গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস, প্রয়োজনে ইনসুলিন নিন

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ঝুঁকি হয়। এ নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫৫৭তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. নাঈমা শারমিন হক। বর্তমানে তিনি শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : গর্ভবতী মায়ের সাথে ডায়াবেটিস-এই বিষয়ের সম্পর্ক কী?
উত্তর : গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস সম্পর্কে যদি বলতে হয়, এখানেও আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একজন মা, সে জানে যে আমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সে যদি গর্ভবতী হয়, তাকে আমরা বলব প্রি জেসটিশনাল ডায়াবেটিস কেস। আর আমি জানি না, আমার ডায়াবেটিস আছে,গর্ভধারণ করলাম, যখন পরীক্ষা করতে গেলাম ধরা পড়ল যে আমার রক্তে সুগার বেশি। তাকে আমরা বলি জেসটেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস। আমাদের কাছে এখন যেসব গর্ভবতী নারীরা আসেন তাদের মধ্যেও জেসটেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাসের হার অনেক বেশি। রোগী অবাক হয়ে যায়। বলে যে, আমি তো জানি না, আমার ডায়াবেটিস। কেউ কেউ বলে যে আমার তো ডায়াবেটিস ছিলই না।
রিপোর্ট কী ভুল? আমি আবার করব? এটা খুব প্রচলিত একটি প্রশ্ন।
প্রশ্ন : এদের জন্য আপনাদের পরামর্শ কী থাকে? করণীয় কী থাকে?
উত্তর : প্রথমে যখন একজন গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ে আসে, আমরা একটা ভাগ করি। এটি নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ। না কি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ মানে হলো তার পরিবারে কারো ডায়াবেটিস নেই। বাবা মায়ের নেই। তার কখনো ছিল না। এর আগে কখনো এমন কোনো বাচ্চা প্রসব হয়নি যে, যার ওজন চার কেজির বেশি। অথবা তার গর্ভধারণ হচ্ছে না। এই সমস্যা ছিল না ইত্যাদি সমস্যা না থাকলে তাদের আমরা নিম্ন ঝুঁকির মধ্যে ফেলি। আর যারা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, যাদের বাবার মায়ের ডায়াবেটিস আছে, এর আগের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস ছিল। কিংবা এর আগে অনেক বড় বাচ্চা প্রসবের ইতিহাস আছে। বা গর্ভধারণ হচ্ছিল না, অনেক কষ্ট করে হলো। অথবা প্রসবের সময়, কোনো কারণ ছাড়াই বাচ্চা হঠাৎ করে মারা গেল। অথবা পেটের মধ্যে বাচ্চা মারা গেল। এই ধরনের রোগীদের আমরা সাধারণত উচ্চ ঝুঁকির রোগী হিসেবে বিবেচনা করি। যারা নিম্ন ঝুঁকির থাকে, তাদের আমরা পরীক্ষা করি।
দেখা যাচ্ছে, আমরা ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়াই, এর এক ঘণ্টা পর আমরা রক্তের সুগারের মাত্রাটা দেখি। যদি কারো এই পরীক্ষাটি পজিটিভ আসে, এক ঘণ্টা পর যদি ব্লাড সুগারের মাত্রা সাত দশমিক আটের বেশি আসে, তখন আমরা তাদের জন্য ওজিটিটি করি। ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ানোর দুই ঘণ্টা পর আমরা রক্তের সুগারটি দেখি। যদি দেখি যে ওজিটিটি পজিটিভ, কোনো সন্দেহ নেই। তার ডায়াবেটিস নিশ্চিত।
এখন নির্ভর করে কখন রোগী আমাদের কাছে আসল, কখন আমি নিশ্চিত করলাম যে এটি গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস। যদি সে প্রথম তিন মাসের মধ্যে আসে, তাহলে নিশ্চিত করতে হবে এটি কি গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস, না কি আগে থেকে তার ডায়াবেটিস ছিল। এর জন্য আমরা হিমোগ্লোবিন এওয়ান সি পরীক্ষা করি। যে মা আগে থেকে ডায়াবেটিস এবং সে না জেনে গর্ভধারণ করে ফেলেছে, তার ক্ষেত্রে বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি থাকার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। আর জেসটেশনাল ডায়াবেটিস, মানে গর্ভাবস্থার পরে, গর্ভধারণের কারণে যে ডায়াবেটিস হয়, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রথম তিন মাসের পর থেকে প্লাসেন্টা বা ফুল যাকে বলি, সেটার কাজ যত পরিপক্ব হতে থাকে, তখন হরমোনের কারণে রক্তের সুগার বেড়ে যায়। যে মা গর্ভবস্থার কারণে ডায়াবেটিসে ভোগে তার সাধারণত দেখা যায় বাচ্চা প্রসবের পর ডায়াবেটিস থেকে যায়। আমরা তাই দেখি রোগী কি আগে থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, না কি গর্ভাবস্থার পরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলো।
প্রশ্ন : কোন ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : আমরা যে পরামর্শ রোগীকে দেই, সেটি তার ডায়েটের ওপর। খাবারটা সে কী খাবে? তাকে বলি চিনি, মিষ্টি ,গুড় খাবেন না। নিষেধ মানে নিষেধ। রোগীকে বলি। পাশাপাশি তাকে দেখভালের জন্য যে আসে তাকেও বলি রোগীকে খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন না। এরপরও যদি ডায়েটে সুগার নিয়ন্ত্রণ না হয়, শিশুর কথা চিন্তা করে তখন আমাদের রোগীকে ইনসুলিন দিতে হয়। ইনসুলিনই একমাত্র ওষুধ যেটা রক্তের সুগারকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। যেটা ওরাল হাইপোগ্লাইসেমিক ওষুধ দিয়ে সম্ভব নয়। আমরা রক্তের সুগার প্রোফাইল করি রোগীর। ছয়বেলা করা হয়। খালিপেটে কত থাকে এবং সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের দুই ঘণ্টা পর রক্তের সুগারের মাত্রা দেখে সেই অনুযায়ী ইনসুলিনের মাত্রাকে সমন্বয় করা হয়। সাধারণত আমরা শর্ট একটিং ইনসুলিনটা দেই। যদি এতে কারো নিয়ন্ত্রণ না হয়, সেক্ষেত্রে আমরা লং একটিং ইনসুলিন দেই।
প্রশ্ন : যারা আশপাশের আত্মীয় স্বজন আছেন, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
উত্তর : প্রথম পরামর্শ থাকে হলো খাওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ না করতে, আরেকটি হলো মানসিক সাহায্য করতে। বোঝাতে যে এটা তেমন কোনো বিষয় নয়, বাচ্চার ভালোর জন্য ইনসুলিনটা নিতে হচ্ছে।
ইনসুলিন নেওয়াকে যেন নেতিবাচকভাবে নেওয়া না হয়, সেজন্য পরিবারের লোকদের পরামর্শ দেই। রোগীর জন্য ও বাচ্চার ভালোর জন্য এই ইনসুলিনটা নেওয়া দরকার। এ ছাড়া দুপুরে দুই ঘণ্টা এবং রাতে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।