বাংলাদেশের আধুনিক বাইপাস সার্জারি

Looks like you've blocked notifications!

হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রেখে যে সার্জারি করা হয়, তাকে আধুনিক বাইপাস সার্জারি বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে বেশ সফলভাবে এই সার্জারি করা যাচ্ছে এখন। আজ ১৫ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৩৬ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মো. লোকমান হোসেন।

প্রশ্ন : বাইপাস সার্জারির আগে আমি একটু জানতে চাইব, হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে কী কী ধরনের সমস্যা হয় এবং উপসর্গগুলো ঠিক কীভাবে প্রকাশ পায়?

উত্তর : যখন রক্তনালিগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন ব্যক্তি নিজেই কিছুদূর হাঁটতে গেলে একটু চাপ অনুভব করে। একটু বেশি হাঁটতে গেলে তার দম খাটো হয়ে আসবে। ঘাম হতে পারে। বুক ধড়ফড় করতে পারে। তবে যেসব রোগী, যারা ডায়াবেটিসে ভোগে, তাদের এ ধরনের বোধ থাকে না। সে ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা একটি বড় হার্ট অ্যাটাক নিয়েও উপসর্গ প্রকাশ করতে পারে।

প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন, যখন ওই সময় একটি হার্ট অ্যাটাকের রোগী আপনাদের কাছে আসে?

উত্তর : আমাদের দেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে সব ধরনের ব্যবস্থার ২৪ ঘণ্টার প্রাপ্যতা আছে। তাই যদি রোগী তার ব্যথা অনুভূত হওয়ার ছয় ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারে, তাহলে যেকোনো স্থানে সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসা কার্ডিওলজি বিভাগে পাবেন।

প্রশ্ন : এবার আমরা বাইপাস সার্জারিতে চলে আসি। এই বাইপাস সার্জারি প্রয়োজনীয়তা কখন? কখন আপনারা নির্ধারণ করেন যে বাইপাস সার্জারি একজন রোগীর জন্য দরকার?

উত্তর : বাইপাস সার্জারির আগে কার্ডিওলজিস্টরা রোগীকে এনজিওগ্রাম করেন। এনজিওগ্রামের মধ্যে যদি দেখা যায় তার হার্টের দুই-এক জায়গায় ছোট ছোট ব্লক আছে, সে ক্ষেত্রে তারা এনজিওপ্লাস্টি করতে পারে। আর কিছু কিছু রোগী আছে, যাদের অনেকগুলো ব্লক থাকে, সে ক্ষেত্রে ওই রোগীর সার্জারি করতে হবে।

প্রশ্ন : যখন একজন রোগীর সার্জারি করার অবস্থা তৈরি হয়, তখন তার কোন কোন জিনিস আপনারা দেখেন?

উত্তর : সার্জারি করার আগে আমরা পুরোপুরি চেকআপ করে নিই। তার ফুসফুস, লিভার, কিডনি কেমন আছে, তার ডায়াবেটিসের অবস্থা কেমন রয়েছে, সব ধরনের বিষয় চেক করার পরে তার সার্জারি করা হয়।

প্রশ্ন : আধুনিক বাইপাস সার্জারি কেমন এবং বাংলাদেশে এর কী অবস্থা, এটি সম্বন্ধে কিছু বলেন?

উত্তর : আধুনিক বাইপাস সার্জারি বলতে বিটিং হার্ট বাইপাস সার্জারি বোঝায়। যেসব রোগীর হার্ট বড় থাকে, তাদের জন্য আমরা কনভেনশনাল বাইপাস সার্জারি করে থাকি। আধুনিক বাইপাস সার্জারি বলতে বোঝায়, হার্ট তার জায়গাতেই নড়তে থাকে, এর মধ্যে যে জায়গায় বাইপাস করব সেখানে অক্টোপাস নামে একটা যন্ত্র থাকে, যেটাকে চাপ দিলে ওই জায়গাটা সচল কম হয়। আসলে হার্টকে বন্ধ না করে যে সার্জারি করা হয়, সেটা হলো আধুনিক বাইপাস সার্জারি। এতে অনেক সুবিধা। সার্জারির সময় তার রক্ত কম লাগে। অনেক আগে ভালো হয়, রোগী তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে পারে। শরীরে অন্যান্য জটিলতা খুব কম হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বাইপাস সার্জারির খরচ কম।

বিশ্ব মানের কেন বলছি আমরা? বাইপাস সার্জারি করতে যেসব জিনিস আমরা ব্যবহার করি, সব বিদেশ থেকে আসে। আমরা কেবল ব্যক্তিকে লাগিয়ে দিচ্ছি। এটাকে দেশের মাঝে বিদেশি সেবা বলা যেতে পারে। সব ধরনের যন্ত্রপাতি এখন আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। আর এটি সমানতালে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে এবং সেটি খুব সফলভাবে করা হচ্ছে।

প্রশ্ন : এই বাইপাস সার্জারি নিয়ে রোগীদের এত ভয় কেন? কত দিন পরে রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন?

উত্তর : একটা অস্ত্রোপচার করতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিনই বিকেল বেলা আমরা রোগীকে ওই যন্ত্র খুলে দিই। ওই দিনই সন্ধ্যাবেলায় তারা চা-কফি খায়। পরের দিন আমরা আইসিইউর মধ্যে নড়াচড়া, হাঁটাচলা করাই। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দিন আমরা তাকে কেবিনে পাঠিয়ে দিই। সপ্তম দিনে রোগীকে গোসল করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রোগী বাড়িতে যাওয়ার পর আবার ১০ দিন পর ফলোআপে আসে। সার্জারির পর শারীরিক সমস্যা অনেক কমে যায়।

বাইপাস সার্জারি আমরা মূলত তিনটি কারণে করি। প্রথমত, জীবনের মান উন্নত করার জন্য। দ্বিতীয়ত, ৯৫ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা কমে যায়। তৃতীয়ত, আমরা বলি রোগী খুব বেশি অসুস্থ হয়ে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসার আশঙ্কা অনেক কমে যায়।

প্রশ্ন : বাইপাস সার্জারির পরবর্তী ক্ষেত্রে তার যেন আর এ সমস্যার মধ্য দিয়ে না আসতে হয়, সে ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার ধরনে কী পরিবর্তন করতে বলা হয়?

উত্তর : সে ক্ষেত্রে আমি যেটা বলি, নিজের ইচ্ছাই যথেষ্ট। আপনি ধূমপান পরিহার করবেন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করবেন, আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রতিদিন এক থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটবেন। চর্বিমুক্ত খাবার খাবেন। আর প্রয়োজন যখন হবে, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে। কখনোই নিজেকে হেলা করা যাবে না। ভাবলে চলবে না, আমি একবার বাইপাস করে এসেছি, এখন সবকিছু থেকে মুক্ত!

সার্জারির জন্য হয়তো কোনো ওষুধ লাগে না । তবে অন্যান্য যে রক্তনালি আছে তাকে ভালো রাখার জন্য ওষুধ তো খেতেই হবে।

প্রশ্ন : হৃদরোগের সমস্যা প্রতিরোধের জন্য কী করণীয়?

উত্তর : আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আমার দেশ গরিব। হৃদরোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। সেটাকে প্রতিরোধ করতে আমাদের আগে থেকেই যেন হৃদরোগ না হয়, সে জন্য ঝুঁকিমুক্ত থাকতে হবে। যার ওজন বেশি আছে, তার কমাতে হবে। যারা ধূমপান করে, তাদের সেটি পরিহার করতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চর্বিমুক্ত খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন হাঁটতে হবে। আর যাদের পরিবারে এই রোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই চেক করে নিতে হবে।

প্রতিদিন খাবারের একটি মেন্যু থাকতে হবে। শাক-সবজি থাকতে হবে। সব খাবারই পরিমাণমতো খেতে হবে।

যারা এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যায়, তাদের আমরা বলি, আপনারা দেশীয় সার্জনের কাছে আসেন। সার্জারি করান।

সার্জারি একটি ধাপ। সে ক্ষেত্রে আপনার ফলোআপের জন্য সার্জনের কাছে আসতে হবে। আর দেশে করলে আপনি নিয়মিত চেকআপের এই সুবিধা পাবেন।