শিশুদের কিডনিরোগ, প্রতিরোধ
অনেকের ধারণা কেবল বয়স্কদের কিডনি রোগ হয়। তবে শিশুদেরও কিডনি রোগ হতে পারে। এর ফলে চিরতরে কিডনি নষ্টও হয়ে যেতে পারে। আজ ৯ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানে ২০০৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোলাম মাঈন উদ্দিন।
প্রশ্ন : ছোট বয়সেই একটি শিশু কী কী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়? সাধারণত কোন কোন কিডনি রোগ হয়ে থাকে?
উত্তর : আমাদের ধারণা কেবল বয়স্কদের কিডনি রোগ হয়। কিন্তু শিশুদেরটাও জানা দরকার। কারণ বাচ্চারা কথা বলতে পারে না। কিছু কিছু কিডনি রোগ জন্মগত, বংশগত হয়। বাচ্চা পেটে থাকাকালীন উন্নত বিশ্বে আলট্রাসনোগ্রাম করে সমস্যা দেখলে আগেই ডেলিভারি করে ফেলে।
হাইড্রোনেফরোসিস একটি প্রচলিত রোগ। এটা আমাদের দেশে যে কেউ আলট্রাসনোগ্রাফি করে বুঝতে পারে। আগে নির্ণয় করা গেলে হাইড্রোনেফরোসিস থেকে কিডনি বিকল হওয়া রোধ করা যাবে। অনেক সময় দেখা যায় ডায়ারিয়া-ডিসেন্ট্রির পর কিডনি আর কাজ করছে না। মায়েরা হয়তো ওষুধ খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু প্রস্রাব যে বন্ধ, এই জিনিসটি অনেক চিকিৎসকও বলেন না। তাই ডায়রিয়া হলে, অথবা যেকোনো কারণে বমি বা রক্তক্ষরণ হলে আমরা বলি বেশি পানি খাওয়াতে, প্রয়োজন হলে স্যালাইন খাওয়াতে, কারণ বুঝে চিকিৎসা করাতে, অযথা কোনো অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়াতে। বিশেষ করে প্রস্রাব ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বন্ধ আছে কি না, তা দেখতে হবে। আমাদের সতর্ক হতে হবে প্রস্রাব চেপে রাখলে কিডনি চাপের মধ্যে থাকে এবং যেকোনো সময় কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। এটি আমাদের দেশে কিডনি বিকল হওয়ার এটা একটি প্রধান কারণ।
প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ না খাওয়া। যেকোনো ডায়রিয়ায় যদি রক্ত না যায় তবে তিন-চারদিন পরে স্যালাইন খেলেই রোগ ভালো হয়ে যায়। তাই আমরা তখন তাদের স্যালাইন খেতে বলি। এগুলো করলে একিউট রেনাল ফেইলিউর হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
প্রশ্ন : এর বাইরে কিডনির আর কী কী জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : বয়স্কদের যেই কারণগুলোর জন্য কিডনির রোগ হয় সেগুলো শিশিুদেরও হতে পারে। যেমন নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন। এগুলো শিশুদেরও হয়। এ ছাড়া দেখা যায় টনসিলে ইনফেকশন আছে, যেটা হয়তো নির্ণয় করা হয় নাই। সেটা থেকে হঠাৎ করে পোস্ট ইনফেকশাস গ্লোমিরুলো নেফ্রাইটিস হতে পারে, এটা কিডনি রোগের একটি কারণ। এতে হঠাৎ করে দেখা যায় প্রস্রাব কমে যাচ্ছে, প্রস্রাবে রক্ত যাচ্ছে, দেহে ফ্লুইড জমা হয়ে গা ফুলে যাচ্ছে।
বেশি ফ্লুইড জমা হওয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট ধীরে ধীরে হার্ট ফেইলিউর হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এ সময় রক্তচাপ যদি বেড়ে যায় তাহলে খিঁচুনিও হতে পারে।
এ ছাড়া জন্মগত কিছু কারণে দেখা যায় বাচ্চার প্রস্রাবে সমস্যা হচ্ছে। ঠিকমতো বেড়ে উঠছে না। পানি খাচ্ছে না। এ ছাড়া পুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে অনেক রোগী কিডনির সমস্যায় ভুগছে, সেগুলো হয়তো নির্ণয় করাও যাচ্ছে না।
তাই যেকোনো বাচ্চা যদি বেড়ে না ওঠে, বারবার প্রস্রাব হয়, ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব হয় অথা প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়, তখন তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অনেক সময় শিশুদের কিডনিতে পাথরও হয়। অর্থাৎ বয়স্কদের যা হয়, তার সব রোগ বাচ্চাদের হয়।
পাশাপাশি জন্মগত কারণে যে সমস্যা হয়, সেটা আগে থেকে নির্ণয় করা গেলে কিডনি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
প্রশ্ন : এ ছাড়া এখন সব জায়গায় আলোচনায় আসে, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, পরিবেশগত কারণ এসবও কি শিশুদের কিডনি রোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখে?
উত্তর : এগুলো শুধু কিডনি না আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার, হার্ট, মস্তিষ্ক এসবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক ধরনের ওষুধ আছে যা কিডনিকে নষ্ট করে দিতে পারে। তাই বাইরের দেশে প্রেসক্রপিশন ছাড়া কেউ কোনো ওষুধ দিতে পারে না। আর শিশুদের তো রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। তাই তাদের বেলায় আরো সতর্ক হতে হয়।
প্রশ্ন : একটি শিশু যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে প্রাথমিক অবস্থায় কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কখন চিকিৎসকের কাছে নেওয়া উচিত?
উত্তর : যেকোনো সমস্যা হলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাবে। একদিনে আনুমানিক দু-তিনশ সিসি প্রস্রাব হতে হবে। এরপর হলো যদি ১২ ঘণ্টা বা যদি একেবারে প্রস্রাব না হয়। আর বংশগত, জন্মগত যেসব রোগ আছে, সেগুলোতে সাধারণত বারবার প্রস্রাব করা, ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব করা, প্রস্রাবের সময় কান্নাকাটি করা, প্রস্রাবে পুঁজ যাওয়া, বয়সের তুলনায় বেড়ে ওঠে না, অনেক সময় শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিকিৎসকরা কারণ নির্ধারণ না করে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে এবং ধীরে ধীরে রোগ ভালো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিডনি হয়তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : বড়দের ক্ষেত্রে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন অনেক বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের বেলায়, শিশুদের বেলায় এর প্রভাব কতখানি?
উত্তর : শিশুদের ক্ষেত্রে প্রভাব আরো অনেক বেশি।
প্রশ্ন : প্রতিরোধে কী করবে?
উত্তর : কিডনির চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই প্রতিরোধ করা উত্তম। জন্মগত কিডনির সমস্যা আছে কিনা, এ জন্য বাচ্চা গর্ভে থাকতেই আলট্রাসোনোগ্রাম করে তার হার্ট ও কিডনিটা দেখা উচিত। তাহলে আগে থেকে চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।