অন্ধত্বের মূল কারণ কী?
চোখে অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ ছানি পড়া। তবে আমাদের দেশে এখন এর সর্বাধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা রয়েছে। আজ ৮ এপ্রিল এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৯৯তম পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশ আই হাসপাতালের ফ্যাকো ও গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
প্রশ্ন : চোখের ছানি অনেকের কাছে খুব পরিচিত একটি শব্দ। শুরুতেই একটু জানতে চাই চোখের ছানি বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?
উত্তর : চোখের ছানি অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ। অনেকেই মনে করেন ব্যথাহীন চোখের একটি পর্দা পড়েছে। কিন্তু জানতে হবে পর্দাটা কোথায় পড়েছে। আমরা যদি ক্যামেরার সঙ্গে চোখকে তুলনা করি, ক্যামেরায় যেমন লেন্স থাকে তেমনি চোখেরও একটি লেন্স রয়েছে। ভালো শক্তিশালী লেন্স। এই লেন্সের সাহায্যে আমাদের দেখার সময় আলোটা ফোকাস করে রেটিনার ওপর পড়ছে, সেখান থেকে আলো বৈদ্যুতিক উত্তেজনা (ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন) তৈরি করে মস্তিষ্কে যাচ্ছে। এই যে আলোটা যাচ্ছে এর মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে কর্নিয়া, লেন্স। এই লেন্সটা হলো স্বচ্ছ (ট্রান্সপারেন্ট)। এর মধ্যে রক্ত সরবরাহ নেই। সাধারণত চোখের ভেতর যে পানি আছে, এটি থেকে পুষ্টিটা নিয়ে নেয়। ফলে এটা ঘোলা হয় না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই লেন্সে বিভিন্ন বিপাকীয় জিনিস (মেটাবোলিক প্রোডাক্ট) জমতে জমতে ঘোলা হতে শুরু করে। এই যে লেন্সটা ঘোলা হলো এর নাম চোখের ছানি।
প্রশ্ন : কোনো বয়স্ক মানুষ যদি চোখে কম দেখা শুরু করেন বা ঘোলা দেখা শুরু করেন, তিনি কি বুঝে নেবেন তাঁর চোখে ছানি পড়েছে?
উত্তর : আমি মনে করি এই কথাটা একদম ঠিক না। এই বয়সে চোখের আরেকটি রোগ রয়েছে গ্লুকোমা। এই রোগেও সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরাও কিন্তু চোখে কম দেখে। কিন্তু চোখের ছানির সুবিধা হলো যখন রোগী আসেন চিকিৎসকের কাছে তখন অস্ত্রোপচার করলে রোগটা একদম ভালো হয়ে যায়। কিন্তু গ্লুকোমায় তার বিপরীত। কারণ গ্লুকোমায় চোখের ভেতরের স্নায়ুটা (নার্ভ) ক্ষয় হতে থাকে। স্নায়ুটা ক্ষয় হতে হতে যখন একেবারেই ক্ষয় হয়ে যায়, তখনই ব্যক্তি কম দেখেন। তখন যদি ব্যক্তি চিকিৎসকের কাছে এসে চিকিৎসা শুরু করেন, তাহলে যেটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে সেটি আর ফেরত আসবে না। যে অংশটুক ভালো আছে, কেবল সেই অংশের রক্ষা করা যাবে, চিকিৎসা করা যাবে। তাই যদি কোনো বয়স্ক মানুষ চোখে হয়তো দেখছেন না, হয়তো ভাবছেন ছানি হয়েছে এটি ধারণা করা ঠিক নয়। উনি একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখাবেন, তখন চিকিৎসক বলে দেবেন তাঁর ছানি হয়েছে না গ্লুকোমা হয়েছে।
প্রশ্ন : ছানি পড়া-সংক্রান্ত সব চিকিৎসা আমাদের দেশে খুব সহজেই আপনারা করছেন...
উত্তর : অবশ্যই। আপনি জেনে খুশি হবেন বিশ্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা লেজার সেটাও আমাদের দেশে হচ্ছে। সব ধরনের অস্ত্রোপচার ভালোভাবে হচ্ছে। তবে একটি কথা বিশেষভাবে বলে নেই ছানির একমাত্র চিকিৎসাই অস্ত্রোপচার।
প্রশ্ন : অনেকে রোগীই অস্ত্রোপচারের নাম শুনলে ভয় পায়। কী পরামর্শ তাদের ক্ষেত্রে?
উত্তর : আমরা সবাই অস্ত্রোপচারের নাম শুনলে ভয় পাই। আমারও যদি অস্ত্রোপচার করা হয় তবে হয়তো ভয় লাগতে পারে। এটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন : তাদের ভয় কমার জন্য কী পরামর্শ...
উত্তর : আমি আগে একটু বলে নিই, চোখের লেন্স ঘোলা হয়ে গেলেই কিন্তু ছানি পড়ে। আর এর চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার। কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি যে ওষুধের মাধ্যমে ছানিটাকে প্রতিকার করব। আমরা যেটা করি, লেন্সটাকে প্রতিস্থাপন (রিপ্লেস) করি। লেন্সটাকে বের করে নিয়ে আসি সেখানে একটা কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দিই।
তবে এই বের করার পদ্ধতির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। একটি হলো ইসিসি, এটি অনেক বছর আগে আমরা করতাম, এখানে চোখের পাশে প্রায় ১০ মিলিমিটার কাটা হতো। চোখের ভেতর থেকে লেন্সটাকে বের করতাম, একটি কৃত্রিম লেন্স সেখানে বসানো হতো। আট–দশটা সেলাই করা হতো। এখন সাধারণত এই পদ্ধতির অস্ত্রোপচার কম করা হয়। এখন এসেছে এসআইসিএস (স্মল ইনশিসন ক্যাটার্যাক্টস সার্জারি)। এটাও ভালো। এখানে আমরা কাটার অংশটুকু কমিয়ে ছয় মিলিমিটার করে ফেলেছি। ঘোলা লেন্সকে বের করে দিয়ে আবার একটি লেন্সকে প্রতিস্থাপন করছি। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় না। হলেও একটি বা দুটো সেলাই করতে হয়।
এরপর রয়েছে ফেকো সার্জারি। দুই মিলিমিটার বা তিন মিলিমিটার কেটে আমরা ফ্যাকো মেশিনের সাহায্যে আল্ট্রাসনিক ওয়েভের মাধ্যমে চোখের লেন্সটাকে গলিয়ে ফেলি। গলিয়ে সেটাকে ওই ছিদ্র দিয়েই বের করে ফেলি। এই ফ্যাকো সার্জারি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। বর্তমানে এটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটার্যাক্ট সার্জারি বা স্বর্ণমানের ছানির অস্ত্রোপচার।
আমাদের লেন্সটা ছয় মিলিমিটারের থেকে বড় কিন্তু এখানে কাটছি দুই মিলিমিটার। তাহলে কীভাবে এটা ঢুকবে। সে ক্ষেত্রে আমরা ভাঁজ করা যায় এমন লেন্স বা ফোল্ডেবল লেন্স ব্যবহার করি। ভাঁজ করার পরে দুই মিলিমিটার দিয়েই আমরা চোখের ভেতরে প্রবেশ করাতে পারছি। চোখের ভেতরে যাওয়ার পরে এটি সুন্দর মতো ছড়িয়ে বসে যাচ্ছে। তখন ইচ্ছা করলে আমিও আর বের করতে পারব না। এটা হলো ফ্যাকো সার্জারির সৌন্দর্য। এরপর রোগী তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম খুব সহজেই করতে পারেন।
আরেকটি হচ্ছে লেজার, এই সার্জারির আরেকটি নাম লেজার ফ্যাকো। এটি ফ্যাকোই তবে কিছু কিছু পর্যায় আমরা লেজারের সাহায্য নিই।
প্রশ্ন : লেজারের মাধ্যমে করলে কী উপকারিতা পাওয়া যায়?
উত্তর : ফ্যাকো সার্জারিতে যেটা করি দুই মিলিমিটার ইনসিশন দিই, চোখের ভেতর ঢুকি। ঢোকার পর লেন্সের ওপরে পর্দা গোল করে কাটি, যেটার সাইজ হবে ৫.৫ মিলিমিটার। তারপর আমরা লেন্সের ভেতর যে নিউক্লিয়াস বা শক্ত অংশ রয়েছে সেটাকে দুই ভাগে, চার ভাগ, ছয় ভাগ, আট ভাগ করি। এরপর এটাকে বের করে নিয়ে আসি। তাহলে কথা হলো লেজারের কাজ কী?
লেজারের কাজে প্রথম থেকেই আসি, ছুরির বদলে কাটার কাজ করা হচ্ছে লেজারের মাধ্যমে। কোনো ছুরি ব্যবহার করা লাগছে না। ভেতরে যে ৫.৫ মিলিমিটার কাটা দরকার, যেটা ছুরির মাধ্যমে করতাম, এটা অনেক সময় হাত দিয়ে করলে সঠিক পরিমাণে হয় না। এটা লেজারের মাধ্যমে করলে সঠিক হয়। লেজার দেওয়া হয় একটি কম্পিউটারের সাহায্যে। আমি যতটুকু পরিমাপ করছি, ঠিক ততটুকু হবে। ম্যানুয়ালি যেটা করা সম্ভব ছিল না, সেটি এখন পুরোপুরি করা সম্ভব।
আমরা বলতে পারি, লেজার ক্যাটারেক্ট সার্জারি একটি আধুনিক সার্জারি। যেটার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে সার্জারি করতে পারি। সবচেয়ে সুখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এটা পাচ্ছে, এতে আমরা খুব গর্ববোধ করি। যেসব রোগীরা এই সার্জারি করেছেন তাঁরা বেশ সুখী।