ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ কী
ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ একটি জটিল রোগ। ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি কারণে হার্ট ডিজিজ হয়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৯৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. শফিকুর রহমান পাটওয়ারী। বর্তমানে তিনি হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা আইএসডি বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?
উত্তর : ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা করনারি আর্টারি ডিজিজও বলা হয়ে থাকে। আমাদের হার্টে পুষ্টি ও রক্ত প্রবাহের জন্য কিছু রক্তনালী থাকে। সেই রক্তনালী হার্টের পুষ্টি ও রক্ত সরবরাহ করে থাকে। এর মাধ্যমে হার্ট পাম্প করে থাকে এবং সারা শরীরে রক্ত প্রবাহ হয়ে থাকে। হার্টের পুষ্টি ও রক্ত সরবরাহের যদি কনো সমস্যা হয়, মানে তার রক্তনালীতে যদি কনো ব্লক হয়, কোলেস্টেরল জমার জন্য সাধারণত ব্লক হয়ে থাকে, ব্লক হলে রক্ত চলাচল কমে যাবে, তারপর বুকে ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের রোগকে আমরা বলে থাকি যে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা করনারি হার্ট ডিজিজ।
প্রশ্ন : এর কারণগুলো কী?
উত্তর : ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা করনারি হার্ট ডিজিজের কারণ হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ একটি অন্যতম কারণ। ধূমপান, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি। এ ছাড়া পারিবারিক ইতিহাস যদি থাকে তাদেরও হার্টের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বয়সও একটি কারণ। যেমন ৪৫ বছর পুরুষ রোগীর ক্ষেত্রে, আর নারীদের ক্ষেত্রে ৫৫ বছরের বেশি হলে হার্টের ব্লক হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন : এই রোগের লক্ষণগুলো আসলে কী?
উত্তর : ইসকেমিক হার্টের রোগের লক্ষণ হলো বুকে ব্যথা। বুকের মাঝখান বরাবর ব্যথা হয়। অনেকে বলে এনজাইনাল পেইন বা বুকের মাঝখানে চাপা ব্যথা, তীব্র ব্যথা হতে পারে। সেই ব্যথা অনেক সময় বাম হাতে চলে যেতে পারে। অথবা ডান হাতেও আসতে পারে। অনেক সময় চোয়ালে, ঘাড়ে, বুকের পেছনে, পেটের ওপরের অংশেও ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথার সাথে অনেক সময় খুব বেশি ঘাম থাকে, অনেক সময় শ্বাসকষ্ট, বুক ধরফর করা, এ ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। কখনো কখনো যখন হার্ট অ্যাটাক হয়, তখন তীব্র ব্যথা থাকে। তখন মনে হচ্ছে যেন এখনই মারা যাবে। এই ধরনের অনুভব হতে থাকে। ব্যথার তীব্রতা অনেক বেশি থাকে।
আর হার্ট অ্যাটাক না থাকলে ব্যথার ধরনটা হয়, কাজ করার সময় ব্যথা এলো। আবার বিশ্রাম নিলে ব্যথাটা চলে যাচ্ছে। অথবা নাইট্রোগ্লিসারিন নামক একটি স্প্রে আছে, এটি যদি জিহ্বার নিচে দেওয়া হয় ব্যথা সাথে সাথে চলে যাচ্ছে। এই ধরনের ব্যথা যদি থাকে আমরা সন্দেহ করব তার হার্টে সমস্যা আছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা কিছু পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে এটি নির্ণয় করব।
প্রশ্ন : সেই পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো সম্বন্ধে একটু বলুন?
উত্তর : প্রথমে বুকে ব্যথা হলে সবাই একটি ইসিজি করেন। ইসিজি করে দেখেন হার্টে কোনো ব্লক আছে কি না। এ ছাড়া রক্তে কিছু পরীক্ষা আমরা করি। যেমন টফোনিনাই বা সিকেএমবি। এ ছাড়া অনেক পরীক্ষা বর্তমানে আসছে। হার্টের সমস্যা নির্ণয় করার জন্য ইকো কার্ডিওগ্রাম, সিটি এনজিওগ্রাম করা যায়। এ ছাড়া করনারি এনজিওগ্রাম করা যায়। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হই যে হার্টে কোনো ব্লক আছে কি না।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে রোগীদের কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে বলবেন, ব্যথা শুরুর সাথে সাথে না কি ব্যথার প্রকৃতি বুঝে এরপর?
উত্তর : আসলে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের কয়েকটি উপস্থাপন থাকে। একটি হলো স্ট্যাবল হার্ট ডিজিজ। আরেকটি হলো আনস্ট্যাবল হার্ট ডিজিজ। স্ট্যাবল হার্ট ডিজিজ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা করতে হবে। আর আনস্ট্যাবল যখন হবে, যেমন তীব্র ব্যথা থাকলে, অনেক বেশি ব্যথা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিতে হয়। একে আমরা হার্ট অ্যাটাকও বলে থাকি।
হাসপাতালে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। করনারি এনজিওগ্রাম করে ব্লকটাও সরাসরি দূর করা সম্ভব।
প্রশ্ন : চিকিৎসা পদ্ধতি কী এই রোগের ক্ষেত্রে?
উত্তর : এখানেও আমরা জীবন যাপনের পরিবর্তনের কথা বলি। যেমন, ধূমপান করে থাকলে সেটি বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ডায়াবেটিস থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকলে এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর সাথে আরো কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। যেমন কিছু মেডিসিন দেই। মেডিক্যাল ম্যানেজম্যান্ট করি। কখনো কখনো ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে সাথে আরো কিছু বিষয় যোগ করতে হয়। যেমন এনজিওগ্রাম করে রিং লাগানো। অথবা কখনো কখনো বাইপাসের প্রয়োজন পড়ে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন, কিছু ওষুধের প্রয়োজন, কখনো রিং লাগানোর প্রয়োজন হচ্ছে, কখনো বাইপাসের প্রয়োজন হচ্ছে।
প্রশ্ন : সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বাইপাস বা ওপেন হার্টের ক্ষেত্রে কিছু ভীতি কাজ করে। এই বিষয়ে আপনারা কীভাবে আশ্বস্ত করেন?
উত্তর : এখন যদি হার্টে ব্লক থাকে আর সেই ব্লক যদি ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব না হয় অথবা রিং লাগানোর মাধ্যমে যদি সম্ভব না হয় সেই ক্ষেত্রে বাইপাস করার জন্য যদি ভালো রক্তনালী থাকে তাহলে বাইবাস করতে হয়। আর বাইবাস না করে তো তখন উপায়ও নেই। সেই ক্ষেত্রে বাইপাসই করতে হবে। ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বর্তমানে মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ৩০ শতাংশ লোক এতে মারা যাচ্ছে। আর ৮০ ভাগ মৃত্যু হয় হাসপাতালে পৌঁছার আগেই। আর হাসপাতালে আসার পরও ৭০ শতাংশ লোকের মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এটি একটি জটিল রোগ। সেই ক্ষেত্রে যদি বাইপাসের প্রয়োজন হয় সেটি তো করতে হবেই।
প্রশ্ন : বাইপাস বা ওপেন হার্ট সার্জারি এখন বাংলাদেশে কী রকম হচ্ছে?
উত্তর : বাইপাস সার্জারি বাংলাদেশে হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি অনেক হাসপাতাল আছে যেখানে বাইপাস সার্জারি হচ্ছে। খুব ভালোভাবেই আমাদের দেশে বাইপাস সার্জারি হচ্ছে। এর জন্য বর্তমানে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন : এই ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার পরবর্তী কোনো ঝুঁকি আছে কী?
উত্তর : আসলে আমরা যদি বাইপাসের কথা বলি সবাই মনে করে হার্ট অ্যাটাক হলেই বুঝি বাইপাস করতে হয়। আসলে বিষয়টি এ রকম নয়। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরও দেখা যায় যে ওষুধের মাধ্যমে অনেক রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। যেমন স্ট্যানটিং করা হয়। এতে মাত্র পাঁচ মিনিট বা কখনো আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টার মধ্যে স্ট্যানটিং করা যায়। দেখা যায়, রোগী দুই তিন দিন পরই কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে চলে যেতে পারে। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই যেসব রোগীরই বাইপাস করতে হবে। খুব কম পরিমাণ রোগীরই বাইপাসের প্রয়োজন হয়। আর বাইপাস বা রিং লাগানোর পরও রোগীকে কিছু ওষুধ নিয়মিত খেতে হবে। আবার কিছু উপদেশ দিয়ে থাকি আমরা সবসময়। যার উচ্চ রক্তচাপ থাকে তার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আনতে হবে। ধূমপায়ী থাকলে ধূমপান অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোলেস্টেরল জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। সেখানে সবজির পরিমাণ বেশি থাকবে। ফল বেশি থাকবে। লবণ কম থাকবে। এইভাবে খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন আনা, ওষুধ নিয়মিত খাওয়া, এইভাবে থাকলে দেখা যায় রোগী ভালোই থাকে।
প্রশ্ন : নিয়মিত ফলোআপের প্রয়োজন কতটুকু?
উত্তর : অবশ্যই ফলোআপে থাকতে হবে। হৃদরোগটা হচ্ছে সারা জীবনের রোগ। এই রোগ সম্পূর্ণ ভালো হচ্ছে না। যেই চিকিৎসাগুলো আছে সেগুলো তার ভালো থাকার জন্য। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়মিত নিতে হবে। সমস্যা হলে সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর সমস্যা না হলে স্ট্যাবল হওয়ার পর, কখনো কখনো ছয় মাস পর চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসক যেভাবে বলবেন সেভাবে আসতে হবে।