শিশুদের কিডনি রোগ

নেফ্রটিক সিনড্রমের চিকিৎসা

Looks like you've blocked notifications!
ডা. গোলাম মাইনুদ্দিন।

শিশুদের কিডনি রোগের মধ্যে নেফ্রটিক সিনড্রম একটি জটিল রোগ। তবে এ দেশে এর চিকিৎসা এখন বেশ সফলভাবে হচ্ছে। যথাসময়ে এর চিকিৎসা নিলে রোগী ভালো হওয়ার সম্ভবনা বেশি। আজ ১৬ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৩৭ পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ম্যাডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোলাম মাইনুদ্দিন।

প্রশ্ন : শিশুদের অনেক ধরনের কিডনি রোগ হয় আমরা জানি। এর মধ্যে রয়েছে হঠাৎ করে কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, দীর্ঘ মেয়াদি বিকল হওয়া ইত্যাদি। যদি একটু বুঝিয়ে বলেন, নেফ্রটিক সিনড্রম রোগটি আসলে কী এবং এই রোগে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় কেন?

উত্তর : যেকোনো সিনড্রমের আসলে একাধিক বিষয় থাকে। নেফ্রটিক সিনড্রমের প্রধান সমস্যা হলো, এটি হলে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে এলবুমিন বেরিয়ে যায়। আমরা যে মাছ মাংস খাই এগুলো প্রোটিন, প্রোটিন শরীরে ঢোকার পরে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এলবুমিন, গ্লোবুলিন, ফিব্রিনোজেন। কিডনি প্রতিদিন ১৮০ থেকে ২০০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে তার মধ্যে দেড় থেকে দুই লিটার প্রস্রাব হয়। তার মধ্যে কিছু কিছু এলবুমিন যেতে পারে।  বয়স্কদের বেলায় ১৫০ থেকে ২০০।  বাচ্চাদের বেলায় ১০০ থেকে ১৫০ এভাবে  যায়। যখন এই রোগটি হয় তখন দুই থেকে তিন গ্রাম, অনেক সময় পাঁচ বা ছয় গ্রামও যেতে পারে। প্রস্রাবের সঙ্গে এলবুমিন নিঃস্বরণ হয়, যেটা সাধারণত এতটা হওয়ার কথা  নয়।urgentPhoto

বেশির ভাগ  ক্ষেত্রে বাচ্চাদের বেলায় এর কোনো কারণ পাওয়া যায় না। এটা দুই থেকে আট বছরের বাচ্চাদের মধ্যে বেশি হয়। কিডনি যেহেতু একটি ছাকনি। ছাকনির ছিদ্রগুলো, কোনো কারণ ছাড়াই এলার্জি জাতীয় অনেক রোগ আছে যেগুলো কারণে ছিদ্রগুলো বড় হয়ে যায়। কিডনির কার্যকারিতা কিছুটা ব্যহত হয়। এর জন্য প্রোটিন স্বাভাবিকের থেকে বেশি বেড়িয়ে যাচ্ছে। প্রোটিন যেহতু রক্তের ভেতর পানি বা ব্লাড প্রেশারকে ধরে রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, তাই যখন প্রয়োজনের তুলনায় প্রোটিন বেশি বেড়িয়ে যায় তখনই পানিটা রক্তের নিচে থাকে না রক্তের ভেতরে চলে আসে। সেজন্য গা ফুলে যায়। গা ফুলে গেলে আবার ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শ্বাস কষ্ট হয়, প্রস্রাব কমে যায়। ক্ষেত্র বিশেষ প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।

এটা সাধারণত জন্মগত কারণেও হতে পারে এবং জন্মের পরে যেকোনো সময় হতে পারে। আর কিছু কিছু অটোইমিউন রোগ থেকেও এটি হতে পারে।এসএলই, ভাসকুলাইটিস এগুলো থেকে হতে পারে।  ম্যালেরিয়ার পরে হতে পারে। এইচআইভি থেকে হতে পারে। তবে এগুলো কম।

সাধারণত দুই থেকে আট বছরের বাচ্চারা এই রোগে শরীর ফোলা এবং প্রোটিন বেড়িয়ে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসে।

প্রশ্ন : শরীর ফোলা শুধু কিডনি রোগের ক্ষেত্রেই হয় না। অনেক রোগেও হয়। তাই এই ফোলা যে নেফ্রটিক সিনড্রমের কারণে হয়েছে সেটি বোঝার উপায় কী?

উত্তর : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেননা হার্ট অকেজো হয়ে পড়া বা কিডনি অকেজো হয়ে পড়া ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শরীরে পানি আসতে পারে। অথবা কোনো কারণে যদি শরীরে স্যালাইন দেওয়া হয়। তখনো শরীর ফুল যেতে পারে। এটা হলে আমরা প্রথমে যেটা বলি, প্রস্রাব কমে যাবে। হৃদপিণ্ডে সমস্যা থাকলে ফোলার সঙ্গে শ্বাস কষ্ট থাকবে। রক্তশূন্যতা থাকবে না। লিভারের ক্ষেত্রে জন্ডিস থাকবে। আর এই রোগে দেখা যায় অনেক বেশি ফোলা কিন্তু সে চুপচাপ শুয়ে আছে।

প্রস্রাব হবে না, কমে যাবে। এদের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যালার্জি, এক্সিমা এসব রোগের ইতহাস থাকে।

কোনো ল্যাবে না গিয়ে কেবল  বাড়িতে প্রস্রাবটা একটি টেস্ট টিউবে নিয়ে চুলার  আগুলে জ্বাল দিলে দেখা যাবে এর মধ্যে সাদা রঙের গাঢ় একধরনের জিনিস জমে গেছে।এগুলো হলে নেফ্রটিক সিনড্রম।

প্রশ্ন : যদি রোগী সময় মতো চিকিৎসকের কাছে না যায় তবে কী কী ক্ষতি হতে পারে? আর যদি সময়মতো যায় সেটি ভালো করারও আশা কতখানি?

উত্তর : অনেক সময় দেখা যায় সাধারণ চিকিৎসক বা ফার্মেসিতে নিয়ে গেলে গা ফোলা কমানোর ওষুধ দেয়। এতে হয়তো উপসর্গ দূর হয় কিন্তু রোগ দূর হয় না। এর ফলে তার ক্ষতি হতে থাকবে, রক্তচাপ বাড়বে, শ্বাসকষ্ট হবে, সংক্রমণ হবে। এ থেকে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকবে। আবার কিডনি একেবারে নষ্টও হয়ে যেতে পারে।

তবে আশার কথা বাচ্চাদের যেটা হয় দুই থেকে আট বছরের মধ্যে এটা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে। আর আমরা প্রত্যেক রোগীর অভিভাবকদের জ্বাল দিয়ে প্রস্রাবটা পর্যবেক্ষণ করার পদ্ধতি শিখিয়ে দেই।

প্রশ্ন : নেফ্রটিক সিনড্রম হলে আপনার কী ধরনের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এবং এই রোগীদের ভালো হওয়ার সম্ভবনা কতখানি?

উত্তর : ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভালো হয়ে যায়। তবে এটি বার বার হয়। ওষুধ দিলে ভালো হয়ে যায়। তাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি চিকৎসকের কাছে চলে আসে তাহলে অত খারাপ অবস্থা হয় না। এই রোগে সবচেয়ে বেশি পেডনিসোলোন ওষুধ ব্যবহার করি।

প্রশ্ন : আমরা জানি, পেডনিসোলোন একটি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ। এই ওষুধ ব্যবহারের সময় শিশুটির জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তনের জন্য কী ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং এই সময় সে কোনো ধরনের টিকা নিতে পারবে কি না?

উত্তর : পেডনিসোলোন চলার সময় লাইফ ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া যাবে না। আর ওষুধ বন্ধ করার চার থেকে আট সপ্তাহ বিরতি দিয়ে টিকা দিতে বলি। পেডনিসোলোন দেওয়ার পর ৯০ ভাগের মধ্যে ৮০ ভাগের ক্ষেত্রে ওষুধটি কাজ করে। যাদের কাজ করে না, তাদের কিডনি বায়োপসি করে আরো কিছু ওষুধ রয়েছে সেগুলো দেই। এসব ওষুধ আমাদের দেশে সহজপ্রাপ্য।  আমাদের দেশে এখন এর ভালো চিকিৎসা রয়েছে।

আমাদের এখানে যত রোগী ভর্তি হয় তাদের বেশিরভাগ দেখা যায় এ রোগের জন্য হয়েছে। হয়তো দেরিতে চিকিৎসকের কাছে আসার জন্য। বা ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়ার জন্য এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা নিলে সমস্যা হয় না। এ রোগে ভালো হওয়ার সম্ভবনাই বেশি।