ভূতের ভয় এবং তার প্রতিকার

Looks like you've blocked notifications!
ভূতের ভয় অনেকের মধ্যেই হয়। ছবি : ক্রিসটোফারফ্লাওয়ার

ঘটনা -১

সোমার মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, আর ঘুম আসছে না। হঠাৎ খোলা জানালার দিকে তার চোখ গেল আর সে ওপাশে একটা সাদা ছায়া নড়ে উঠতে দেখল। সাথে সাথেই মনে হলো ওটা ভূত নাতো? আজ সে একা ঘুমাচ্ছে তাই ভয়ে সোমার গলা শুকিয়ে আসছে, বুক ধরফর করছে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি ভূতটা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে যাবে। বাইরে কেমন যেন একটা খসখস শব্দ হচ্ছে, তার মনে হচ্ছে কেউ যেন হেঁটে হেঁটে তার কাছেই আসছে। সে চোখ বন্ধ করে সমানে দোয়া পড়ে যাচ্ছে। এভাবেই সারাটা রাত প্রচণ্ড ভয়ে না ঘুমিয়ে কাটল সোমার।

ঘটনা -২

রুবিনা কোনোভাবেই রাতে একা ঘরে থাকতে পারে না। সে সারা রাত রুমের লাইট জালিয়ে রাখে, ঘুমের সময় কাউকে না কাউকে রুমে নিয়ে ঘুমায়। রাতে বাথরুমে যেতে হলে রুমে যে আছে তাকে জাগিয়ে তুলে বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে সে বাথরুমে যায় এবং তার সাথে কথা বলতে থাকে। ঘুমের সময় রাতের বেলায় কোনো শব্দ হলেই সে চিৎকার করে ওঠে। তার মনে হয় কোনো অশরীরী কিছু বা ভূত এমন শব্দ করছে এবং এটি তার আশপাশেই আছে।

গল্প দুটোর মতোই আমাদের চারপাশের অনেকেই আছে যারা এমন ভয় পায়। ভূতের গল্প এবং ভূতের ভয় মানব সমাজে হাজার বছর ধরে প্রচলিত। সাধারণত মনে করা হয় ভূত হলো সেসব অতৃপ্ত আত্মা যারা মুত্যুর পরও পরলোকে না গিয়ে আমাদের আশপাশে আছে বা আমাদের প্রিয় যারা মারা গেছে তাদের আত্মা যারা আমাদের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি।

যদিও ভূতের অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু যারা ভূতের ভয় পায় তাদের জন্য ভূতের ভয়টা অমূলক নয়। বাস্তবে আমরা দেখতে পাই খুব কম মানুষই ভূত আছে- এটা বিশ্বাস করে কিন্তু আবার ভূতের ভয় পায় এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়। ভূতের ভয় পেলেও অনেকে খুব আগ্রহ নিয়ে ভূতের গল্প পড়ে,সিনেমা দেখে। কারণ এটা তাদের জন্য এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং ভূতের ভয় পেলেও ভয়টা তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। কিন্তু ভয়টা যখন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, স্বাভাবিক ভয়ের মাত্রাকে অতিক্রম করে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, তখন তা থেকে বেড়িয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়ে। অহেতুক ভূতের ভয় থেকে মুক্তি লাভ করার সঠিক কৌশল জানা থাকলে  ভূতের ভয় থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব।

ভূতের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ:

১. যখন ভয়ের অনুভূতিটা প্রথম টের পাচ্ছেন, মনে হচ্ছে বুক ধরফর বেড়ে গেছে, অস্থির লাগছে, বমি বমি ভাব হচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। দেরি না করে দ্রুত ব্রিদিং রিলাক্সেশন করুন। নাক দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন, বুকের ভিতরে সমস্ত খালি জায়গা বাতাসে ভরে ফেলুন, দমটা অল্পক্ষণ আটকে রাখুন তারপর মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। এভাবে পর পর তিনবার করুন।

২. ভূতের ভয় থেকে বেড়িয়ে আসতে ভূত এবং ভয় নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন সত্যি ভূত বলে কিছু আছে কি না? নাকি আপনি অজানা কোনো কারণে ভয় পাচ্ছেন? আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ কখনো ভূত দেখেছে কি না? ভূত দিয়ে কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন কাউকে আপনি দেখেছেন কি না? ক্ষতি হলে, কী ধরনের ক্ষতি? উত্তরগুলো খুঁজে নিয়ে ভাবুন আদৌ ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে কি না।

৩. সিনেমায় ভূত, আত্মা এই বিষয়গুলোকে অতি রঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়। ভয়ের সিনেমা, নাটক আমাদের মধ্যে ভূত ও আত্মা সম্পর্কে ভয় তৈরিতে সাহায্য করে। তাই যদি এ ধরনের সিনেমা, নাটক দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তবে এই ধরনের নাটক, সিনেমা, গল্পের বই এড়িয়ে চলুন।

৪. ভয়কে জয় করতে ভয়ের বিষয়টিকে সরাসরি মোকাবিলা করতে হয়। ভূতের ভয়ে রাতে একা থাকতে ভয় পান, ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখেন। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে রাতে একা থাকা শুরু করুন। ভাবুন পৃথিবীতে কত মানুষ রাতে একা থাকে ভূত তাদের আক্রমণ না করলে আপনাকে করবে কেন? আপনার সাথে তো ভূতের বিশেষ কোনো শত্রুতা নেই। প্রথমে আলো জ্বালিয়ে একা রুমে থাকার অভ্যাস করুন। প্রথমে কষ্ট হবে তার পরও চেষ্টা করুন। প্রথমদিন পারলে নিজেকে নিজে ধন্যবাদ দিন, ছোট পুরষ্কার দিন। এভাবে একা থাকায় অভ্যস্ত হলে একা ঘরে আলো নিভিয়ে থাকার পদক্ষেপ নিন। এভাবে ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন।

৫. ভয় থেকে মনটাকে অন্য দিকে সরিয়ে দিতে গান শোনা, টিভি দেখা, গল্পের বই পড়ার মতো  নিজের ভালোলাগার কাজগুলো করুন।

৬. জানলার দিকে তাকালে ভয় হলে জানালা খুলে রাখুন। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখুন। জানালার দিকে চোখ পড়লে চোখ বন্ধ না করে তাকান। কিন্তু বার বার তাকিয়ে কিছু আছে কি না তা চেক করা হতে বিরত থাকুন।

৭. নিজেকে বলুন যতবার শব্দ শুনে বা আওয়াজে ভয় পেয়েছি, বাইরে ছায়ার মতো কিছু দেখেছি কিছু হয়নি বা কেউ আসেনি। তার মানে কিছুই ছিল না যে শব্দ শুনেছি বা বাইরে যা দেখেছি তাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছি।

৮. ভূত নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা মনে হলে ভাবুন যা ভাবছেন তা যদি সত্যি হয় তবে কী হবে? সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে? এমন হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?

৯. যখন ভয় পাচ্ছেন তখন যা ভেবে ভয় পাচ্ছেন তা কাগজে লিখে ফেলুন, লেখা শেষে কাগজটা কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলুন বা পুড়িয়ে ফেলুন।

১০. ভাবুন ভূত এবং আত্মা আপনার মতোই। তাদের ভয় পাবার কিছু নেই। কোনো প্রমাণ নেই যে ভূত কখনো কারো ক্ষতি করেছে। ভূত বা আত্মার রাজত্ব তাদের নিজেদের জগতে পৃথিবীর কারো ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।

১১. অনেক সময় ছোট বেলা থেকে ভূত সম্পর্কে শোনা গল্প আমাদের মনে ভূত সম্পর্কে একটা ভয়ঙ্কর ছবি তৈরি করে। এটি থেকে আমাদের মাঝে ভয় তৈরি হয়। অনেক সময় বড় হওয়ার পড়ও তা থেকে যায়। তাই বাচ্চাদের সাথে এই ধরনের গল্প না করার চেষ্টা করুন।

১২. ভয় থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য নিজেকে যথেষ্ট সময় দিন।

১৩. নিজের পূর্ববর্তী সফলতার কথা স্মরণ করুন। মনে করুন আগে কখনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কীভাবে বের হয়ে এসেছিলেন। এটা আপনার মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

১৪. নিজেকে বলুন ভয়ের কাছে পরাস্ত হবো না। ভয় আসতেই পারে এটা স্বাভাবিক। আমি জানি ভয়টা অমূলক। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই বরং ভয় দূর করতে যা যা করা দরকার করব।

১৫. ভূত নিয়ে যেসব কমেডি সিনেমা আছে তা দেখুন। ভয়ের সময়ে মনে করার চেষ্টা করুন কমেডি সিনেমাতে ভূতগুলো কী কী করে এবং প্রাণ খুলে হাসুন।

১৬. কোনো বিষয় নিয়ে মজা করলে তা সম্পর্কে ভয় দূর করা সম্ভব। ভূত বিষয় নিয়ে অন্যের সাথে বেশি বেশি গল্প বলুন, মজা করুন।

১৭. অনেক সময় ভূতের ভয়ের সাথে মানসিক অসুস্থতাও যুক্ত থাকতে পারে। সেখানে ছোটখাটো পরামর্শ মেনে চললেই তা দূর করা সম্ভব হবে না। তাই  নিজে নিজে ভূতের ভয় কাটিয়ে উঠতে না পারলে মনো-চিকিৎসক, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নিন।

১৮. ভূতের ভয়টা যেহেতু রাতেই হয়, তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনকে হালকা করে এমন কিছু দেখুন, ঘুমের জন্য আরামদায়ক অল্প আলো জালিয়ে ঘুমান।

১৯. সিলিং থেকে বা জানালায় ঝুলন্ত কিছু থাকলে তা সরিয়ে ফেলুন যাতে রাতের বেলায় এগুলো দেখে ভয় না তৈরি হয়।

২০. ‘ যদি ভূত আসে কী হবে ?- এ ধরনের ভাবনা ব্যক্তির মধ্যে মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তাই ভবিষ্যতে যা ঘটার আশঙ্কা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত নন তা ভাবা থেকে বিরত থাকুন।

লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার