব্যথাটাকে কমানো এবং সম্ভব হলে দ্রুত ইসিজি করে রোগ নির্ণয় করা। এর আরো একটি কারণ হলো, যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাবে তত তাড়াতাড়ি তার চিকিৎসা শুরু হবে। আর যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে, তত তাড়াতাড়ি হার্টের একটি বড় অংশ বাঁচানো সম্ভব হবে। বেশি অংশ ক্ষতি হওয়া থেকে বেঁচে গেলে হার্টটি মোটামুটিভাবে কাজ করতে পারবে- এটা হলো প্রধান উদ্দেশ্য দ্রুত রোগ নির্ণয় করার। এসপিরিন সম্ভব হলে খাওয়াতে হবে, খাওয়ানো যাক বা বা না যাক তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের পদক্ষেপগুলো কী থাকে?
উত্তর : হাসপাতালের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে নির্ভর করছে কোন হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছে এই বিষয়টি। এখানে সাধাণত আমরা দুটো বিষয় বলে থাকি, আমাদের দেশে যদিও এখনো অ্যাম্বুল্যান্স সার্ভিসটা অতটা প্রচলিত নয়, তবে অন্যান্য দেশে কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সেই চিকিৎসাটা শুরু হয়ে যায়। এমন এমন দেশ রয়েছে যেখানে অ্যাম্বুলেন্সেই এসপিরিন খাওয়ানোর পর ইসিজি করা হয়। ইসিজি করার পর যে হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে আগে খবর দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও আমাদের দেশে সবজায়গায় এটি করা সম্ভব নয়, তবে কিছু কিছু জায়গায় করা সম্ভব। রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথল্যাবে নিয়ে তার এনজিওগ্রাম করে দেখা, কোন জায়গায় ব্লক হয়েছে, না হয়নি। যদি সেই ব্লকটাকে তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক করে দেওয়া যায়, তাহলে ওই হার্টের ওই অংশটুকু নিরাপদ হয়ে গেল। তাহলে এদের ফলাফল খুব ভালো হয়। যদিও আমাদের দেশে এখনো এই সুযোগ নেই।
এখানে সাধারণত এক ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যেটি দিলে কিছু কিছু অংশ গলে যায় এবং সেখানে কিছু কিছু হৃদপিণ্ডের অংশ রক্ষা পায়। এটি হলো তার প্রাথমিক চিকিৎসা।
তবে এর সাথে সাথে তাকে যদি সাহায্যকারী চিকিৎসা করা হয়ে থাকে তাহলে ভালো হয়। অক্সিজেন দেওয়া, তার ব্যথা কমানো, তাকে বোঝানো এটা ঠিক হয়ে যাবে ইত্যাদি। পাশাপাশি তাকে সবসময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দেখতে হবে তার কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে কি না।
আসলে হওয়ার শুরুতেই কী করে চিকিৎসা করা যায় সেটি খেয়াল করতে হবে। এর কারণ হলো, হার্ট অ্যাটাকের রোগীর একটি নির্দিষ্ট অংশ এরিদমিয়া বা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের জন্য মারা যায়। সেটা যদি আমরা প্রথমেই পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পাই এবং প্রাথমিকভাবেই চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে সেখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। এটা হলো প্রাথমিক চিকিৎসা।
পরবর্তীকালে হাসপাতালে রেখে আনুষঙ্গিক চিকিৎসা করতে হবে। কেন হার্ট অ্যাটাক হলো সেই কারণগুলো বের করে নিয়ে আসা দরকার। এরপর তাকে পরামর্শ দিয়ে তারপর তাকে মুক্ত করতে হয় এবং তাকে ফলোআপ করার জন্য চেষ্টা করতে হয়।
পরবর্তীকালে তার জীবনযাপনের ধরন কী হবে, সেটি বলে দেওয়া হয়। যেহেতু তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, কাজেই তার শরীরে ওই সব উপাদান রয়েছে। হয়তো আগে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, হয়তো আগে সে সিগারেট খেত। শরীরে চর্বি বেশি ছিল, খাওয়া দাওয়া বেশি করত, বেশি ওজন ছিল- এসব জিনিস কমিয়ে পরবর্তীকালে হার্ট অ্যাটাক না হয় তার জন্য তাকে পরামর্শ দিতে হয়। নয়তো পরবর্তীকালে হার্ট অ্যাটাক হলে তার ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং হার্টের কার্যক্ষমতা আরো কমে যাবে। সেসব চিকিৎসা দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের ব্যাপারে কী করতে পারি?
উত্তর : এটি খুব জরুরি ব্যাপার। এর কারণ হলো, এটি কোনো জীবাণুঘটিত রোগ নয়। যেমন : কলেরা, টাইফয়েড- যেই জীবাণুঘটিত রোগ। আপনি জীবাণু শনাক্ত করলেন, জীবাণু ভালো হয়ে গেল-এখন আর ওষুধ দরকার নেই।
তবে এসব রোগে ওই ধরনের কোনো চিকিৎসা নেই। যেহেতু এই রোগের নিরাময় নেই, তাই একে প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এটা দেখা গেছে যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে যেটি হার্ট অ্যাটাককে তৈরি করতে সাহায্য করে। যেমন : কারো উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। যার অনেক বেশি ওজন, বেশি চলাফেরা করে না। অফিসে বসে বসে কাজ করে। কোলেস্টেরল বেশি। অথবা পারিবারিক ইতিহাস খুবই খারাপ। আগে মা-বাবা বা কারো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সুতরাং এই দলকে আমরা বলি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দল। তাদের শুরু থেকেই এই বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাকে ওষুধ খেয়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর যদি কারো ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ একসঙ্গে থাকে সেটি আরো বেশি ক্ষতিকর।
যাদের বেশি ওজন, তাদের কমিয়ে ফেলতে হবে। আর খাওয়ার বিষয়ে খুব খেয়াল রাখতে হবে। প্রাণীজ চর্বি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। তাহলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা যায়।
আমি সবসময় বলি যার পরিবারে হার্ট অ্যাটাক ছিল সে ভাগ্যবান। কারণ, সে জেনে ফেলেছে তারও এক সময় হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাকে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে। তাহলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে পারব। কারণ হার্ট অ্যাটাক মানে হলো হার্টের পেশির অংশ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া।
যদি হার্টের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, চিকিৎসা হওয়ার পর সে সুস্থ হয়ে উঠলেও ওই অংশটুকু কিন্তু নিরাময় হবে না। সুতরাং প্রতিরোধ করাটা সর্বোত্তম পদ্ধতি এবং আমাদের মতো গরিব দেশে তো এটা অবশ্যই দরকার। কারণ, হার্ট অ্যাটাক যার হয়ে গেল তার প্রতি মাসের চিকিৎসা তিন হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। একে সারাজীবনই এটি চালিয়ে যেতে হবে।