বুকে যদি ব্যথা হয়, কী করবেন?
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/03/03/photo-1457020019.jpg)
বুকের ব্যথা সাধারণ কারণ থেকে গুরুতর কারণের জন্য হতে পারে। অনেক সময় বুকে ব্যথা হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও হতে পারে। বুকের ব্যথা নিয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. শাহাবুদ্দিন। তিনি আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিসিন ও হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩১৪তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : বুকে ব্যথা অত্যন্ত প্রচলিত একটি বিষয়। সবারই জীবনে কখনো না কখনো বা একাধিকবার বুকে ব্যথা হতে পারে। এটি সাধারণ কারণ থেকে অত্যন্ত গুরুতর বিষয়ের জন্য হয়ে থাকে। একটু বলেন সাধারণ থেকে গুরুতর কী কী কারণে বুকে ব্যথা হয়?
উত্তর : আসলে যদি আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে বুকের ব্যথার বিষয়টি চিন্তা করি তাহলে দেখব আমাদের শরীরে কী আছে? আমাদের এখানে ত্বক রয়েছে, তার নিচে মাংসপেশি আছে। তার ভেতরে দুই পাশে ফুসফুস আছে। তার মাঝখানে রয়েছে আমাদের হার্ট বা হৃদপিণ্ড। এর ভেতর দিয়ে চলে গেছে আমাদের খাদ্যনালি। পেছনে আছে আমাদের মেরুদণ্ডের হাড় এবং এর প্রত্যেকটি থেকে স্নায়ুগুলো ছড়িয়ে গেছে। তার ঠিক নিচেই আছে আমাদের পাকস্থলি। ডান পাশে লিভার এবং বাম পাশে স্প্লিন। এই যন্ত্রগুলোর যেকোনোটি থেকেই কিন্তু বুকের ব্যথা হতে পারে। কেউ যদি বুকের ব্যথা কথা বলে তার বয়স জানা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো বাচ্চার বুকের ব্যথা হয় যে সে খেলতে গিয়ে বুকে ব্যথা পেয়েছে, তাহলে আমি চিন্তা করব তার মাংসে বা হাড়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। এই বুকের ব্যথা যদি খুব ছোটো বাচ্চার হয়, তার শ্বাস টানতে কষ্ট হয় আমি নিউমোনিয়ার কথা চিন্তা করব। এই বুকের ব্যথা যদি চামড়ার উপরে দানা নিয়ে হয়, তাহলে আমি চিন্তা করব হারপিসজোস্টার কি না। যদি একজন বয়স্ক লোকের ঘাড় থেকে ব্যথাটা যায়, আমি চিন্তা করবো এটি সারভাইক্যাল স্পোনডালাটিস কি না। বুকের ব্যথা যদি একজন মধ্য বয়সী নারীর হয় বেশির ভাগ কারণ হয় পিত্তথলির পাথর।
অনেক সময় আমরা বলি পাকস্থলী থেকে এসিড উপরের দিকে উঠে আসে বা অনেক সময় পাকস্থলীই বুকের দিকে চলে আসতে চায়। এখন ফুসফুসের সংক্রমণে বুকে ব্যথা হতে পারে। অনেক ভাইরাল ইনফেকশন থেকে বুকে ব্যথা হতে পারে।
বুকের ব্যথা হলে একজন মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমিও ভয় পাই। আমি কী হার্ট অ্যাটাক নিয়ে কাজ করছি? এখন একজন পুরুষ বা নারী যার বয়স ত্রিশের উপরে তার যদি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থাকে যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কোলেস্টেরল বা সে যদি ধূমপায়ী হয়, অথবা যদি তামাক জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে, তার পরিবারের কারো যদি ইতিহাস থাকে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের বা বাইপাস সার্জারির বা এনজিও প্লাস্টি করা হয়, তখন আমি অবশ্যই চিন্তা করব এটি ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা হার্ট অ্যাটাক সংক্রান্ত বিষয় কি না।
প্রশ্ন : যদি হার্ট অ্যাটাকের কারণে বুকের ব্যথা হয়, তবে সেই বুকের ব্যথাটি অন্যান্য বুকের ব্যথা থেকে আলাদা করার উপায় কী?
উত্তর : খুব সহজ। সারা পৃথিবীতে ১০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে প্রথম ১২ ঘণ্টা আমরা বুঝতেও পারি না। তাই সারা পৃথিবীতে একজন মধ্য বয়সী নারী বা পুরুষের বুকের ব্যথা শুরু হয়, তখন আমরা সরাসরি সিসিইউতে না নিয়ে চেস্ট পেইন ইউনিটে রাখি। আমরা তার ইতিহাস নিই, তাকে পরীক্ষা করি এবং সামান্য কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করলেই, বুকের ব্যথা কী কারণে হচ্ছে এর মোটামুটি একটি ধারণা পেয়ে যাই। তাহলে এই বুকের ব্যথার কারণটাকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। হার্ট অ্যাটাক বা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা করনারি হার্ট ডিজিজের ব্যপারে আমরা এতটা গুরুত্ব দেই এই কারণে যদি সঠিক চিকিৎসা না হয়, একটি হার্ট অ্যাটাকে সারা পৃথিবীতে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ লোক মারা যায়। আমরা যদি রোগটিকে যথাযথভাবে নির্ণয় করে রোগীকে সিসিইউতে পাঠাতে পারি, আমরা পাঁচ ভাগের নিচে মৃত্যুর আশঙ্কা কমিয়ে দিতে পারি।
প্রশ্ন : হৃদরোগের কারণে বুকের ব্যথা হলে কীভাবে বুঝবেন?
উত্তর : আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় লেবিন সাইন। যদি কোনো রোগী বলে আমার বুকটা একেবারে চেপে আসছে, আরো নির্দিষ্ট করে যদি বলে বুকটা যেন একেবারে ভেঙ্গে যাচ্ছে, আমরা একে বলি লেবিন সাইন। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯৫ জনেরই এটি একটি ইসকেমিক অরিজিন। এই ব্যথাটা হবে কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিকভা্বে হাঁটতেন, বেশি জোরে হাঁটতে গেলে বুকটা চেপে আসবে।
একটু থেমে গেলে আবার চলে যায় এবং ধীরে ধীরে তার দূরত্বটা কমে আসে। যেমন আগে সে হয়তো ছয়তালা বাড়িতে উঠে যেত। এখন তিন তলা বা চার তলা উঠতেই তার হয়তো বুকটা চেপে ধরছে বা শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে বা সে খুব দুর্বল অনুভব করে। যদি এটি হার্টের ব্যথা হয়, ব্যথা যখন উঠবে তখন চিকন ঘাম হয়, অনেক সময় বুকে ধরফর হয়। একটু শ্বাসের কষ্ট হয় এবং খুব অল্পতেই হয়তো হয়রান হয়ে যায়। একে নির্ণয় করার জন্য ইতিহাস নেওয়ার পাশপাশি, ঝুঁকির কারণগুলো আমরা যখন এনালাইসিস করি, একটি সাধারণ ইসিজিতে আমরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ তথ্য পেয়ে যেতে পারি। তার সঙ্গে যখন আমরা একটি ইকো বা ইটিটি যোগ করি, প্রায় ৮৫ ভাগ লোকের হার্টের ব্লক আছে কি নাই, সেটি পেয়ে যাই।
আর যদি আমরা ১০০ ভাগ জানতে চাই তখন করনারি এনজিওগ্রাম করি। যেটি দিয়ে আমরা ১০০ জনকে নির্ণয় করতে পারি।
একজন লোকের বুকে ব্যথা হওয়ার পেছনে কিছু কারণ বা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় থাকবে। সেগুলো হলো, কিছু রয়েছে যেটি পরিবর্তন করা যায় না। পুরুষদের বেশি হয়। বয়স পঁয়তাল্লিশের ওপরে গেলে বেশি হয়। কোনো পরিবারে একজনের হলে আরেক জনের হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। নারীদের মেনোপজ হওয়ার পর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তখন আবার নারী-পুরুষের ভাগ সমান হয়ে যায়।
এ ছাড়া যেগুলোকে আমরা পরিবর্তন করতে পারি, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বি বেশি থাকা, ধূমপান ও সেডেন্টারি লাইফস্টাইল। আজকাল আমরা বলি সেন্ট্রাল ওবেসিটি, সব ভালো আছে তবে পেটের ওপর যেন একটি আপেল বসিয়ে রেখেছে। এগুলোও একটি বড় কারণ হার্ট অ্যাটাকের। এই কারণগুলো যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে নিয়মিত ওষুধ খান, জীবনযাপনের ধরন যদি একটু পরিবর্তন করেন, জিহ্বাকে যদি একটু নিয়ন্ত্রণ করেন, সিগারেট যদি ছেড়ে দিতে পারেন তাহলে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রশ্ন : বুকের ব্যথা নিয়ে রোগী আপনাদের কাছে এলে যখন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেন হৃদপিণ্ডের কারণে হয়েছে তখন করণীয় কী? কোন পর্যায়ে এলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়?
উত্তর : আসলে দ্রুত আসতে পারলে ভালো। যত আগে আসবে। এখানে একটু পুরোনো ইতিহাস টানতে চাই, একটি বাচ্চা যার ৪০ বছর বয়সে গিয়ে হার্ট অ্যাটক হবে, যেই বাচ্চাটা মায়ের বুকের দুধ খায় আর যেই বাচ্চাটা কৌটার দুধ খায় তাদের মধ্যে পরিসংখ্যানগত ডাটায় দেখা গেছে. মায়ের বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৫০ ভাগ কম। যেই বাচ্চা খেলাধুলা করে আর যেই বাচ্চা সারাদিন টিভির সামনে বসে থাকে বা কম্পিউটারে গেম খেলে দেখা যায় তার পরবর্তী জীবনে গিয়ে হার্ট অ্যাটকের ঝুঁকি অনেক বেশি।