মেরুদণ্ডের ব্যথায় চিকিৎসা পদ্ধতি
বলা হয়, পৃথিবীতে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো সময় মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভোগে। মেরুদণ্ডের ব্যথায় করণীয় কী এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আজ ১৪ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠের ২০৩৫ তম পর্বে আলোচনা করেছেন জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে কর্মরত অধ্যাপক ডা. জোনাইদ শফিক।
প্রশ্ন: গতকাল এই অনুষ্ঠানে আপনি আমাদের মেরুদণ্ডের ব্যথা কেন হয় এবং এটি কী ধরনের সে বিষয়ে অনেক তথ্য জানিয়েছেন। আজকে আমরা জানতে চাইব মেরুদণ্ডের ব্যথায় আক্রান্ত একজন মানুষের ক্ষেত্রে কী কী চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত আছে?
উত্তর: সারা পৃথিবীতে এখন এই ব্যথার চিকিৎসা পদ্ধতিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমে আপনি ওষুধ খাবেন, কাজ না করলে ইন্টারভেনশনে যাবেন, হাড় যখন ব্লক হলো সেটাকে ছুটিয়ে নেবেন, আর তিন নম্বর হলো সার্জারি।
প্রথম চিকিৎসাটি হচ্ছে ব্যথার ওষুধ খাওয়া এবং ফিজিওথেরাপি নেওয়া। ব্যথার ওষুধ দিয়ে সাধারণত ৯০ ভাগ রোগী ভালো হয়ে যায়। যদি কোনো কারণে ব্যথা হল তখন চিকিৎসক প্রথমে প্রচলিত একটি ব্যথার ওষুধ দেবে।
পাশাপাশি একটি পেশি শিথিলকরণ ট্যাবলেট দেবে। প্রচলিত ট্যাবলেট যেমন রিজারভিংস আছে, ভল্টারেন আছে, এগুলাো দেবে। এছাড়া ব্যাকলো, সিডালুড বা মায়ালক্স আছে – এ ধরনের ওষুধ দেবে। পাশাপাশি গ্যাসট্রিকের ওষুধ আছে, এগুলো দিলে দেখা যায় তিন থেকে চার দিন পর এই রোগটি সেরে যায়। তবে তার সঙ্গে বিশ্রামে থাকতে হবে।
যদি এতে না কমে তখন এটির সঙ্গে ফিজিওথেরাপিতে যেতে হবে। যেটাকে আমরা সোজা বাংলায় ছ্যাক বলি। তবে বাসার ছ্যাক নয়। মানুষ ভুল করে, বাসায় গরম তোয়ালে দিয়ে ছ্যাকা দেয়। এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ বিষয়টি হচ্ছে, আপনি যখন ছ্যাক দেবেন তখন সেটি চামড়ায় গিয়ে চাপ দিচ্ছে। ভেতরে বেশি যাচ্ছে না। এতে চামড়াটিকে এবং উপরের মাংসটিকে সেটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। এতে সাময়িক আরাম বোধ করছে, তবে লাভের পরিবর্তে ক্ষতি হচ্ছে।
সেইক্ষেত্রে আমি সবসময় বলি, পারলে গরম পানি ঢালুন, পানিটা যেন গড়িয়ে চলে যায়। তাহলে আপনি আরাম পাবেন। এটাও যাতে হালকা কুসুম কুসুম গরম পানি হয়। আর বাথটাব যদি বাসায় থাকে, তবে লবন ছিটিয়ে একটু শুয়ে থাকুন। এতেও ব্যথা কমবে। আর এতেও ভালো না হলে আপনি ফিজিওথেরাপি সেন্টারে যান, এক থেকে সাত দিন ফিজিওথেরাপি নেন। পাশাপাশি ওষুধ খেলে আশা করি ব্যথা চলে যাবে।
খারাপ দিক হচ্ছে, যদি এটিতে কাজ না করে, অথবা ডিস্কে বেশি চাপ খেয়ে নরম হাড়টা যদি রগে ঢুকে যায়, (আমাদের দুদিক থেকে দুটো রগ আছে, বাম দিক থেকেও যায়, ডান দিক থেকেও যায়) তখন এটি ফুলে যায়। এই ফোলাটাকে কমাতে হবে। এই ফোলাটা স্বাভাবিক ব্যথার ওষুধের মাধ্যমেও কমানো যেতে পারে। অ্যান্টিইনফ্লামেটোরি ওষুধ দিতে হবে। দেখা যায়, ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ওষুধ খেলে এই ফোলাটা কমে যাবে। যদি ব্যথার ওষুধে চার পাঁচ দিনে না কমে, দেখা যায়, ব্যথা পায়ের দিকে চলে যাচ্ছে, পা ঝি ঝি করছে, অবশ হয়ে যাচ্ছে, তখন চিকিৎসকের কাছে যাবে। ইন্টারভেনশন করতে হবে। আমরা হচ্ছি ইন্টারভেশন ব্যথা বিশষজ্ঞ।
প্রশ্ন: ইন্টারভেশন মানে কী? কী করেন আপনারা?
উত্তর: এর মানে হলো, হার্টে যেমন ব্লক ছুটানো হয় তেমনি এখানে আমরা ব্লক ছুটাই। হাড়টা এখানে ব্লক হয়ে যায়। নরম হাড় রগের উপর চাপ দিয়ে এটা ব্লক হচ্ছে। এই ফুলাটাকে ছুটিয়ে নিতে হবে। স্নায়ুটাকে এটা ব্লক করে দিয়েছে। এখন যদি এটা না ছুটানো হয় তবে স্নায়ুর উপর চাপ পড়বে।
প্রশ্ন: ব্লক ছুটানোর উপায় কী?
উত্তর: আমরা একটি সুঁই বা নিডেল দিয়ে চামড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকে একটি ওষুধ দিয়ে আসব। এটি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ। ৪০ বা ৫০ মিলিগ্রাম স্টেরয়েড শরীরের জন্য তেমন ক্ষতিকারক না। সুই দিয়ে ওষুধটি দিলেই দেখা যায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে এটি কাজ করে। যখন এটি চুপসে যাবে আপনার ব্যথা কমে যাবে। ধরেন আপনার বাম দিকে ব্যথা হচ্ছে, হাঁটতে পারছেন না, রগে টান পড়ছে সেটা বাম দিকে হোক বা ডান দিকে হোক। ঘাড়ের ক্ষেত্রে হোক বা দুই হাতে বেলায় হোক সেটা চলে যাবে। এতে যদি কাজ না করে তখন এক সপ্তাহ পর পুনরায় দেওয়া যায়। যদি দুটোতে কাজ না করে তবে তখন এক মাস অপেক্ষা করে আবার দেওয়া যায়। আর এতেও যদি কাজ না করে তাহলে তৃতীয় মাধ্যম হলো সার্জারি করা।
প্রশ্ন: সার্জারিতে যাওয়ার আগে এখানে লেজারের কথা শোনা যাচ্ছে। লেজারের ভূমিকা কী?
উত্তর: লেজারটাকে বলা হয় ডিস্কটাকে গলিয়ে দেবে। তবে লেজার সার্জারিটা এখনও সেকরকম শক্তিশালী হয়নি। লেজার ত্বকে যত ভালো কাজ করে, ডিস্কের জায়গায় তত ভালো কাজ করে না। যদি না কাজ করে তখন সার্জারিতে যেতে হবে। সার্জারির একটা মুশকিল হলো এতে একটি ফেল করার আশঙ্কা আছে। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ফেইলিউর রেট আছে। হাড়টা কাঁটতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে হয়তো রগ একটু কেঁটে ফেলে দেয়। বা পুরো হাড়টা কেটে ফেলে দেয়। তবে যখন সব চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ব্যর্থ হলো তখন সার্জারি ছাড়াতো কোনো উপায় নেই। তাই সার্জারিতে যেতে হবে। সার্জারিতে ভালোও হয়।
প্রশ্ন: ইন্টারভেনশন দেওয়ার পর রোগী যখন ভালো হলো তখন এই ভালো হওয়াটা কতখানি স্থায়ী। স্থায়ীভাবে এই ভালো রাখাটা ধরে রাখার জন্য তার জীবনযাত্রার ধরনে কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন?
উত্তর:এই রোগটি ক্রনিক। এটি উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো যাবে না কখনো। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে কিছু নিয়ম মানতে হবে। আপনার এখন হয়তো ডায়াবেটিস হলো আপনি যদি মিষ্টি খেতে থাকেন তাহলে কী আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হবে? হবে না। আপনার অঙ্গ বিন্যাস যদি ঠিক না হয়, শোয়া যদি ঠিক না হয়, নিয়মিত যদি ক্যালসিয়াম সম্বৃদ্ধ খাবার না খাই, নিয়মিত যদি কোমর , ঘারের ব্যয়াম না করি তাহলে ছয় মাস, এক বছর পরে রোগটি আবার হতে পারে। তখন বিষয়টি আরো জটিল হবে।
সুতারাং এটাকে ঠিক করতে হলে খাওয়া দাওয়াকে ঠিক করতে হবে।ক্যালসিয়াম সম্বৃদ্ধ খাবার যেমন মাছের কাঁটা, পাতলা দুধ, ডিমের সাদা অংশ, ছোট কলা, পুঁইশাক এগুলোতে প্রচুর ক্যালসিয়াম আছে। পাশাপাশি ভিটামিন ডি এর অভাব আছে। এখন বাংলাদেশে অবশ্য ভিটামিন ডি ট্যাবলেট চলে এসেছে, ইনজেকট্যাবেল অবস্থাও চলে আসছে। আর আমরা বলি সূর্যের আলো, ১১ থেকে ১২ মধ্যে, আধা ঘণ্টা গায়ে মাখাতে হবে। শুধু ক্যালসিয়াম খেলে হবে না।
ভিটামিন ডি না খেলে ক্যালসিয়াম শোষণ হবে না।
খাবার দাবারের অভ্যাস যদি পরিবতর্ন করি, পাশাপাশি যদি ব্যয়াম করি, তাহলে অনেকটাই ঠিক হবে। আরেকটি বিষয় হলো ওজন নিয়ন্ত্রণ। ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সকালে এবং রাতে ৫ থেকে ১০ মিনিট দুটো ব্যয়াম করতে হবে।
কোমরে ব্যয়াম খুব সোজা, বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আপনি প্রথমে বাম পা উঠাবেন, ১০ পর্যন্ত গুণবেন। তারপর ডান পা উঠাবেন, ১০ পর্যন্ত গুণবেন । তারপর দুই পা একসঙ্গে উঠাবেন, ১০ পর্যন্ত গুণবেন।
দুটো হাঁটু ভাজ করে পেটের কাছে নিয়ে আসবেন, ১০ পর্যন্ত গুণবেন। এরপর হাঁটুটি ধরে শরীর সহ একবার ডানে ঘুরবেন এবং ১০ পর্যন্ত গুণবেন। শরীর সহ আবার বাঁয়ে ঘুরবেন, ১০ পর্যন্ত গুণবেন। এই যে ব্যয়ামের একটি চক্র হলো, একে আপনি যতটুকু করার ক্ষমতা আছে করবেন। ব্যয়ামের নিয়ম হলো খালি পেটে বা খাওয়ার এক ঘণ্টা পর।
আর ঘাড়ের ব্যয়ামটি আরো সোজা। নিচে, পিঠে, ডানে, বায়ে এবং পুরো অংশে ঘাড় ঘুরাবেন। এটা করতে করতে এক পর্যায়ে পেশিগুলো যখন সচল হয়ে যাবে তখন আরেকটি বিষয় করবেন। হাতের তালুতে চাপ দিয়ে থুতনি নিচে নামাতে চেষ্টা করবেন। হাতের তালু দিয়ে মাথাকে চাপ দিয়ে উপরে উঠাতে চেষ্টা করবেন। হাতের তালুকে ডান দিকে নিয়ে মাথাকে চাপ দিয়ে ডান দিকে নিতে চেষ্টা করবেন। পুনরায় এভাবেই বাম দিকে নিতে চেষ্টা করবেন। এই ব্যয়াম গুলো যদি নিয়মিত করেন। তবে সহজেই কোর ব্যথা ঘার ব্যথা ভালো হয়ে যাবে।