বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

Looks like you've blocked notifications!

প্রতিবছরের মতো ২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে পালিত হতে যাচ্ছে নবম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর ২ এপ্রিলকে সারা বিশ্বের জন্য অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে প্রতিবছর নিয়মিত তা পালিত হয়ে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, অটিজম লক্ষ্য ২০৩০ স্নায়ু বিকাশের ভিন্নতার একীভূত সমাধান। অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয় কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধিতাও নয়। তবে এর ব্যাপকতা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার সংক্ষেপে এএসডি হিসেবে নামাঙ্কিত করা হয়। 

অটিজমের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো- সামাজিকভাবে অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়, তারা তাদের আচার-আচরণের পুনরাবৃদ্ধি করে এবং কোনোকিছুতে সহজে যথেষ্ট আগ্রহ দেখায় না ইত্যাদি। আর এগুলো সাধারণত শিশু বয়সের অর্থাৎ দুই থেকে তিন বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা দিয়ে শুরু হয়ে থাকে। দেখা গেছে, তারা তাদের নাম ধরে ডাকলে সহজে সাড়া দেয় না, অন্য শিশুদের সঙ্গে কিংবা স্বাভাবিকের মতো অন্যের চোখে চোখে তাকায় না, খেলনার দিকে সহজে আকৃষ্ট হয় না, হাসি কিংবা অন্যান্য অঙ্গভঙ্গিতে সাড়া দেয় না, কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া না দেওয়া ইত্যাদি নানা ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। এর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। তবে এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক রকমের ডিসঅর্ডারের জন্য এমনটি হয়ে থাকে বলে অনুমান করছেন অনেকে। 

অপরদিকে জেনেটিক, নন জেনেটিক কিংবা পরিবেশগত কারণেও শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তবে ইদানীং চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য ও ধারণামতে মায়ের গর্ভাবস্থায় ঠিকমতো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবন করা না হলে কিংবা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার না খেলে গর্ভের শিশুদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হয় না বলে জানা গেছে। এখন আবার মিডিয়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে জিকা নামক এক প্রকার মারাত্মক ক্ষতিকর ভাইরাসের আক্রমণে গর্ভের শিশুদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট এবং অপুষ্ট হয়ে থাকার কথা প্রকাশিত হয়েছে। সেই জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ শিশুও অটিস্টিক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৩ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, সারা বিশ্বে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২১.৭ মিলিয়ন, ২০১০ সালের এক হিসাবে এ সংখ্যা সারা বিশ্বে প্রতি হাজারে এক বা দুজন। 

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১.৫ শতাংশ শিশুর মধ্যে অটিজম পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের ১৮ বছর বয়সী এবং তারও ওপরের বয়সীদের মধ্যে এর প্রবণতা ১.১%। তবে এ বিষয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য পাওয়া গেছে যে, ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি তা দিনদিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে দেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগই কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। তার মধ্যে আবার শতকরা এক ভাগ অটিস্টিক আক্রান্ত। তবে শিশু বয়সে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। অটিজম পুরোপুরি না হলেও তা একধরনের মানসিক রোগ। এখানে শারীরিক কোনো সমস্যা জড়িত নয়। অটিজমের সঙ্গে বিকাশগত অক্ষমতা ও নিউরো-বায়োলজিক্যাল ডিসঅর্ডার জড়িত। 

চিকিৎসা করালে অটিজমে আক্রান্তরা ভালো হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি একটি সাময়িক সমস্যা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা আস্তে আস্তে সেরে যায়। তবে এ থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠা কঠিন কাজ। মনে রাখতে হবে যে, এর ঘাটতি থেকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। তবে একই পরিবারের ভাইবোনদের মধ্যে একাধিকজনের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অটিজমে আক্রান্ত সব শিশুর সমস্যা প্রায় একই রকম। বাস্তবতা হলো এই যে, এএসডি আক্রান্ত উপসর্গ ও লক্ষণ বিভিন্ন রকমের। একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো মিল নেই। কোনো শিশুর যদি অটিজম শনাক্ত হয়, তাহলে তার পরিবারকে এ ধরনের কথা সহ্য করার মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে। কারণ নিউরনঘটিত যেকোনো ধরনের সমস্যা থেকেই উত্তরণ একটু সময়সাপেক্ষ। পুরোপুরি সুস্থ হওয়াটাও অনিশ্চিত। 

অটিজম শিশুর বাবা-মাকে এ রকম অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক সংগ্রাম করতে হয় তার পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে এমনকি নিজের সঙ্গেও। এসব বাবা-মাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হয় বিশেষ স্কুলগুলোকে। সংশ্লিষ্ট অটিস্টিক শিশুর বাবা-মা যাতে এমন স্বস্তি অনুভব করেন যে, তাদের সন্তানের স্কুল সহনশীল, উদার, ধৈর্যশীল এবং যেকোনো বিপদে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাই প্রতিষ্ঠানকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

রোগ নির্ণয়, আচরণ পরিমার্জন, সঠিক প্রশিক্ষণ, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ইত্যাদি অটিস্টিক শিশুদের সামগ্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ও স্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে হবে। তাদের প্রতিবাদ ও সীমাবদ্ধতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রমকে সম্পৃক্ত করতে পারলে এই শিশুরা বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারবে। বিশ্বের অনেক নামিদামি ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা কর্তৃক সমাজে পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে অনেক কাজ করার কথা শোনা যায় এবং যার অনেক প্রমাণও রয়েছে। 

আশির দশকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের বউ হয়ে আসা প্রিন্সেস ডায়নার কথা এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ব্রিটিশ রাজকীয় আরাম আয়েশকে তুচ্ছজ্ঞান করে, শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে কাজ করতেন অসহায় ও সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে। তাঁর সেই কাজের জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে অনেক নন্দিত ছিলেন। সে জন্য ১৯৯৬ সালে যখন তিনি ফ্রান্সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন, তখনো তিনি বিশ্ববাসীর অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছিলেন। আমাদের বাংলাদেশেও সে রকম ব্যতিক্রমধর্মী কাজের জন্য ভালোবাসার উদাহরণ সৃষ্টি হতে চলেছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য মেয়ে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে অটিজম বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন থেকে। তিনি অটিজম এবং নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার সম্পর্কিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবে কাজ করছেন। তা ছাড়া তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ২৫-সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের একজন সদস্য। 

২০১১ সালে সায়মা ওয়াজেদ ঢাকায় প্রথম দক্ষিণ এশীয় অটিজম সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। এ বিষয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এরই মধ্যে। অটিস্টিকদের উৎসাহ দেওয়ার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো ঈদকার্ড, নববর্ষের কার্ড ইত্যাদি আঁকিয়ে থাকেন কোনো না কোনো অটিস্টিক শিশুদের দিয়ে। অটিস্টিক যেহেতু এখন আস্তে আস্তে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে, সে জন্য এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য তাদের উপযোগী স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দরকার। এখন কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা একবারেই সীমিত এবং বেশির ভাগই বড় বড় নগর-মহানগর ও রাজধানীকেন্দ্রিক। আর সরকারি পর্যায়ে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। সে জন্য প্রতি উপজেলায় একটি না হলেও প্রাথমিকভাবে প্রতি জেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় অটিস্টিকদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। 

সেই সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়েও যাতে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে সেদিকে সহযোগিতার হাত সরকারকেই প্রশস্ত করতে হবে। তার বাইরে অন্যান্য যা করণীয় তা হলো- অটিজমকে শনাক্ত করে প্রতিটি অটিস্টিক শিশুর প্রতিভা ও সীমাবদ্ধতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম সম্পৃক্ত করতে পারলে এসব শিশু বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারে। তা ছাড়া অকুপেশনাল থেরাপি ও স্পিচ থেরাপি ইত্যাদি অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সামগ্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ও স্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অপরদিকে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সার্বিক উন্নতির জন্য স্কুল ও বাড়ির কাজের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। 

একটি শিশুর সর্বাঙ্গীণ উন্নতির ক্ষেত্রে বাবা-মাসহ পরিবারের সব সদস্যকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত হওয়া উচিত। তা ছাড়া দেশের প্রত্যেকটি সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদিতে অটিস্টিকদের জন্য একটি পরামর্শ ও প্রশিক্ষণমূলক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র চালু করা যেতে পারে। তাহলেই সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। আর তাই হোক এবারের এ বিশেষ দিবসের তাৎপর্যের প্রতিফলন। 
  
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়