শিশুদের কিডনি রোগের কারণ ও লক্ষণ

গতকাল ছিল বিশ্ব কিডনি দিবস। এই বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিশুদের কিডনি রোগ : শুরুতেই প্রতিরোধ’। শিশুদের কিডনি রোগগুলো কী এবং সেগুলো কেন হয়, এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু ও কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩২৩তম পর্বে হয় বিস্তারিত আলাপ।
প্রশ্ন : শুরুতেই জানতে চাইব শিশুদের কিডনির কোন সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়?
উত্তর : শিশুদের কিডনি রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে নেফ্রোটিক সিনড্রম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক বছরে যতগুলো বাচ্চা কিডনি রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছে; তার মধ্যে শতকরা ৬৮ জনের নেফ্রোটিক সিনড্রম রয়েছে। এরপর একিউট গ্লুমারল নেফ্রাইটিস, অবস্ট্রাকটিভ ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, একিউট কিডনি ইনজুরি ইত্যাদি।
প্রশ্ন : কিডনি রোগের প্রকোপ কোন বয়সের শিশুদের বেশি হয়?
উত্তর : যেকোনো শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শূন্য বয়স থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যেকোনো শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুদের কিডনি রোগের কারণগুলো কী?
উত্তর : বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির কারণ রয়েছে। যেমন : একিউট কিডনি ইনজুরি বা হঠাৎ কিডনি বিকল। সাধারণত বাংলাদেশে যেই কারণে এই কিডনি ইনজুরি হয় সেগুলো হলো—ডায়রিয়া, বমি, অপরিচ্ছন্নতা, মা বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, হারবাল ওষুধ চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র ছাড়া ব্যবহার করা। অনেক সময় বিনা কারণে এক্স-রে করলে এক্স-রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের জন্য কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হলো ডায়রিয়া ও বমি। এর কারণেও কিডনি বিকল হতে পারে।
প্রশ্ন : তাহলে শিশুর যখন ডায়রিয়া বা বমি হচ্ছে তখন তো কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : প্রথমেই বলব, ডায়রিয়া হওয়ার আগে প্রতিরোধ করা ভালো। এখন বলি, কীভাবে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায়। যদি একটা মা বাচ্চাকে দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ায়, তার ডায়রিয়া হওয়ার আশংকা অনেক কমে যাবে। এ ছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। হাত না ধুয়ে কোনো খাবার শিশুকে খাওয়ানো যাবে না। সব সময় টাটকা খাবার দিতে হবে। শিশুকে নিয়মিত টিকা দিতে হবে। শিশুর মলমূত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। এতে ডায়রিয়া হওয়ার আশংকা অনেক কমে যাবে।
এরপরও যদি ডায়রিয়া হয়, সে ক্ষেত্রে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। যদি মলের সাথে রক্ত বা মিউকাস না যায়, যদি স্যালাইন ভালো করে দিতে পারি, ডায়রিয়া তিন থেকে চারদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : একিউট কিডনি ইনজুরি ছাড়াও অন্যান্য কিডনি রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণগুলো কী?
উত্তর : আরেকটি কিডনি বিকলের কথা বলি, ক্রনিক কিডনি ইনজিওর বা ধীরে ধীরে কিডনি বিকল। যদি জন্মগতভাবে বাচ্চার কিডনির রাস্তায় কোনো অসম্পূর্ণতা বা কোনো ত্রুটি থাকে, আমাদের বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রচলিত কারণ অবস্ট্রাকটিভ ইউরোপ্যাথি। যেমন : ছেলে বাচ্চাদের বেলায় মূত্রনালিতে একটি ছাঁকনি থাকে। সেই ছাঁকনি নিয়ে জন্ম নিলে বাচ্চার প্রস্রাব বের হতে পারে না। কিডনি সবসময় প্রস্রাব তৈরি করছে, তাই প্রস্রাব যদি বের না হতে পারে, সেই প্রস্রাব এসে মূত্রনালির মাধ্যমে মূত্রথলিতে জমা হচ্ছে, কিন্তু এই ছাঁকনি থাকার জন্য সেই প্রস্রাব বের হতে পারে না। বাচ্চা ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব করে। মূত্রথলিতে প্রস্রাব জমা হতে হতে সেই প্রস্রাব পেছন দিয়ে চলে গিয়ে কিডনিকে আক্রান্ত করতে পারে। এতে কিডনিতে সংক্রমণ হয়। সংক্রমণ হওয়ার পর কিডনিতে আস্তে আস্তে ঘা হয়ে ছোট হয়ে যায়। বাচ্চার রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং বাচ্চার কিডনি বিকল হয়ে যায়।
সুতরাং মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে— কোনো বাচ্চা যদি ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব করে, তলপেটে যদি চাকার মতো কিছু দেখা যায়; তখন পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্টের কাছে প্রথমে নিয়ে যাওয়া ভালো। অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসকের যদি অভিজ্ঞতা না থাকে বলে যে সারকামস্টেশন (খৎনা) করিয়ে দেন তাহলে বাচ্চা ভালো হয়ে যাবে। তবে তা ঠিক নয়।
প্রশ্ন : কিডনির সমস্যার সাধারণ লক্ষণগুলো কী?
উত্তর : কিডনি রোগের বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয় নেফ্রোটিক সিনড্রম। নেফ্রোটিক সিনড্রোমের খুব প্রচলিত লক্ষণ হলো দুই থেকে ছয় বছরের বাচ্চারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে বাচ্চার শরীরটা ফুলে যায়। প্রথম ফোলা মা খেয়াল করেন ঘুম থেকে ওঠার পর। মুখের চারপাশে পানি জমে যায়। কোনো মা যদি বুঝতে না পারেন, তখন তিনি ভাবেন বাচ্চার হয়তো শরীর ভালো হচ্ছে। অনেকে মনে করতে পারেন বাচ্চার অ্যালার্জি। এই ধরনের ভুল ধারণা হতে পারে। কিন্তু দেখা যায় দিন যত যেতে থাকে মুখের এই ফোলাটা বাড়ে। এরপর ফোলাটা সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। জ্বর, পেটে ব্যথা এগুলো দেখা যায়। এই লক্ষণগুলো দেখলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের শিশুদের কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে একটু বলবেন?
উত্তর : ঢাকা শহরে তিনটি হাসপাতালের মধ্যে শিশুদের কিডনি রোগের চিকিৎসা সীমাবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিশু হাসপাতাল আর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি অ্যান্ড ইউরোলজি। ইদানীং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালেও নতুনভাবে কিডনি রোগ বিভাগ স্থাপিত হয়েছে।
প্রশ্ন : কিডনি রোগে ট্রান্সপ্ল্যান্ট কখন করা হয়?
উত্তর : ক্রনিক কিডনি রোগের কিছু গ্রেড আছে। পর্যায় এক, দুই তিন, চার, পাঁচ এ রকম। পর্যায় পাঁচকে বলা হয় ইএসআরডি। বাচ্চার প্রস্রাব তৈরির ক্ষমতা প্রতি মিনিটে যখন ১৫ এমএলের নিচে নেমে আসে, তখন ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা ছাড়া বাচ্চার জীবন রক্ষা করা যাবে না। তবে ডায়ালাইসিস একমাত্র চিকিৎসা নয়। এটি সাময়িক চিকিৎসা। স্থায়ী চিকিৎসা হলো ট্রান্সপ্ল্যান্ট।