শিশুদের শ্বাসকষ্টে করণীয়

অনেক শিশুরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়। সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে রোগ জটিল হয়ে শিশুর ভোগান্তি বাড়তে পারে। এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. আহমেদ নাজমুল আনাম। তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩১২তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : সাধারণত কোনো কোনো কারণে শিশুদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : এটা নির্ভর করছে বিভিন্ন বয়সের ওপরে। তবে সাধারণত এই সমস্যায় শিশু সর্দিকাশি নিয়ে আসে। ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা এ রকম কিছু কারণ নিয়েই মূলত আমাদের কাছে আসে। বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট নিয়ে আমাদের কাছে আসে।
প্রশ্ন : কী কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সেটি বোঝার কি কোনো উপায় আছে?
উত্তর : শীত গেল, এখন বসন্তের শুরু, এখন আমাদের কাছে বেশি যেটা আসে, সেটি হলো ব্রঙ্কিওলাইটিস। এটি একটি ভাইরাসবাহিত রোগ। অনেকেই আসলে একে নিউমোনিয়া মনে করে। আসলে এটা নিউমোনিয়া নয়। ৮০ থেকে ৯০ ভাগ যেসব শ্বাসকষ্ট মা-বাবারা নিয়ে আসে, আমরা দেখি, এটি ব্রঙ্কিওলাইটিস। এটা বোঝার কিছু উপায় আছে। যেহেতু আমরা বলছি এটি ভাইরাস বাহিত রোগ, সুতরাং ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে যে ধরনের লক্ষণগুলো খাকে— একটু নাক দিয়ে পানি ঝরা, খুকখুক করে কাশি, গায়ে হালকা হালকা জ্বর- এই ধরনের লক্ষণ প্রথমে প্রকাশ পায়। পরে যদি এটি আস্তে আস্তে গাঢ়ও হয়, তাহলে হয়তো পরে শ্বাস প্রশ্বাসের তীব্রতা অনুভূত হয়।
প্রশ্ন : আপনি যেটি বলছিলেন যে শ্বাসকষ্টের কারণে নিউমোনিয়াও হতে পারে, ব্রঙ্কিওলাইটিসও হতে পারে। শ্বাসকষ্টের ধরন দেখে কী বোঝার উপায় রয়েছে কোনটি ব্রঙ্কিওলাইটিসের জন্য শ্বাসকষ্ট, আর কোনটি নিউমোনিয়ার জন্য?
উত্তর : সেটা তো আসলে নিশ্চিত করব আমরাই। তবে শ্বাসকষ্টের যে প্রাথমিক বিষয়, এর মধ্যে দ্রুত শ্বাস নেওয়া একটি। যদি দুই মাসের নিচের কোনো শিশু হয়, আমরা বলব যে ঘন ঘন শ্বাস নেয়, যদি ৬০ বারের বেশি একটি শিশু ঘন ঘন শ্বাস নেয়—তাহলে বুঝতে হবে তার অবশ্যই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হচ্ছে। দুই মাস থেকে এক বছরে বলব, ৫০ থেকে তার বেশি বার শ্বাস নেয়, আর যদি এক বছরের উপরের বাচ্চার ক্ষেত্রে ৪০ বারের উপরে শ্বাস নেয়, তাহলে আমরা বলব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
আর এটি আরো তীব্র হবে যদি বুকের ভেতরের দুই খাঁজ বসে যায়, তাহলে আমরা বলব দ্রুত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। তখন অবশ্যই যোগাযোগ করতে হবে।
প্রশ্ন : এই জাতীয় সমস্যা হলে যখন শিশুটিকে নিয়ে মা-বাবারা আপনাদের কাছে আসেন তখন আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : অধিকাংশ সময় দেখা যায়, বাচ্চাদের নাকগুলো বন্ধ থাকে, নাকগুলো আমরা পরিষ্কার করতে বলি, সেজন্য আমরা বাজারের বিভিন্ন ড্রপ ব্যবহার করি।
তবে আমি বলব, এক চামচ কুসুম গরম পানিতে এক চিমটি লবণ দিয়ে সেটা যদি গুলে যায়, সেটা ড্রপার দিয়ে তুলে মা-বাবাকে শিশুর নাকে দিতে। নাক যদি খুলে যায়, শিশুরা দেখা যায় অনেক আরাম পাচ্ছে। আমরা হাইপার টনিক স্যালাইন তৈরি করব। এক চা চামচ কুসুম গরম পানিতে এক চিমটি লবণ দিয়ে এটি করতে হবে।
এরপর আমাদের কাছে যখন আসে, আমরা একটু অক্সিজেন দেই। আমরা একটু নাক পরিষ্কার করে দেই। মাথাকে একটু উঁচু করে রাখি। শুয়ে থাকলে বাচ্চাদের শ্বাসকষ্টটা বাড়ে এবং আমরা একটু নেবুলাইজ করে দেই। এই চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই। যদি ব্রঙ্কিওলাইটিস হয়ে থাকে দেওয়ার দরকার নেই। যেহেতু এটি ভাইরাসের কারণে হচ্ছে এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন : বঙ্কিওলাইটিসের ক্ষেত্রে কখন বুঝবে শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার আছে।
উত্তর : আমরা বলব, ব্রঙ্কিওলাইটিসের রোগীর ভর্তি হওয়ারই প্রয়োজন নেই। ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি মানতে হবে। সেটা হলো ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। একটু আর্দ্র যেই ঘর, অর্থাৎ যেখানে আলো বাতাস চলাচল করছে, সেখানে রাখতে হবে। আর যদি সম্ভব হয়, যদি নেবুলাইজেশন করার সুযোগ বাসায় থাকে তাহলে করে দেওয়া যেতে পারে।
তবে আমরা যে বিষয়গুলোর কথা বললাম, তার শ্বাসকষ্ট যদি বেড়ে যায়, খুব ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে, যদি বুকের দুই খাঁজ বসে যায় এবং শিশুর মুখের চারপাশ যদি নীল হয়ে যেতে থাকে; তাহলে খুব দ্রুত হাসপাতাল বা নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : সেক্ষেত্রে আপনাদের ব্যবস্থাপনা কী হবে?
উত্তর : প্রথমে আমরা অক্সিজেন দেই এবং আমরা নেবুলাইজ করে দেই। আমরা দেখেছি মোটামুটি নেবুলাইজ করে দিলে, নাকটা পরিষ্কার করে দিলে শিশুদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়ে যায়।
মেডিকেশন হিসেবে ব্রঙ্কিওলাইটার বা সালবিউটামল দেই। তবে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। তবে পরামর্শ দরকার। মা- বাবাকে বোঝানো দরকার তার নিউমোনিয়া হয়নি। আপনি একটু ধৈর্য ধরুন। বুকের দুধ খাওয়ান। নাক পরিষ্কার করুন।
প্রশ্ন : একজন শিশু যখন বুকের দুধ খাচ্ছে, তার যখন শ্বাসকষ্ট হয় অনেক সময় দেখা যায় মায়েরা শিশুর এই খাবারটি বন্ধ করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আপনার কী মনে হয়?
উত্তর : আমি বলব যে, এই রোগের মূল চিকিৎসা হলো ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ানো। বরং ইতিহাসে দেখা গেছে সেসব বাচ্চা বুকের দুধ খায় না, তাদেরই এই ধরনের শ্বাসকষ্ট বা ব্রঙ্কিওলাইটিসের সমস্যা ঘন ঘন হয়। এসব বাচ্চাই বেশি ঝুঁকির ভেতর থাকে। সুতরাং বুকের দুধ খাওয়া জরুরি। ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন : ব্রঙ্কিওলাইটিসের জন্য সাধারণত কোন কোন বয়সের বাচ্চারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে?
উত্তর : দুই মাস থেকে দুই বছরের বাচ্চাকে আমরা ব্রঙ্কিওলাইটিসের ভেতর আনি। সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা যখন আসবে তখন আমরা আর ব্রঙ্কিওলাইটিস ভাবব না। ভাইরাস দিয়ে আক্রান্তও হতে পারে, তবে তখন অনেকটাই ঝুঁকি কমে যায়।
প্রশ্ন : যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয় তখন জটিলতা কী হয়?
উত্তর : ব্রঙ্কিওলাইটিস থেকে তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়ে কার্ডিওলজিক্যাল অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং এই বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। মাকে বিপজ্জনক চিহ্নগুলোর বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তখন অবশ্যই নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে যোগাযোগ করতে হবে।
প্রশ্ন : চিকিৎসা যখন শেষ হয়ে যায় এরপর কী আর হওয়ার আশঙ্কা থাকে?
উত্তর : সাধারণত এটি আর হয় না। একটি নিউমোনিয়া কিন্তু বার বার হতে পারে। ব্রঙ্কিওলাইটিস আমরা বলব আর সাধারণত হয় না এবং চিকিৎসায় পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। সাধারণত সারতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগে। তবে কঠিন অবস্থাটি দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কাশিটা কিছুদিন থাকবে এটি নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
প্রশ্ন : প্রতিরোধ কীভাবে করবে?
উত্তর : প্রথমতো আমি বলব বুকের দুধ পান করাতে। যে বাচ্চা অপরিষ্কার ঘরে থাকছে তার এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। যেসব মা-বাবার ধূমপানের অভ্যাস রয়েছে, তাঁদের বাচ্চাদের এসব বিষয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তাই বুকের দুধ খাওয়ানো, যেসব ঘরে আলো-বাতাস আছে, শিশুকে সেই ঘরে রাখা, মা-বাবাকে ধূমপান মুক্ত থাকা— এগুলো রোগ প্রতিরোধ করবে।
প্রশ্ন : যদি জ্বর চলে আসে এই ক্ষেত্রে কী করবে?
উত্তর : সেই ক্ষেত্রে আমরা প্যারাসিটামল দিতে বলব। চিকিৎসকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে অ্যান্টিবায়োটিক দেব কি না। চিকিৎসকই বলে দেবেন বিষয়টি।