শিশুদের মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ কেন হয়

বিভিন্ন কারণে শিশুদের মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৫১৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. আবদুল আজিজ। বর্তমানে তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু ইউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ সেটি অত্যন্ত ভয়ের একটি বিষয়। শিশুদের ক্ষেত্রে সেটি আরো বেশি আতঙ্কের বিষয়। কোন কোন কারণে সাধারণত এই মলদ্বারে রক্তক্ষরণ হয়?
উত্তর : এখনকার সময় বাচ্চারা যখন বেশি করে ফাস্টফুড খায়, মাংস খায়, তখন দেখা যাচ্ছে যে এই সমস্যাগুলো খুব বেশি হয়। দিনদিন এটা বাড়ছে। যে জিনিসটি হয়, একে আমরা এনাল ফিসার বলি। হেমোরেডস হলে যেতে পারে। পলিপ বা পায়খানার রাস্তার গ্যাজ হলে যেতে পারে। অনেক সময় মিকেজ ডাইভার্টিকুলাম বলি আমরা, সেখানে যেতে পারে। অনেক সময় পাকস্থলীতে কোনো আলসার হলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। আরো অগণিত কারণ আছে, যা থেকে এই সমস্যা হতে পারে। আমরা হেমোফেলিয়া বলি, পারফেলিয়া বলি। বেসিলারি ডিসেনট্রি, রক্ত আমাশয় হলে অনেক সময় যেতে পারে। এই রকম অগণিত কারণ রয়েছে যার জন্য পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে পারে।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে সবচেয়ে বেশি কোন সমস্যাটি নিয়ে আসছে?
উত্তর : আমাদের কাছে যখন রোগী আসে, তখন অনেকেই প্রথমে মনে করে হয়তো রক্ত আমাশয় হয়েছে। তখন তারা রক্ত আমাশয়ের চিকিৎসা দেয়। যখন দেখে যে ভালো হচ্ছে না, তখনই পেডিয়াট্রিক সার্জনের কাছে পাঠায়। আমরা যেটা প্রথমে দেখি যে, আমাশয় হলে তো ওষুধ খাওয়ালে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। যখনই হয় না, তখনই আমাকে ধরে নিতে হবে যে অন্য কোনো একটি সমস্যা রয়েছে যার জন্য রক্ত যাচ্ছে। আমরা প্রথমে যেটা দেখি যে তার এনাল ফিসার আছে কি না। তার মাকে বা বাবাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়, পায়খানা কষা হয় কি না।
প্রশ্ন: এনাল ফিসার বিষয়টি কী?
উত্তর : এনাল ফিসার হলো পায়খানার যে রাস্তা সেখান দিয়ে যখন পায়খানা শক্ত ও মোটাভাবে বের হয়, তখন দেখা যায় যে পায়খানার রাস্তা কয়েকটি জায়গা কেটে যায় বা ছিঁড়ে যায়। এই কাটা বা ছেঁড়াকে আমরা এনাল ফিসার বলি। পায়খানা করার সময় বাচ্চাটা খুব বিরক্ত থাকে। কারণ, যখনই পায়খানা করতে চায়, পায়খানা করতে গেলে সাধারণত ব্যথা লাগে। ব্যথা লাগলে বাচ্চা লাফালাফি করে আর পায়খানা করে না। দুটো পা চিপে ধরে। পায়খানার রাস্তায় চাপ দিয়ে সে ঘরের মধ্যে বা মাঠের মধ্যে দৌড়াচ্ছে। যখনই পায়খানা করে তখনই ব্যথা লাগে, তখনই এমন করে। তখন পায়খানা না করে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। এখানে সমস্যা হচ্ছে যখনই পায়খানা করে না তখনই দেরি হয়, পায়খানা আরো শক্ত হয়, আরো মোটা হয়। পরে যখন পায়খানা করতে যায় তার কষ্ট আরো বাড়তে থাকে। এটা একটা কারণ এখানে হতে পারে। এটা যখন দীর্ঘদিন ধরে থাকে, তখন আবার হেমোরয়েডসের পর্যায়ে চলে যায়।
আরেকটি কারণ বাচ্চাদের খুব বেশি দেখা যায়, রেক্টাল পলিপ বলি আমরা। একে বাংলায় গ্যাজ বলে। সেটা হচ্ছে পায়খানার সঙ্গে একদম তাজা রক্ত যায়। তবে এখানে বাচ্চারা ব্যথা পায় না। শক্ত পায়খানা হলেও রক্ত যাবে, নরম পায়খানা হলেও রক্ত যাবে।
প্রশ্ন : যাতে এনাল ফিসার জটিল না হয়, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : এই ক্ষেত্রে বাচ্চার খাবার অভ্যাসটা পরিবর্তন করতে হবে। যতই মানুষ শহরে বাস করছে খাবার অভ্যাসটি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা বেশি ফাস্ট ফুড খাচ্ছে, জাঙ্ক ফুড খাচ্ছে। বাসায় দেখা যায় মাংস বেশি খাচ্ছে। এই খাবার অভ্যাসটি পরিবর্তন করতে হবে। বাচ্চাদের ফাস্টফুড কমিয়ে দিতে হবে, জাঙ্ক ফুড কমিয়ে দিতে হবে। শাকসবজি বেশি খাওয়াতে হবে, দুধ খাওয়াতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয়, সেই জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। মাছ খাওয়াতে হবে বেশি। সালাদ খাওয়াতে হবে। দুধজাতীয় খাবার খাওয়া। আঁশজাতীয় খাবারটা বেশি খাওয়াতে হবে। এই খাবার খেলে দেখবেন যে, পায়খানা একটু নরম হবে। যদি কেটে যায়, এনাল ফিসার হয়ে থাকে, সেটা আস্তে আস্তে কমে যাবে।
প্রশ্ন : ওষুধ কী আছে?
উত্তর : পায়খানা নরম হওয়ার জন্য কিছু ওষুধ আছে। পাশাপাশি দেখা যায় যে পায়খানা যখন করে, তখন একটি মলম আছে, সেটি দিলে তখন ব্যথা কম হয়। মলম কিছু প্রদাহ কমায়। কমালে পরে যে কাটা বা ছিঁড়ে গেছে এটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।
এনাল ফিসারের কারণে স্বাভাবিক যে পায়খানা করার অভ্যাস, সেটাই নষ্ট হয়ে যায়। প্রথম যখন বাচ্চা ছোট থাকে, পায়খানা করার কোনো সময় থাকে না। তবে দুই ব্ছর পরে কিন্তু বাচ্চাদের দিনে দুবার বা একবার সকাল বেলা করে। সেটার প্যাটার্নটা পরিবর্তন হয়ে যায়। যখনই পায়খানা করতে যায় ব্যথা করে, সে করতে চায় না। এটি কোষ্ঠকাঠিন্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ জন্য খাবারের অভ্যাসটা ঠিক করা খুব দরকার। অনেক সময় আমরা বলি যে ইসবগুলের ভুষি খেলে পায়খানা নরম করে।
প্রশ্ন : কতদিন লাগে সুস্থ হতে?
উত্তর : এটা তো নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। সাধারণত দুই সপ্তাহ, চার সপ্তাহ, ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত লাগে। তবে যেটা দরকার, সেটা হলো ছয় সপ্তাহ পরেই কিন্তু শেষ নয়। দৈনন্দিন খাবারটা সব সময়ই তাকে খাওয়াতে হবে। আর যদি কোনো কারণে না ঠিক হয়, সে ক্ষেত্রে একটি অস্ত্রোপচার আছে, সেটা করে দিলে ভালো হয়ে যায়। অস্ত্রোপচার করার পর যদি খাবারের অভ্যাসটা পরিবর্তন করা যায়, তাহলে কিন্তু ভালো হয়ে যাবে। তাহলে আর এই সমস্যাটা থাকে না।
প্রশ্ন : হেমোরয়েডসের ক্ষেত্রে কী করতে হয়?
উত্তর : এখানেও যদি খাওয়ার অভ্যাসটা করা হয়, তাহলে আর অস্ত্রোপচারটা লাগে না। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে অনেক সময় অস্ত্রোপচারটা লাগে। বাচ্চাদের অস্ত্রোপচার খুব একটা লাগে না, শাকসবজি যদি নিয়মিত খাওয়ানো যায়। অস্ত্রোপচার লাগে যদি পলিপ থাকে।
প্রশ্ন : পলিপের লক্ষণগুলো কীভাবে প্রকাশ পায়?
উত্তর : শক্ত হোক বা নরম হোক পায়খানা তার সঙ্গে রক্ত যাবে। কখনো দেখা যায় পায়খানা গায়ের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় পায়খানার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত থাকে। এটা নির্ণয় করা খুবই সোজা। হাতে একটি গ্লাভস পরে যদি আমরা যন্ত্র দিয়ে দেখি, তাহলে দেখা যায় ৭০-৮০ ভাগ আমরা রোগ নির্ণয় করতে পারি। অনেক সময় দেখা যায় যদি উচ্চ পলিপ থাকে, সে ক্ষেত্রে কোলোনোস্কোপি করে আমরা রোগ নির্ণয় করি ও অস্ত্রোপচার করি। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে পলিপ সাধারণত রেক্টামে থাকে এবং আঙুল দিয়ে এটি বোঝা যায়। এই ক্ষেত্রে আমরা অস্ত্রোপচার করে দিলে এটি ভালো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : বিনা অস্ত্রোপচারে চিকিৎসা করার যে প্রবণতা আছে সেটা থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়?
উত্তর : অপচিকিৎসা বলতে কবিরাজ বা গ্রামে করে। পলিপ অনেক সময় দেখা যায় বেরিয়ে আসে। তখন এমন একটি জিনিস লাগিয়ে দেয় এতে পুরো জিনিসটি পুড়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় পুরো পায়খানার রাস্তা পুড়ে যায়। পুড়ে গেলে একটি বীভৎস অবস্থা তৈরি হয়। না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না যে কত বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যায়। আস্তে আস্তে যখন ঘা শুকায় পুরো পায়খানার রাস্তা সরু হয়ে যায়। তাই এই ধরনের চিকিৎসায় যাওয়া ঠিক নয়।
আরেকটি কারণে অনেক সময় রক্ত যায়, অনেক সময় বাচ্চাদের নাড়ি একটি আরেকটির মধ্যে ঢুকে গেলে তখনো পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়। সাধারণত দেখা যায় তিন থেকে নয় মাসের মধ্যে এই সমস্যাটা খুব বেশি হয়ে যায়। একটি সুস্থ বাচ্চা আছে, এরপর হঠাৎ করে দেখা যায় তার পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। এই ব্যথাটির একটি খুব অদ্ভুত বিষয় থাকে। ব্যথাটা পাঁচ থেকে ১৫ মিনিট পরপর আসে। তখন শিশু স্ক্রিমিং করে। হাত পা খিচে রাখে। এটা সাধারণত তিন থেকে নয় মাসের মধ্যে খুব বেশি পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : এটি থেকে কীভাবে মুক্ত থাকবে?
উত্তর : বাচ্চাকে আমরা সাধারণত ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াব। ছয় মাস পরেই আমরা একটু শক্ত খাবার দিতে পারি। যখনই শক্ত খাবার দেওয়া হয়, তখন পেটের নাড়ির মধ্যে যে মিউকোসা থাকে, এর একটি পরির্বতন দেখা যায়।
প্রশ্ন : ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হয়?
উত্তর : অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার লাগে। অস্ত্রোপচারের অবশ্য অনেক রকম ভিন্নতা আছে। সময়মতো অস্ত্রোপচার করলে এটি থেকেও মুক্ত থাকা যায়।