ত্বকের জটিল রোগ সোরিয়াসিস
ত্বকের একটি জটিল রোগের নাম সোরিয়াসিস। রোগটি একেবারে ভালো হয় না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আজ ১৮ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৩৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান।
প্রশ্ন : সোরিয়াসিস একটি জটিল রোগ। এটি একবার হলে আর ভালো হতে চায় না। আমৃত্যু রোগীকে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সোরিয়াসিসে একজন মানুষ আক্রান্ত হন কেন?
উত্তর : সোরিয়াসিস হওয়ার পেছনে জন্মগত একটি প্রভাব আছে। পরিবেশগত কারণও জড়িত, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা জড়িত, সব কিছু মিলিয়ে এটি একটি মাল্টি ফ্যাকটারাল ইউটোলজি। অনেক কিছু মিলে এই রোগটি হয়।
প্রশ্ন : মাল্টি ফ্যাকটারাল বলতে কী বোঝায়? পরিবেশগত কী কী বিষয়ের কারণে এই সমস্যা হয়?urgentPhoto
উত্তর : পরিবেশগত কারণের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, যারা লাল মাংস বেশি খায়। গরুর মাংস, খাসির মাংস- এগুলো খাবেন না। মাছ খেতে পারবেন। কিছু কিছু ওষুধ আছে, যেমন : প্রেসারের ওষুধ বিটা ব্লকার, এটি রোগটি বাড়িয়ে দেয়। তারপর ব্যথার ওষুধ এনএসএআইডি (নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ) এগুলো খেলে এই রোগ বেড়ে যায়। তার মধ্যে আরেকটি ওষুধ আছে স্টেরয়েড। যেটার খুব ভুল চিকিৎসা হয় আমাদের দেশে। গ্রামেগঞ্জে যেসব পল্লী চিকিৎসকরা আছে রোগটিকে ফাঙ্গাশ মনে করে স্টেরয়েড দিয়ে দেয়। প্রথমে দেখা যায় স্টেরয়েড খাওয়ার পর রোগটি খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়। কিন্তু যখনই এটা বন্ধ করা হয়, তখন রোগটি আরো বেড়ে যায়। আমরা বলি রিবাউন ফেনোমেনা। এসব কারণে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে সোরিয়াসিসের রোগীরা ভুল ব্যবস্থাপনায় চলে যায়। সোরিয়াসিসের যদি ঠিকমতো চিকিৎসা না হয় তবে অনেক জটিলতা আছে। তাদের গিঁটে সমস্যা হতে পারে, সারা গায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। আমরা বলি, এক্সফলিটভি ডার্মাটাইটিস। সারা গা থেকে চামড়া ওঠা শুরু হয়ে যায়। এসব অবস্থাগুলো খুব জটিল।
প্রশ্ন : সোরিয়াসিসে মূলত কী হয়?
উত্তর : সাধারণত দেখা যায় যে হাঁটুতে, কনুইতে, মাথায়, হাতের মধ্যে, হাতের তালুতে, পায়ের তালুতে কিছু রিংয়ের মতো প্লাক তৈরি হয়ে যায়। তখন সেখান থেকে চামড়া উঠতে থাকে। একসময় সেটা লাল আকার ধারণ করে। আমরা বলি সিলভার স্কেল, মাছের আশের মতো উঠতে থাকে। খুবই বিরক্তিকর একটি বিষয়। এটা নিয়ে রোগী খুব মনঃক্ষুণ্ণ থাকেন। কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। এই সময় গাঁটগুলো শক্ত হয়ে যেতে থাকে। হাত পায়ের আঙ্গুলগুলো শক্ত হয়ে যেতে থাকে।
প্রশ্ন: সোরিয়াসিসের কারণে হার্ট বা অন্য কোনো কিছুর সমস্যা হয় কী?
উত্তর: না। দেহের ভিতরে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। শুধু গিঁটগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। আর একটি জটিলতা হয়, সারা গায়ে পুঁজের মতো হতে পারে। এগুলো খুব জটিল অবস্থা।
প্রশ্ন : জীবনযাপনের পদ্ধতি কি সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে?
উত্তর : হ্যাঁ, চাপের মধ্যে থাকলে সোরিয়াসিস বেড়ে যায়। চাপকে যত নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সোরিয়াসিস তত ভালো থাকে।
প্রশ্ন : একজন মানুষ সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হলে কী দেখে রোগ নির্ণয় করেন? এ ক্ষেত্রে কী ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়?
উত্তর : রোগীকে দেখলেই আসলে বোঝা যায়। সিলভার স্কেল আছে, লাল রঙের একটি অংশ থাকবে সেখান থেকে চামড়া উঠবে। কিছু নির্দিষ্ট জায়গা আছে কনুইতে, হাঁটুতে, হাত-পায়ের তলায়, মাথার মধ্যে হবে। মাথা থেকে খুশকির মতো উঠতে থাকবে।
তবে আবার ভিন্ন ধরনের সোরিয়াসিসও আছে। দেখা যায়, উল্টা জায়গাগুলোতে হচ্ছে। শরীরের ভাঁজের মধ্যে বেশি হচ্ছে। এটাকে আমরা বলি ইনভার্স সোরিয়াসিস। বিভিন্ন ধরনের সোরিয়াসিস আছে। এগুলো দেখে আমরা চিনে ফেলি। তা ছাড়া এক ধরনের সোরিয়াসিস আছে কোয়েবনিয়ার ফেনোমেনা। কোথাও যদি কেটে যায় বা ছিলে যায় সেখানে সোরিয়াসিলেশন তৈরি হবে। সর্বোপরি আমরা যেটা করি স্কিন বায়োপসি। একটি বায়োপসি করলে পুরোপুরি রোগটি নির্ণয় করা যায়।
প্রশ্ন : এর চিকিৎসার জন্য কী করা হয়? এটি কী পুরোপুরি ভালো হয়?
উত্তর : আসলে এটি পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। সোরিয়াসিসের রোগীকেও আমরা খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। শুধু এই রোগটি নিয়ে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস হয়। পৃথিবীর সবাই এই রোগটি নিয়ে বেশ চিন্তিত। এবং নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হচ্ছে। এর অনেক ভালো চিকিৎসা রয়েছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা রয়েছে, আবার কম খরচেও এর চিকিৎসা করা যায়। রোগীকে কত কম খরচে কত সাধারণ ওষুধ দিয়ে ভালো রাখা যায়, আমরা সেই চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : কী কী দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন?
উত্তর : নতুন একটি চিকিৎসা রয়েছে ভিটামিন ডি। আমরা আগে যেটা বলেছিলাম স্টেরয়েডের কথা, সেটি খাওয়া যাবে না। তবে টপিক্যাল অবস্থায় গায়ে মাখা যাবে কিছু দিনের জন্য। ক্যালসিপটট্রিয়ল নামে নতুন একটি ওষুধ এসেছে, এটি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। তারপর রয়েছে ফটোথেরাপি। এটিও সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে খুব ভালো। এগুলো দিয়ে খুব নিরাপদভাবে সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এমনকি বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও। তারপর আরো কিছু ইমিউনোসাপ্রেসিভ ড্রাগ আছে। আরেকটি রয়েছে ইরেটিনয়েক, ভিটামিন এ জাতীয় একটি ওষুধ। এটি খুব ভালো ওষুধ। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় খুব হিসাব করে দিতে হয়। আরো আছে সাইক্লোসপোরিন। এগুলো দিয়ে খুব দ্রুত সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আরো আধুনিক হলো বায়োলজিকস। এগুলো ইনজেকটেবল ফর্মেও এসেছে। তবে এগুলো খুব দামি। এখনই আমরা এর প্রয়োগ করতে পারছি না। এগুলো দিয়েও আমরা সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
প্রশ্ন : ফটোথেরাপি নিয়ে একটু বলুন। এটা কতদিন ধরে দিতে হয়। এটা কাজ করে কেমন?
উত্তর : যেই কোষগুলোর কারণে সোরিয়াসিস হয় ফটোথেরাপি সেই কোষগুলোকে কমিয়ে দেয়। এর ফলে ধীরে ধীরে সোরিয়াসিস কমে যায়। সোরিয়াসিস কোষগুলোকে তাড়াতাড়ি বাড়িয়ে দেয়। একটি কোষের নিচের ভাগ থেকে ওপরের ভাগে আসতে ২০ দিন লেগে যায়। এখানে দেখা যায় চার-পাঁচ দিনে চলে আসে। তখন তারা পরিপক্ব হতে পারে না। এই কোষগুলোকে ফটোথেরাপি চাপিয়ে দেয়। একে ন্যারোবেন্ড ইউভিবি বলি আমরা। সপ্তাহে দুটো করে দিই। এ ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০টা অনেকগুলো সেশন লাগতে পারে। প্রতি সেশনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হয়। কিছুটা ব্যয়বহুল। তবে অন্যান্য যেগুলো আছে যেমন রেটিনয়েডস এটাও ব্যয়বহুল। এগুলো দামি ওষুধ তবে নিরাপদ। আবার যেমন মেথোট্রেক্সেট এটি কম দামি ওষুধ। এটি দিয়ে ভালোভাবেই সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
যদি কেউ এর যত্ন করে এবং নিয়মিত চিকিৎসা করে তবে এর থেকে বড় কোনো ক্ষতি হবে না। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই রোগের জন্য যেন কোনো ওষুধ না খাওয়া হয়। এতে রোগ অনেক জটিল হয়ে যায়। পরে চিকিৎসার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়।