বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ও নিরাপদ খাদ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ (৭ এপ্রিল)। এ উপলক্ষে এনটিভিতে প্রচারিত হয় স্বাস্থ্য প্রতিদিন (১৯৯৮ তম পর্ব) অনুষ্ঠানের বিশেষ পর্ব। এই পর্বে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডব্লিউএইচও বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক।
প্রশ্ন : আমরা জানি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ৭ এপ্রিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আমরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এই দিনটিকে উপলক্ষ করে সারা পৃথিবীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশেও এটি ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে। এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মূল প্রতিপাদ্য (থিম) বা ক্যাম্পেইন কী নির্ধারণ করেছে?
উত্তর : ফুড সেফটি অ্যান্ড সেফটি টু হেলথ (খাদ্য নিরাপত্তা ও সুস্থ জীবন)—এটিই হলো এ বছরের প্রতিপাদ্য। এ বিষয়ের ওপর সারা বিশ্বে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই একে প্রতিপাদ্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন : ফুড সেফটি, অর্থাৎ নিরাপদ খাদ্য। উৎপাদন বা চাষের অবস্থা থেকে একদম থালা পর্যন্ত খাদ্যটি যেন নিরাপদ থাকে। আমরা খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারি কী করে?
উত্তর : আপনি সুন্দর বলেছেন, নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তা দিতে পারে নিরাপদ স্বাস্থ্যের। আমরা নিশ্চিত করব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য, যেটা নাকি ফার্মে উৎপাদিত হয়ে আমার থালায় আসবে। ফার্ম থেকে থালা—এ পর্যন্ত যেকোনো জায়গায় খাদ্যটা যদি অনিরাপদ হয়, সেই জায়গাটায় নিরাপদ কীভাবে করা যায় তা নিয়েই ডব্লিউএইচও কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে। ডব্লিউএইচও যেমন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে, তেমনি আরো দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে কাজ করছে। একটি হলো এফএও, যেটা ইউএনের প্রতিষ্ঠান। আরেকটি হলো অ্যানিমেল অর্গানাইজেশন। এই তিনটি একত্রে কাজ করে।
প্রশ্ন : হয়তো উৎপাদন থেকে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত খাদ্য বিভিন্নভাবে অনিরাপদ হয়ে ওঠে। সাধারণত খাদ্য কীভাবে অনিরাপদ হয়ে ওঠে?
উত্তর : প্রথমত, কৃষক যাঁরা খাদ্য উৎপাদন করে থাকেন, বিশেষ করে সার হিসেবে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করে থাকেন, সে জায়গাটায় তাদের যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকে যে কী পরিমাণ সার দেওয়া নিরাপদ, তারা যদি নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি সার প্রয়োগ করে, তখন খাবারে কেমিক্যাল মিশে যায়। এটি খুব ক্ষতিকারক দিক। অনেক সময় অধিক উৎপাদনের জন্যও কেমিক্যাল ব্যবহার করে। এসব কীটনাশক, সার যখন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করবে, তখন সেটি ক্ষতিকর হয়ে যাবে। যেমন প্রিজারভেটিভ, এটা বেশি ব্যবহার করলে খাবার অনুপযোগী হয়ে যাবে।
এটা তো মাঠ পর্যায়ে হলো। তবে এখান থেকে খাদ্যাটা উৎপাদন করার পরও ভেজাল হতে পারে। ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার জন্য নানা রকম প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করে। খাদ্য সংরক্ষণের জন্য যেসব জিনিস ব্যবহার করে তাও ক্ষতিকর। যেমন : ফরামালিন; এটি বেশ আলোচিত একটি বিষয়। অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের রং ব্যবহার করে সুন্দর করার জন্য; আকর্ষণীয় করার জন্য।
এসব কারণে খাদ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়, অর্থাৎ যেখানে রান্না হয়, সেখানেও যদি পরিমাণমতো জিনিস না দেওয়া হয়, অতিরিক্ত দেওয়া হয় সমস্যা হয়। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর প্রস্তুত প্রক্রিয়ার কারণে সেখানে নানা রকম জীবাণু হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন : কেবল বাইরে থেকে এসব জিনিস মেশালেই খাবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটি নয়। রান্নার সময় সঠিকভাবে রান্না না করলে পুষ্টির দিকও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে...।
উত্তর : আমরা দুটি কথা বলি। একটি হলো, পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার (সাফিশিয়েন্ট) হতে হবে। আরেকটি হলো পুষ্টিসম্পন্ন (নিউট্রিশিয়েন্ট) হতে হবে। আমাদের প্রথমে দেখতে হবে খাবারটা নিরাপদ, পর্যাপ্ত, পাশাপাশি পুষ্টিমানসম্পন্ন। আমাদের যেমন শরীরে চর্বি প্রয়োজন আছে, তেমনি ক্যালরি প্রয়োজন আছে, ভিটামিন এবং মিনারেল পরিমাণমতো থাকার প্রয়োজন আছে। এ জায়গায় যদি কোনো ঘাটতি হয়, তাহলে পুষ্টিগত ঘাটতি হবে।
প্রশ্ন : ডব্লিউএইচওর পরিসংখ্যানমতে দূষিত খাদ্য ও পানিবাহিত দুশোর ওপরের রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। সাধারণত দূষিত এসব খাদ্য দ্বারা কী কী রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়?
উত্তর : বাংলাদেশে প্রচুর লোক মারা যায় অনিরাপদ খাদ্যের জন্য। আমরা যদি সাধারণভাবে বলি, জীবাণু সংক্রমিত কিছু রোগ হয়। তার প্রতিফলন এবং উপসর্গ আমরা ডায়রিয়ার মাধ্যমে দেখতে পাই। যখন ডায়রিয়ার মাধ্যমে হয়, তখন পাশাপাশি মানুষের জ্বর হয়, বমি হয়। এ ছাড়া কলেরা হয়। পাশাপাশি আরো কিছু রোগ আছে, যা ভাইরাসের মাধ্যমে হয়।
ভেজাল খাদ্য এবং পানিবাহিত রোগে বেশির ভাগ মারা যায় শিশুরা ও বয়স্ক লোকেরা। তাদের ব্যাপারে আমাদের যেমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, এর পাশাপাশি দেখতে হবে জীবাণুটা সংক্রমণের কারণ। এসব জীবাণু যখন কোনো এলাকায় সংক্রমণ করে, তখন সঠিকভাবে খুঁজে দেখতে হবে কোন কারণে এটি হচ্ছে। তখন যদি এটাকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি, অনেক লোককে বাঁচাতে পারব।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে খাদ্যে কেমিক্যাল মেশানোর বিষয়টি ব্যাপকভাবে বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এটা রোধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বা ভোক্তা হিসেবে আমরা কী করতে পারি?
উত্তর : বাংলাদেশে যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপযুক্ত কাজ করার পরিবেশ আনতে হয়, সেখানে সরকারকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। আর যারা এ বিষয়ে কাজ করছে, পরিবেশগত বিষয় এবং খাদ্য নিয়ে কাজ করছে, তাদের এ বিষয়ে যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। এই তিন দলের লোককে যদি আমরা সমন্বয় করে কাজটি করতে পারি, তাহলে ভালো হয়। আর ডব্লিউএইচও এরই উৎসাহ দেয়। মানুষের সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কাজ করে, যেমন—এফএও কাজ করছে আমাদের দেশের পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটে গবেষণাগার নিয়ে, তারা একটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গবেষণাগার করেছে। এদের উন্নয়নের মাধ্যমে যদি কাজ করা যায়। এবং কাজটা যদি এই হয়, আমরা এ ধরনের রোগ প্রতিরোধ করব, মৃতের সংখ্যা যেমন কমাব, পাশাপাশি এই রোগগুলোর মাধ্যমে যেটা সবচেয়ে বেশি হয় ম্যালনিউট্রিশন বা অপুষ্টি, সেটা কমাব, তাহলে অনেকাংশে খাদ্যজনিত রোগগুলো হয়তো কমানো যাবে।
এই অপুষ্টি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। খাবারের সমস্যার কারণে একজন মা যদি অপুষ্টিতে ভোগে, সেটা কিন্তু শিশুর ক্ষতি করে। শিশু জন্মের পর সে কম ওজনের হবে এবং অপুষ্টির কারণে ভুগবে, বেঁটে হবে। এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। বুদ্ধি যতটুকু হওয়ার কথা ছিল, সেটিও কম হবে। তাই খাদ্য নিরাপদ রাখার জন্য সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।