বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস

জন্মগত ত্রুটি কেন হয়?

Looks like you've blocked notifications!
৩ মার্চ দিনটি পালন করা হয় বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস হিসেবে

৩ মার্চ বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস। বাংলাদেশে এ দিনটি নিয়ে তেমন কোনো কর্মসূচি দেখা যায় না। শিশুদের জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে পালিত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দিনটি সম্পর্কে বলার আগে ছোট্ট একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি।

দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় কাঁদছিল এক নবজাতক শিশু। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও শিশুটির কোনো স্বজন পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে একজন চিকিৎসক নবজাতকটি নিয়ে আসেন শিশু সার্জারি বিভাগে। সেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন, শিশুটি মেনিনগোমায়েলোসিল নামের জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত। তার দুই পা অবশ, পায়খানা ও প্রস্রাবের সমস্যা ছাড়াও নানা শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত সে।

শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. তাহমিনা বানু বলেন, ‘সমস্যা যত জটিলই হোক, কোনো অভিভাবক পাওয়া যাচ্ছে না বলে একটা জীবিত শিশুকে তো আমরা ফেলে দিতে পারি না। আপাতত আমাদের তত্ত্বাবধানেই সে থাকবে।’ এ সিদ্ধান্তে একমত হলেন ওয়ার্ডের সবাই। সেবিকারা মাতৃস্নেহে কোলে তুলে নিলেন কন্যাশিশুটি, নাম দেওয়া হলো ‘আরাবি’।

সেই থেকে আরাবির ঠিকানা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি ওয়ার্ড। নার্স ডিউটি রুমের টেবিলে ব্যবস্থা হলো নরম বিছানার। চলছে চিকিৎসা, সেই সঙ্গে ১০ জন সেবিকার যত্ন।

এমনই অনেক সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন প্রচুর শিশু ভর্তি হয় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে। যাদের বলা হয় বার্থ ডিফেক্ট চাইল্ড বা জন্মগতভাবে ত্রুটিগ্রস্ত শিশু।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় প্রতিবছর আট মিলিয়ন বাচ্চার ৬ ভাগ মারাত্মক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু জন্মানোর পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। শিশুমৃত্যুর চতুর্থ কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটিকে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার শিশু মারা যায় এ কারণে এবং ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু, যারা মৃত্যুর ছোবল থেকে বেঁচে যায়, তারা আজন্ম শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে দিন কাটায়।

জন্মগত ত্রুটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কিন্তু এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় চার হাজারের বেশি রকমের জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৩ শিশুর একজন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। (সূত্র : মার্চ অব ডাইম)

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে পাঁচ বছরের (জানুয়ারি ২০০৮-ডিসেম্বর ২০১২) গবেষণাপত্রে যে তথ্যউপাত্ত উঠে এসেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। গবেষণার সময়কালটিতে মোট পাঁচ হাজার ৬৬১ জন জন্মগত ত্রুটির শিশুকে পর্যবেক্ষণ শেষে দেখা গেছে, তাদের প্রায় পাঁচ হাজার ১৫৬ জন ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। অন্যদিকে ৫০৫ জনের একাধিক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে।

জন্মগত ত্রুটিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কাঠামোগত জন্ম ত্রুটি (Structural Birth Defect), অর্থাৎ কোন অঙ্গ জন্ম থেকেই অস্বাভাবিক, অকেজো, অসম্পূর্ণ। যেমন : হৃৎপিণ্ডের সমস্যা। অন্যটি হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় অকার্যকারিতা (Functional Birth Defect)। এ কারণে যেসব জন্মগত ত্রুটি হয়ে থাকে তা হলো, খাদ্যরস পাচিত না হওয়ার কারণে বিপাকীয় সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তির অনুন্নতি, বধির, দৃষ্টিস্বল্পতা ইত্যাদি।

গবেষণায় এও দেখা গেছে, ছেলেশিশুদের জন্মগত ত্রুটির সংখ্যা মেয়েশিশুদের তুলনায় বেশি। যেমন পাঁচ হাজার ৫৯৮ শিশুর মধ্যে তিন হাজার ৮৩৭ জন ছেলে এবং এক হাজার ৭৬১ জন মেয়ে। অর্থাৎ ছেলে : মেয়ে—২.১ : ১। মৃত্যুর হিসাব করলে দেখা গেছে, তিন হাজার ৯২১ জন জন্মগত ত্রুটি শিশুর সার্জারি করা হয়েছিল এবং ২২৫ শিশু গবেষণা চলাকালেই মৃত্যুবরণ করেছিল।

মানবশিশুর মূত্রনালি, জনননালি ও মলদ্বার, অর্থাৎ পায়ুপথের সৃষ্টি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু শিশু অসম্পূর্ণ পায়ুপথ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ ধরনের ত্রুটির দুর্লভ প্রকারটি হলো ক্লোয়েক্যাল ম্যালফরমেশন। জন্ম নেওয়া প্রতি ৫০ হাজার থেকে সোয়া লাখ শিশুর মধ্যে একজনের শরীরে এই ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। যাদের শরীর থেকে পায়খানা, ঋতুস্রাব ও প্রস্রাব বের হওয়ার স্বাভাবিক পৃথক তিনটি পথ থাকে না। ফলে সার্জারির মাধ্যমে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সেসব নির্গত করতে পথ তৈরি করে দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, প্রতি ২০ হাজার কন্যাশিশুর মধ্যে একজন এ ধরনের শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। যাদের মূত্রনালি, ঋতুস্রাবের রাস্তা এবং মলদ্বার একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি ছিদ্র দিয়ে বের হয়। এই দুর্লভ প্রকারটি কখনো কোনো পুরুষ শিশুর শরীরে চিহ্নিত হয়নি।

বাংলাদেশি একদল চিকিৎসক ও প্রফেসর ডা. তাহমিনা বানুর নিরলস সাধনায় ও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ক্লোয়েক্যাল ম্যালফরমেশন নামের জন্মগত শারীরিক ত্রুটি কেবল মেয়েদের ক্ষেত্রে হতে পারে—বিশ্বব্যাপী প্রচলিত এমন ধারণা সঠিক নয়। সমস্যাটি পুরুষদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এই আবিষ্কার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য গর্বের বিষয়।

এই জটিল শারীরিক ত্রুটি নানা কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, ক্লোয়েক্যাল ম্যালফরমেশন নামের জন্মগত শারীরিক ত্রুটি যথাসময়ে সফল অপারেশনের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক করা সম্ভব। (সূত্র : খবরের গল্প/ শামসুল হক হায়দরী)

শিশুদের জন্মগত ত্রুটি হওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা না গেলেও বিশেষজ্ঞদের মতে গর্ভাবস্থায় ভিটামিন, খনিজ উপাদান, বিশেষ করে আয়োডিন, পরিমিত সুষম খাদ্য ইত্যাদির অভাবে স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাদের শরীরেও পুষ্টির অভাব হয় এবং জন্মগত ত্রুটির বিশেষ একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয়, প্রধানত ফলিক এসিডের (ভিটামিন-বি) অভাবে শিশুদের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড গঠন ব্যাহত হয়। এ ছাড়া মায়ের কাছ থেকে গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক ভাইরাস (রুবেলা, সিফিলিস ইত্যাদি), পরিবেশের ক্ষতিকারক উপাদান (মার্কারি, সিসা কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড প্রভৃতি), তেজস্ক্রিয়তা, শক্তিশালী ওষুধের প্রভাব বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করে বিকলাঙ্গতাসহ নানা রকম জটিল রোগ সৃষ্টি করে থাকে।

ধনী দেশগুলোর তুলনায় কম আয়ের দেশগুলোয় এ ধরনের রোগের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মায়েদের পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য, আত্মীয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক, জিনগত ও বংশানুক্রমিক রোগের কারণগুলো দায়ী করা হয়।

বাংলাদেশে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো মোট শিশুর সংখ্যা বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেমন পরিসংখ্যান না থাকায় সঠিক কোনো উপাত্ত ও তথ্য জানা যায়নি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের 'ইউক্যারয়টিক জিন এক্সপ্রেশন অ্যান্ড ফাংশন' ল্যাবের যৌথ উদ্যোগে শিশু সার্জারি বিভাগের জন্মগত ত্রুটি শিশুর ডাটা ও তথ্যাদি সংগ্রহ ছাড়াও গবেষণার কাজ করা হচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাপী জন্মগত ত্রুটির ঘটনা প্রায় ৩-৭ শতাংশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায় : জাপান (১.০৭ ভাগ), দক্ষিণ আফ্রিকা (১.৪৯ ভাগ), যুক্তরাজ্য (২ ভাগ), যুক্তরাষ্ট্র (৩-৪ ভাগ), তাইওয়ান (৩-৪ ভাগ), ভারত (০.৩-৩.৬ ভাগ)। মার্চ অব ডাইমের মতে, পৃথিবীতে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা বেশি ভারতে।

জন্মনিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন, না বুঝে ওষুধ সেবন ইত্যাদিকেও বিশেষ কারণ হিসেবে দেখা হয়। অল্প টাকায় সহজলভ্য ওষুধের নামে নিম্নআয়ের মানুষ ও গ্রামাঞ্চলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। অথচ সেসব মানুষ জানে না, এসব অজানা ওষুধের কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি তারা অনাগত শিশুটির জীবনে বয়ে আনছে। হয় শিশুটি কিছুদিন পর মারা যাবে, নয়তো আজীবন বাঁচার জন্য লড়াই করবে। 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের জানুয়ারি-২০১৬ সালের তথ্যমতে, ৪৫৭ শিশুর মাঝে প্রায় ১৩৩ জনই জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত। ওই বিভাগের হিসাবে প্রায় ৯১ শিশুর মাঝে প্রায় ৬০ জন কাঠামোগত জন্ম ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের সংখ্যা প্রায় ৩০ ভাগ। জন্মের প্রথম বছরেই সাধারণত জন্মগত ত্রুটি শনাক্ত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে তেমন একটা পরিচিতি না থাকলেও বিশ্বের প্রায় ৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ৩ মার্চ ''World Birth Defects Day" পালন করে। এই দিবসের উদ্দেশ্য মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, রোগ নিরাময়, প্রতিরোধ গঠন, রোগ মোকাবিলায় সাহায্য ও সাহস জোগানো। জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও কারণগুলো অনুসন্ধান ও প্রতিকারের মাধ্যমে শিশুদের স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণ ও গবেষণার সুযোগ তৈরির জন্য সারা বিশ্বের সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি সুস্থ, স্বাভাবিক শিশুর জন্ম নিশ্চিত করার আশঙ্কা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে সবার এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের রিসার্চ ফেলো।