বিষণ্ণ লাগে কেন
‘বিষণ্ণতা একটি রোগ’-এ রকম একটি পোস্টার একসময় বিভিন্ন ওষুধের দোকানে প্রায়ই দেখা যেত। তখন এই প্রচারণা হাস্যরসের জোগান দিলেও এখন আমাদের জীবনে একটি করুণ বাস্তবতা। অনেকের ক্ষেত্রে এটি বিভীষিকার মতোই। আসুন জেনে নিই রোগটির ভেতরের কথা।
বিষণ্ণতা ও এর উপসর্গ
বিষণ্ণতা কী এবং এর উপসর্গ কেমন এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অভ্র দাশ ভৌমিক জানান, বিষণ্ণতা একটি প্রচলিত মানসিক রোগ। দীর্ঘদিন ধরে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যদি কারো মন খারাপ থাকে বা কষ্ট লাগার অনুভূতি হয় তবে তাকে বিষণ্ণতা বলা হয়।
অনেকদিন ধরে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা, কোনো কাজে আগ্রহ না পাওয়া, আনন্দের অনুভূতি কমে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া বা বেশি ঘুমানো, ঘুম ভেঙে মনে হওয়া আরেকটি খারাপ দিন শুরু হলো, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, কাজে মনোযোগের অভাব, অহেতুক কোনো কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ করা, ভালোবাসা বা যৌনতার অনুভূতি কমে যাওয়া, ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হওয়া, খাবার ইচ্ছা কমে যাওয়া বা খুব বেশি খেতে ইচ্ছে করা, শারীরিক কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে মাথাব্যথা থাকা- এগুলো বিষণ্ণতা রোগের উপসর্গ। কারো ক্ষেত্রে এর মধ্যে পাঁচটির অধিক উপসর্গ দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত বলে ধরে নিতে হবে।
কারণ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অভ্র দাশ ভৌমিক জানান, এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে মস্তিষ্কের সেরোটোনিন বা নিউরোটেন্স মিটারের তারতম্যের কারণে এ রোগ হয়। কারো বংশে থাকলেও হতে পারে। এ ছাড়া বিষণ্ণতা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কারণ থাকতে পারে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার জানান, কোনো ধরনের নিপীড়নের শিকার হলে, আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বঞ্চিত হলে, বিশেষ ধরনের ওষুধ সেবনের ফলে, মনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকলে, ঘনিষ্ঠ কারো মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থতা, জেনেটিক বা শারীরিক অসুস্থতা, বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব বা সামাজিক সহযোগিতার অভাব, বৈবাহিক সমস্যা বা সম্পর্কগত সমস্যা- এসবের ফলে বিষণ্ণতা হতে পারে।
বিষণ্ণতাকে চিকিৎসকরা সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করেন—মাইল্ড, মডারেট ও সিভিয়ার। বিষণ্ণতার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো আত্মহত্যার প্রবণতা। বিষণ্ণ রোগীদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লোক আত্মহত্যা করে। বলা হয়, হৃদরোগের বিভিন্ন অসুখে যত মানুষ মারা যায়, সে তুলনায় বিষণ্ণতায় মারা যায় বেশি। বিষণ্ণ রোগীর কর্মক্ষমতা দিন দিন কমে যায়। এতে আর্থিক, সামাজিক, মানসিক সবদিক থেকেই সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চিকিৎসা
মনোবিশেষজ্ঞ তুষার জানান, বিষণ্ণতার দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। বায়োলজিক্যাল বেজড থেরাপি এবং সাইকোলজিক্যাল বেজড থেরাপি। বায়োলজিক্যাল বেজড থেরাপিতেও আবার কয়েক প্রকার থেরাপি রয়েছে যেমন : শক থেরাপি, কনভালসিভ থেরাপি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে এন্টি ডিপ্রেশন ওষুধও ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে সাইকোলজিক্যাল বেজড থেরাপিতে বিভিন্ন ধরনের আচরণগত (যেমন : রিল্যাক্সেশন, অ্যাকটিভিটি শিডিউল প্রভৃতি) বা চিন্তামূলক (থট চ্যালেঞ্জ, কগনিটিভ প্রভৃতি) চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, উভয় পদ্ধতি যখন একসঙ্গে প্রয়োগ করা হয় তখন তুলনামূলক ভালো ফল পাওয়া যায়।
মনোবিশেষজ্ঞ অভ্র দাশ ভৌমিক জানান, বিষণ্ণতাকে রোগ হিসেবে নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। বিষণ্ণতার উপসর্গ যদি দেখা যায় তবে দেরি না করে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। যদি চিকিৎসা না করা সম্ভব হয় তবে অন্তত পরিবারের লোকজনকে বলতে হবে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবকেও বলা যেতে পারে। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
নিজেই বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাওয়ার কৌশল
মনোবিশেষজ্ঞ তুষার জানান, বিষণ্ণতা প্রতিরোধ করতে হলে নজর দিতে হবে বিষণ্ণতা কেন হয় সে কারণগুলোর দিকে। কারণ যত সীমিত রাখা যাবে বিষণ্ণতা থেকে তত দূরে থাকা যাবে। বিষণ্ণতা আমাদের শক্তি, প্রত্যাশা এবং চালিকাশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। তখন ভালো থাকার জন্য যা করা দরকার তা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আক্রান্ত অবস্থায় বিষণ্ণতা থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কষ্টকর, তবে অসম্ভব নয়। এটা শুধু নিজের ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে না। বিষণ্ণতা মোকাবিলা করতে বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনযাত্রায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়। যেমন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে (বিয়ে, জন্মদিনসহ যে কোনো ধরনের আয়োজনে) অংশগ্রহণ করা, ভালো বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করা।
বিশেষ করে যাঁরা জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা, প্রতিদিন একই পরিমাণ (৬-৮ ঘণ্টা) ঘুমানো এবং কিছু সময়ের জন্য সূর্যালোকে যাওয়া, কোনো বেলা খাবার বাদ না দেওয়া, টিভিতে মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী সিরিয়াল বা অনুষ্ঠান না দেখে আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান দেখা বেশ কাজে আসে।
প্রতিটি মানুষের জীবনে মানসিক চাপ আসে। সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা এবং চাপ মোকাবিলা করা শেখা দরকার। আর মানসিক চাপ এলে প্রয়োজনে কারো সাহায্য নেওয়া, নিয়মিত বিশ্রাম ও প্রগ্রেসিভ মাসকুলার রিলাক্সেশন চর্চা, প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটা বা শারীরিক ব্যায়াম করা, পূর্বপরিকল্পিতভাবে দিনের সব কাজ করা এবং নিজের যত্ন করা দরকার। অর্থাৎ পুরো সপ্তাহ বা আগামীকাল কীভাবে কাটাবেন তা আগেই নির্ধারণ করে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যতটুকুই করা সম্ভব হোক না কেন সেটুকুর জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করা (অন্তত নিজেকে ধন্যবাদ/অভিনন্দন জানানো) এবং সফলতার হার ধীরে ধীরে বাড়ানো দরকার। যে কাজগুলো কঠিন মনে হয় প্রয়োজনে সেগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা এবং তা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত।
তিনি জানান, প্রতিদিনের কাজের তালিকায় নিজের আনন্দের জন্য অন্তত একটা কাজ (খেলাধুলা, বই পড়া, শখচর্চা) থাকা ভালো। এ ছাড়া নিজের মনঃকষ্টের কথাগুলো অপরজনের কাছে খুলে বলা, যিনি বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, বুঝবেন এবং অন্যদের কাছে গোপন রাখবেন। নিজের ভুল বা নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে চিহ্নিত করতে শেখা ও এগুলোকে ইতিবাচক চিন্তায় রূপান্তর করা। কোনো কিছু বা কোনো কাজ একদম ‘পারফেক্ট’ হতে হবে—এ ধরনের চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনা। মনে রাখতে হবে, পারফেক্ট না হলেও জীবনে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু ‘পারফেক্ট’ করার চিন্তা যদি জেঁকে বসে তাহলে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে সময় লাগতে পারে। মনে রাখতে হবে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকেই কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত নারীদের ক্ষেত্রে এ রোগ বেশি হয়। নারীদের কিছু হরমোন বদলের বিষয় থাকে। ফলে রোগটি হয়। যেমন : মাসিক, গর্ভকালীন, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কারণে মেয়েদের বেশি হয়। এ রোগ শিশুদের মধ্যে হলে তাঁরা বিরক্তি প্রকাশ করেন। আর বয়স্কদের হলে মাথার তালু গরম হয়, ঘুমের সমস্যা হয়।
পরিবারের দায়িত্ব
মনোবিশেষজ্ঞ অভ্র দাশ ভৌমিক জানান, ডিপ্রেসড রোগী নিজে আপসেট থাকে বলে পরিবারের লোকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হয় না। তাই এসব ক্ষেত্রে পরিবারের লোকজনকেও বিরক্ত না হয়ে তাকে মানসিকভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতে হবে। এ সময় অনেকে হতাশা থেকে নিস্তারের জন্য মাদকের আশ্রয় নেয়। কিন্তু এর ফলে সাময়িক নিস্তার হলেও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই পরিবারের লোকজনেরও এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।