ডায়াবেটিস রোগীর চোখে কেমন সমস্যা হয়

ডায়াবেটিস রোগ হলে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি চোখেরও সমস্যা হয়। আজ ১৯ ফেব্রুয়ারি এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩০২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. শেখ মাহবুব উস সোবহান। তিনি বারডেম জেনারেল হাসপাতালের চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস রোগীদের শারীরিক নানা রকম সমস্যা হয়। তার চোখের সমস্যা হতে পারে, কিডনির সমস্যা হতে পারে, হার্টের সমস্যা হতে পারে, স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। শরীরের যেকোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আপনি কি বলবেন, চোখের কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : চোখের সমস্যা চোখের পাতা থেকে শুরু হতে পারে। চোখের স্নায়ু পর্যন্ত হতে পারে। আর যে স্নায়ুটার মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে, সেটি মস্তিষ্ক পর্যন্ত প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন, চোখের পাতা নিচে নেমে যেতে পারে। চোখে ছানি হয়ে যেতে পারে। পেছনে যে পর্দা রয়েছে ঝিল্লির মতো, যেটি বাইরের আলোকে গ্রহণ করে, ছবিতে পরিণত হয়ে আমাদের দেখতে সাহায্য করে—সেই রেটিনা প্রভাবিত হতে পারে। এই রেটিনা থেকে ছবিটা বহন করে যে নিয়ে যায় অপটিক স্নায়ু, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মস্তিষ্ক যদি ডায়াবেটিসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটিও চোখের দৃষ্টির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তখন আমরা কম দেখি। মূলত রেটিনাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রশ্ন : একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর এই সমস্যা হয় কেন?
উত্তর : ডায়াবেটিস হয় রক্তের শর্করা বেড়ে যাওয়ার জন্য। যেহেতু এটি রক্তবাহী তন্ত্রের জন্য জড়িত এবং সারা শরীরের যেখানে যেখানে রক্ত সরবরাহ করছে, সেখানেই গিয়ে এটি প্রভাব ফেলবে। এটি শরীরের কোনো নিজস্ব রোগ নয়। এটি রক্তে সুগারের বেড়ে যাওয়ার জন্য রোগ। যেহেতু চোখেও রক্ত আসে, সুগারটা যেহেতু এখানেও আসে। এটা সুগারের পরিমাণ বেড়ে গেলে হয়। সে জন্য এই রোগটা এসে এখানেও ধরে।
প্রশ্ন : একজন রোগীর ডায়াবেটিস কী মাত্রায় থাকলে এবং কত বছর ধরে থাকলে এটি চোখের ক্ষতি করতে পারে?
উত্তর : আমাদের সর্বসাধারণ থেকে শুরু করে অনেক চিকিৎসকদের মধ্যে ধারণা রয়েছে, ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে বা সুগার বেশি থাকলে, চোখের ক্ষতি হয়।
একটি বিষয় সব সময় লক্ষ রাখতে হবে, এক নম্বর পয়েন্ট হলো ডিউরেশন অব ডায়াবেটিস। কতদিন ধরে রোগী ভুগছেন, এটি প্রধান একটি বিষয়। একজন ডায়াবেটিস রোগীর দু-তিন মাস, ছয় মাস ধরে যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, এটা যত না বেশি ক্ষতিকর, সুনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ১০ বছর থাকা আরো বেশি ক্ষতিকর।
তবে পার্থক্য এটাই ওইটুকুতে যে ক্ষতি হবে, এতে ক্ষতির পরিমাণটা কম হবে এবং সেই ক্ষতির চিকিৎসাটা সহজলভ্য হবে, অল্প টাকায় হবে। এতে অঙ্গহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তবে মাথায় রাখতে হবে সুনিয়ন্ত্রিত হলেও ডায়াবেটিস কতদিন ধরে, তারও একটি মস্ত বড় ভূমিকা আছে।
দুই নম্বর হলো, বলা হয়, খালি পেটে সুগার ছয় থেকে সাতের ওপরে যাওয়া যাবে না। খালি পেটেরও আবার একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। কত ঘণ্টা আমি খাব না, এই বিষয়টি প্রভাব ফেলবে। ঠিক সেই রোজার মাসের মতো। সেই জিনিসটি হলো, আট থেকে সাড়ে আট ঘণ্টা যদি আমি না খেয়ে থাকি, তাহলে তাকেই আমি খালি পেট বলব। এবং তারপর যদি রক্ত নিয়ে আমি পরীক্ষা করে দেখি, ছয় থেকে সাত থাকে, তাহলে আমরা মোটামুটি খুশি থাকি।
আমাদের প্রধান খাবারের সময় তিনটি। নাশতা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার। এই তিন বেলা খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে কোনোভাবে সাত থেকে আটের বেশি থাকা চলবে না। তাহলেই আমরা বলব, তার ডায়াবেটিসটা সুনিয়ন্ত্রিত আছে।
আরেকটি বিষয় আছে। প্রতি তিন মাসে একটি গড়পরতা হিসাব আমরা নিই। একে আমরা বলি হিমোগ্লোবিন এওয়ানসি। এটি যদি ছয় থেকে সাত ভাগ থাকে, আমরা ধরেই নিই, গত ৯০ দিনে ২৪ ঘণ্টার মতো লোকটির ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। এই কয়টা পরীক্ষা ঠিক থাকলে আমরা বলে দিতে পারি আপনার ডায়াবেটিস অঙ্গহানি ঘটাবে না। আর যদিও হয় সেটি খুব কম।
প্রশ্ন : একজন মানুষের ডায়াবেটিসজনিত সমস্যায় যদি চোখের ক্ষতি হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : এটি নির্ভর করে সে কোন পর্যায়ে আছে তার ওপর। একটি জিনিস ধরে নিতে হবে যার ডায়াবেটিস ডায়াগনোসিস হয়, তখন একে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করি। তরুণদের, বড়দের। দুজনের চিত্র ভিন্ন। তবে সামগ্রিকভাবে যদি ধরি, প্রাথমিক অবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত থাকলে এমনিই তার দৃষ্টিশক্তি কম হতে পারে। যে লোকটি দেখা গেল চশমা পরে আসছে, তার যদি ঘন ঘন পাওয়ার পরিবর্তন হয়, বুঝতে হবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত নেই।
তিন মাস পর্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে, একটি পাওয়ার নির্দিষ্ট থাকতে হলে। যদিও আমাদের রোগীরা অনেক পীড়াপীড়ি করেন যে আমাকে এখনই চশমা দেন। দিয়ে দেওয়া যাবে। তবে অনিয়ন্ত্রিত থাকলে এই চশমার পাওয়ার কাজ করবে না। এটি হলো খুব প্রাথমিক জিনিস।
আরো খারাপ হলে আস্তে আস্তে চোখটা বেঁকে যায়। যেটাকে আমরা ট্যারা বলি। যেই স্নায়ুটি চোখকে সোজা রাখার জন্য দায়িত্ব পালন করে, সে দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্বল হওয়ার জন্য চোখটি আর সোজা থাকে না। এটি বেঁকে যায়। এটি একটি খারাপ দিক। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে এটি নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায় ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে। আরেকটি জিনিস হলো, পাতাটা নিচে নেমে চলে আসে। অর্থাৎ চোখটা ঢেকে যায়। এটি ঠিক করার জন্যও আবার ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে এটি ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই ৮০ ভাগ থেকে ৯০ ভাগ।
আর পেছন দিকে যেটা হয়, সেটা হচ্ছে কারো ছানি বেড়ে যায়, বা যে লোকের ছানি সামান্য ছিল তার সেটি খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। আর সবচেয়ে যেটি ভয় পাই, যেটা সবচেয়ে বেশি সমস্যা করে—এটি হলো রেটিনায়। স্নায়ুর ওপরে। যেটি প্রথম দিকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এর পরিমাণ খুব অল্প। অনেক রোগী সমস্যা নিয়ে হয়তো চিকিৎসকের কাছে আসেন না। বা শুধু চশমা নিয়ে চলে গেলেন, পরীক্ষা করলেন না। এই সমস্যায় দেখা গেল হঠাৎ করে হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখে চোখে সে কিছুই দেখছে না। বেশি পরিমাণ রক্তক্ষরণ হতে পারে। অথবা স্নায়ু ছিঁড়েও যেতে পারে।
প্রশ্ন : এই সমস্যা প্রতিরোধের জন্য কী করা উচিত?
উত্তর : পরামর্শ একটাই। যেকোনো কারণে হোক, হার্টের কারণে বলি আর চোখের কারণে বলি, মস্তিষ্কের কারণেই বলি—মানুষের মধ্যে একটি অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। আর সেটা হলো, বছরে একবার হলেও চিকিৎসককে সম্পূর্ণভাবে দেখানো উচিত। তাহলে তার অন্যান্য রোগগুলোও ধরা পড়ে, চোখের রোগগুলোও ধরা পড়ে। এমন কিছু রোগ ধরা পড়তে পারে, যেগুলো অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গতেও ধরা পড়তে পারে। তাতে অঙ্গটিও বেঁচে যায়, রোগও সেরে আসে। অল্প থাকতে চিকিৎসা শুরু করলে ব্যয়, ঝুঁকি অনেক কিছু কমে যায়।