মলদ্বার দিয়ে রক্ত গেলে কী করবেন?
সাধারণত জীবনযাপনের ধরনের কারণে মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়ার সমস্যা বেশি হয়। সব বয়সের মানুষেরই এ সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যা হলে হেলাফেলা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আজ মঙ্গলবার (২৪ মার্চ-২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৮৪তম পর্বে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন ইবনে সিনা হাসপাতালের লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুব রহমান।
প্রশ্ন : মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়া বিষয়টি বলতে আসলে কী বুঝি?
উত্তর : মানুষের পায়খানার রাস্তা দিয়ে আলাদাভাবে বা পায়খানার সঙ্গে মিশে রক্ত যাওয়াকে আমরা মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়া বুঝি।
প্রশ্ন : কী কী কারণে এই মলদ্বার দিয়ে রক্ত যায়?
উত্তর : কারণগুলো সাধারণত বয়সভিত্তিক হয়। শিশুদের যে কারণে মলদ্বার দিয়ে রক্ত যেতে পারে তা হলো, রেকটাল পলিপ বা কোলনিক পলিপ। মধ্য বয়সীদের মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে অশ্বরোগ বা হেমোরয়েড। এ ছাড়া মলদ্বার ফেটে যাওয়া বা এনাল ফিশার রয়েছে। এর পাশাপাশি রক্ত যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে রেকটাম ও কোলনিক ক্যানসার। মধ্য বয়সে এই রোগগুলো বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া বৃহদন্ত্রে যদি প্রদাহ হয়ে থাকে অথবা বৃহদন্ত্রে যদি কোনো সংক্রমণ হয়ে থাকে, তাহলেও মধ্য বয়সে মলদ্বার দিয়ে রক্ত যেতে পারে।
একটু বয়স্ক লোকদের মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়ার অন্যতম কারণের মধ্যে কোলরেকটাল ক্যানসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বৃহদন্ত্রে যদি কারো রক্তস্বল্পতা বা রক্ত চলাচল কমে যায়, তখন মলদ্বার দিয়ে রক্ত যেতে পারে। এ ছাড়া ডাইভারটিকুলাইটিস বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ রয়েছে, যা বয়স্ক লোকদের হয়ে থাকে; এসব কারণেও সাধারণত মলদ্বার দিয়ে রক্ত যায়।
প্রশ্ন : কী কারণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেটি বোঝার কোনো লক্ষণ রয়েছে?
উত্তর : মলদ্বার দিয়ে যে কারণে রক্ত যাক না কেন, এটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। রোগীদের এটা প্রথমেই বুঝতে হবে। আমরা সাধারণত মলত্যাগের পর লক্ষ করি না যে মলদ্বার দিয়ে রক্ত গেল কি না। তবে এ বিষয়টি লক্ষ করা উচিত। মলদ্বার দিয়ে রক্ত গেলে এটাকে স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে, হাতের কাছের স্থানীয় চিকিৎসকদের না দেখিয়ে, সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি আমরা।
সে জন্য যে উপসর্গগুলোর দিকে খেয়াল করতে হবে সেগুলো হলো : পায়খানা যাওয়ার যে অভ্যাস ছিল, সেটি পরিবর্তন হয়ে গেছে কি না; জ্বর হয় কি না অথবা কারো শরীরে রক্তস্বল্পতা বা পানিস্বল্পতা হচ্ছে কি না; ওজন কমে যাচ্ছে কি না; খাওয়া-দাওয়ার অরুচি তৈরি হচ্ছে কি না; পেটে চাপ দিয়ে দেখলে কোনো জায়গায় চাকার অনুভূতি হয় কি না। এই উপসর্গগুলো যদি রোগী দেখে, তাহলে বুঝতে হবে পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটাকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এবং দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : শিশুদের মলত্যাগের অভ্যাস ঠিকমতো না হলে বা এনাল ফিশারের ক্ষেত্রে কী করা উচিত?
উত্তর : শিশুদের ক্ষেত্রে বা অল্প বয়সের ক্ষেত্রে বিশেষত, বয়ঃসন্ধি বয়সের ক্ষেত্রে পায়খানার অভ্যাস তৈরি করা দরকার। এ জন্য নিয়মিত টয়লেট অভ্যাস (রেগুলার টয়লেট হেবিট) বলে আমরা একটা টার্ম ব্যবহার করি, যেটা ধীরে ধীরে অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। এটা না হওয়ার কারণে এনাল ফিশার বা হেমোরয়েড বেশি পরিমাণে হচ্ছে। এ অভ্যাস তৈরি না হওয়ার পেছনে মা-বাবার ভূমিকা আছে এবং বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়েদেরও ভূমিকা রয়েছে। এর কারণ, পরিমাণমতো পানি না খাওয়া; পরিমাণমতো শাকসবজি না খাওয়া। তারা ফাস্টফুড বেশি খায়। এ ছাড়া আমরা যারা শহরে বাস করি, তাদের বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকতে হয়। সেখানে টয়লেটের যথেষ্ট পরিমাণ সুবিধা নেই। যে টয়লেটগুলো আছে, সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে মল আটকে রাখতে হয়, যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য বা কষার সমস্যা হয়। এ সময় সে যখন চাপ দিয়ে মলত্যাগ করতে চায়, তখনই মলদ্বার ফেটে যায়। এবং এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশু ও বয়ঃসন্ধি বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। যখন মলদ্বার ফেটে যাবে, তখনই সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা হবে। যখন ব্যথা হবে, তখন সে আর টয়লেটে যেতে চাইবে না। তখন একটা ভয় তৈরি হয়। এই সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
প্রশ্ন : এ জাতীয় সমস্যা হলে কী করণীয়? শুধু কি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে, নাকি সঙ্গে কোনো ওষুধ নিতে হবে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে যে পরামর্শগুলো দিয়ে থাকি তা হলো, পরিমাণমতো পানি খাওয়া, নির্দিষ্ট পরিমাণ সবজি খাওয়া, প্রতিদিনই অন্তত একবার টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস করা। টয়লেটে যাওয়ার সময়টিও নির্দিষ্ট করা আছে। সকালে নাশতা করার আধা ঘণ্টা পরে টয়লেটে গিয়ে ১০ মিনিট সময় কাটিয়ে আসতে হবে। তাহলে তার অভ্যাস নিয়মিত তৈরি হবে। আর যার নিয়মিত অভ্যাস তৈরি হবে, তার এই রোগগুলো হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।
একটি বিষয় যোগ করতে চাই, মলদ্বার দিয়ে রক্ত পড়াকে জনগণ স্বাভাবিকভাবে নিয়ে থাকে। এর ফলে একসময় আমাদের কাছে যখন রোগীরা পৌঁছে, তখন পরীক্ষা করে দেখি আসলে তার একটি মারাত্মক রোগ হয়েছে এবং সে চিকিৎসা নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছে।
একজন রোগীর কথা উল্লেখ করতে পারি, লেখক হুমায়ূন আহমেদ। উনার যে ক্যানসারটি হয়েছিল, সেটি কোলরেকটাল ক্যানসার। এবং সেটি অনেক পরে ধরা পড়েছে, যার কারণে উনাকে আর চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাই মলদ্বার দিয়ে এক বা একাধিকবার রক্ত গেলে পরীক্ষা করা জরুরি এবং একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কারো কাছে গেলে আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তখন চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যায়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মলদ্বার দিয়ে রক্ত গেলে কারণটা আমাদের জানা থাকতে হবে। সেটা যে কারণেই হোক না কেন, রোগটা অবশ্যই নির্ণয় করতে হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে।