নারীর রোগ নির্ণয়ে ল্যাপারোসকপি
আধুনিক যুগে সার্জারির ক্ষেত্রে ল্যাপারোসকপি একটি অন্যতম সার্জারি মাধ্যম। এখানে কাটাকাটি তেমনভাবে না করে কেবল কয়েকটি ছিদ্র করেই সার্জারি করা যায়। আজ ১৭ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৩৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন আনোয়ার খান মর্ডান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এস আব্বাসী।
প্রশ্ন : ল্যাপারোসকপি বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আমরা সাধারণত যেসব সার্জারির সঙ্গে পরিচিত তার চেয়ে ল্যাপারোসকপি খানিকটা ব্যতিক্রম। যদি আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলি, এটি হলো মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারি। এর মানে আমরা যেটা জানতাম, সাধারণত কোনো রোগীর পেট কেটে যে অস্ত্রোপচার করা হয়, এই ক্ষেত্রে আমরা সে রকম কাটাকাটি করছি না। এখানে ছোট ছোট কিছু ফুটোর মতো করে আমরা অস্ত্রোপচার করছি। সেই ক্ষেত্রে যেটা হয়, আগে যেই অস্ত্রোপচারগুলো করা হতো সেটি বাদ দিয়ে এখন একটি-দুটি বা তিনটি করে ফুটো করে পুরো অস্ত্রোপচারটা আমরা শেষ করতে পারি।urgentPhoto
প্রশ্ন : সাধারণত গাইনোকোলজিক্যাল কোন কোন সমস্যায় আপনারা ল্যাপারোসকপি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : সাধারণত দেখা যায়, দুভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়া হয়। রোগীর কী ধরনের সমস্যা আছে সেটাকে চিহ্নিত করার জন্য আপনি ল্যাপারোসকপি সার্জারিটা ব্যবহার করছেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে সমস্যাটি জানেন এখন সেই বিষয়ে আপনি তাকে চিকিৎসা দেবেন সেই জন্য ল্যাপারোসকপির ব্যবহার করছেন।
যেমন ধরুন, একজন মা তিনি অনেক দিন ধরে বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন। আমরা হয়তো অনেক ধরনের চিকিৎসা দিয়েছি তাঁকে। বিভিন্ন ধরনের ওষুধও দেওয়া হয়েছে। তারপরও তার হয়তো গর্ভধারণ হচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে ল্যাপারোসকপির একটি বিশাল ভূমিকা আছে। আমরা হয়তো ফুটো করে ঢুকলাম ভেতরে। এর মাধ্যমে তাঁর জরায়ু, প্যালভিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর কী অবস্থা আছে, ডিমের কী অবস্থা, ডিম্বনালির কী অবস্থা সেটা আমরা জানতে পারছি।
আবার অনেক সময় রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমরা হয়তো বুঝতে পারছি না। রোগী হয়তো একধরনের লক্ষণ দেখাচ্ছে, তার পরীক্ষার প্রতিবেদন বলছে একরকম। আলট্রাসনোগ্রাফি বলছে একরকম। সেই ক্ষেত্রে রোগনির্ণয়ের জন্য ল্যাপারোসকপি করা হচ্ছে। এটি সঠিক রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করছে।
এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার। এখন মেয়েদের বিয়ের বয়সটা একটু বেড়ে গিয়েছে। দেখা যায়, অনেক মেয়েই আমাদের কাছে আসছে তার ডিম্বাশয়ে সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারি- এগুলো নিয়ে। সেটাও আমরা নির্ণয় করতে পারছি এবং পাশাপাশি ওভারি ড্রিলিং করতে পারছি ল্যাপারোসকপির মাধ্যমে।
জরায়ুর টিউমারের ক্ষেত্রে, আগের দিন হলে আমরা মনে করতাম পেট কেটে হয়তো বের করে ফেলতে হবে। এখন দেখা যায়, ২০ সপ্তাহের মধ্যে বা তার চেয়ে বেশি সময় এই সমস্যা হলে ল্যাপারোসকপির মাধ্যমে সার্জারি করা যাচ্ছে।
যত দিন যাচ্ছে, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে এর ব্যবহারের হারটাও বেড়ে যাচ্ছে। এর সুবিধা বেশি।
প্রশ্ন : ল্যাপারোসকপির কী কী সুবিধা রয়েছে বলে একজন সার্জন হিসেবে আপনি মনে করেন?
উত্তর : আসলে আমরা তো প্রথমে রোগীর সুবিধাটাই চিন্তা করি। এটাতে সময় কম লাগছে। যখন অস্ত্রোপচার হচ্ছে সেখানে রক্তপাতে আশঙ্কা অনেক কম থাকে।
মজার বিষয় হলো আপনি, যখন পেট খুলে অস্ত্রোপচার করছেন তখন একটি দৃশ্য হয়তো দেখছেন। তবে সার্বিক দৃশ্যটি দেখতে পারছেন না। ল্যাপারোসকপি যখন হচ্ছে তখন আপনি মনিটরের মাধ্যমে সার্বিক দৃশ্যটি দেখতে পারছেন। এ সময় ফুটো দিয়ে যন্ত্র ঢুকিয়ে আপনি পাচ্ছেন একটি বড় দৃশ্য। যে জায়গাটিকে অস্ত্রোপচার করছেন সেটি যেমন দেখতে পাচ্ছেন তেমনি এর চারপাশের অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন। সেই ক্ষেত্রে আপনার জন্য অস্ত্রোপচার করাটা সহজ হচ্ছে।
যদি আজকে অস্ত্রোপচার হয় তবে রোগী সকালবেলা ভর্তি হবে। সে সকালে অস্ত্রোপচারের পর বিকেলে বাড়ি চলে যাবে। এতে খরচ কমে যাচ্ছে। হাসপাতালে কম থাকতে হচ্ছে। আর এখন সবাই খুব ব্যস্ত। আপনি হাসপাতালে আছেন হয়তো রোগী হিসেবে। তবে আপনার পাশে থাকার মতো লোক নেই, সময় দেওয়ার মতো মানুষের অভাব। ল্যাপারোসকপির সার্জারির মাধ্যমে হয়তো আপনি সেই দিনই বাড়ি চলে যেতে পারছেন। যার ফলে খরচও কম হচ্ছে। আর যেকোনো বড় অস্ত্রোপচারে রক্ত যেমন লাগত, সেটিও লাগার প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে আসছে।
প্রশ্ন : এর অনেক সুবিধা আছে। এর মধ্যেও কী আপনারা কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হোন?
উত্তর : আপনাকে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আসলে কত শতাংশ রোগী আমাদের কাছে আসছে। হাসপাতালে যেই রোগীগুলো আসবে তারাই এই সাহায্যগুলো পাবে। আমাদের যেই রোগীগুলো উপজেলায় আছে, তাদের হয়তো আমরা এই সুবিধাটা দিতে পারছি না। আরেকটি বিষয় হলো, আপনাকে প্রশিক্ষিত হতে হবে। আপনি যখন প্রশিক্ষিত থাকবেন তখন অস্ত্রোপচার করতে পারবেন। যার ফলে এর একটি বিশেষ প্রশিক্ষণও আমাদের দেশে দরকার আছে। যন্ত্রপাতি গুলোর ও পুরোপুরি সাহায্য লাগবে। সব মিলিয়ে আসলে সুবিধা অনেক বেশি। অসুবিধা খুব কম।
প্রশ্ন : এই সুবিধাটুকু পাওয়ার ক্ষেত্রে আসলে কী করা দরকার?
উত্তর : সবাই পাচ্ছে না এটি যেমন সত্যি, তেমনি দিনকে দিন এই সেবাটি আবার ছড়িয়ে পড়ছে। আগে হয়তো ঢাকার কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে হতো। এখন ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন হাসপাতালে করা হচ্ছে। এর বিষয়ে সবাইকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে। যখন এটি বুঝবে তখন আসল বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে কোনো সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন : ল্যাপারোসকপি সার্জারিও তো এক ধরনের সার্জারি। এটি করতে গেলে রোগীর ফিটনেসের বিষয়টি কি দেখতে হয়?
উত্তর : যে কোনো সার্জারির মতো এখানেও অবশ্যই ফিটনেস দেখতে হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় হয় যে, ধরেন বয়স্ক একজন রোগী, তাঁর হয়তো এই সমস্যার পাশাপাশি আরো অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয় যে কত তাড়াতাড়ি এটি করা যায়। লক্ষ্য থাকছে, কম সময়ে সার্জারি করে বের হয়ে আসা। এর ফলে সুবিধাটা বেশি হয়।
প্রশ্ন : খরচ কেমন পড়ছে এ ক্ষেত্রে?
উত্তর : খরচ নির্ভর করে কোন অস্ত্রোপচার করছেন তার ওপর। তবে এই খরচটি এমন, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাও এটি করে সুফল নিতে পারবেন।
প্রশ্ন : অস্ত্রোপচারের পরে এটি দেখভাল করার কোনো বিষয় থাকে কি?
উত্তর : অস্ত্রোপচারটা তো হয় আপনি ফুটো করে করলেন, কোনো কাটাছেঁড়া নেই। সেই ক্ষেত্রে আমরা বলি সাতদিন পরে আপনি একটি ফলোআপে আসবেন। আসলে যেই ফুটোগুলো আমরা করেছিলাম মাইকোপোট দিয়ে, সেগুলো খুলে দিচ্ছি। যার যে সমস্যা সে অনুযায়ী পরামর্শ দিচ্ছি। বন্ধ্যাত্বের রোগীগুলো যখন আসে এই ক্ষেত্রে তখন আমরা তাকে বুঝিয়ে দিই পরবর্তী পদক্ষেপে কী করবে। তখন হয়তো আমরা ডিম ফোটার অসুখ দিয়ে দেব। মূল কথা হচ্ছে যার যেই সমস্যা থাকে, সেই সমস্যা অনুযায়ী আমরা তাকে পরামর্শ দিয়ে দিই।
আপনি যদি বলেন রোগীরা কতটুকু তৃপ্ত থাকে। তবে বলব ৯০ শতাংশ তৃপ্ত থাকে। সবাই পায় এমন একটি সার্জারি হোক যাতে চিহ্নটা না থাকে। এই সবাই চায় যত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাওয়া যায়। বেশি হলে সাতদিনের মধ্যেই আপনি আপনার কাজে চলে যেতে পারছেন।