গাউট রোগ কেন হয়
গাউট বাত প্রচলিত একটি সমস্যা। সাধারণত দেহে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে গেলে বিভিন্ন অস্থি-সন্ধি বা জয়েন্টে প্রদাহ হয়, এই ব্যথাকে গাউট বলা হয়। আজ ১৯ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৪০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলোজি বিভাগের অধ্যাপক মিনহাজ রহীম চৌধুরী।
প্রশ্ন : গাউট একটি প্রচলিত রোগ এবং অনেকেই এ রোগে ভুগে থাকেন। একটু বুঝিয়ে বলবেন কী যে গাউট রোগটি আসলে কী এবং কেন হয়? শরীরের কোন অংশে হয়?
উত্তর : গাউট রোগটি বিশেষ করে মধ্যবয়সী পুরুষদের বেশি হয় এবং এটি যথেষ্ট প্রচলিত একটি রোগ। আমরা যদি সারা বাংলাদেশের লোকেদের বিবেচনায় আনি তাহলে সংখ্যা অনুপাতে খুঁজতে গেলে হয়তো কম হবে। কিন্তু আমরা যখন হাসপাতালগুলোতে দেখি তখন প্রচুর সংখ্যক গাউট রোগী পাই। গাউট রোগীদের সাধারণত বুড়ো আঙ্গুলে প্রথম আক্রমণ হয়। হঠাৎ করে সুস্থ মানুষের তীব্র ব্যথা শুরু হলো। ব্যথার সময় দেখা যায় বুড়ো আঙ্গুলের মাথায় ফুলে গেছে, লাল হয়ে গেছে, প্রচণ্ড ব্যথা করছে। ব্যথার চোটে হয়তো ঘুম ভেঙে যায়। এমনকি বলা হয় যে বিছানার চাদর পর্যন্ত সহ্য হয় না, এমনই ব্যথা করে। আমি যেটা বলছিলাম, মধ্যবয়স্ক পুরুষদের বেশি হয়। আর নারীর যখন মেনোপজ হয়, অর্থাৎ মাসিক যখন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়- তার পরের বয়সগুলোতে পুরুষদের মতো তারাও আক্রান্ত হয়। তাহলে আগের বয়সে, আমরা যেটাকে বলি রিপ্রোডাকটিভ বয়স, অর্থাৎ যখন মাসিক চলবে সেই সময় গাউটের আক্রমণ কম হয়। এ সময়টায় নারীর এ সমস্যা কম হলেও পরে নারী এবং পুরুষের প্রায় সমানভাবেই এ রোগ হয়।urgentPhoto
তবে আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাই, খুব বয়স্ক একটা মেয়ে বাত রোগ নিয়ে ভুগছেন- তখন আমরা ইউরিক এসিড পরীক্ষা করছি। আসলে তখন আর ইউরিক এসিড পরীক্ষা করে কোনো লাভ হয় না। এটা না করাটাই ভালো হবে। কিন্তু পুরুষদের জন্য বিপরীত হবে। পুরুষরা যদি এই ধরনের কোনো উপসর্গ নিয়ে আসে এবং আমার যদি মনে হয় এটা গাউট বাত হতে পারে, তবে আমি ইউরিক এসিড পরীক্ষা করাব।
প্রশ্ন : লক্ষণের মধ্যে একটি বলছিলেন, বুড়ো আঙ্গুল থেকে শুরু হয় এবং তীব্র ব্যথা হয়, ফুলে যায়। এ ছাড়া আর কোন কোন অংশ আক্রান্ত হতে পারে? আর কী ধরনের লক্ষণ দেখা যায়?
উত্তর : শতকরা ৫০ জনের দেখা যায়, বুড়ো আঙ্গুলের মাথা থেকে শুরু হয়। বাকি ৫০ শতাংশের বুড়ো আঙ্গুলের মাথা ছাড়াও হচ্ছে। অর্থাৎ পায়ের পাতার অন্যান্য যে অংশগুলো বা পাতার জয়েন্টগুলো থেকে এই ব্যথার উৎপত্তি হতে পারে। আরো একটু উপরের দিকে, আমরা যেটাকে বলি গোড়ালির জয়েন্ট; সেটা থেকেও হতে পারে। তারপর আরো একটু উপরে হাঁটু পর্যন্ত হতে পারে। এখানে একটি বিষয় মজার, গাউট কিন্তু একটু দূরের জয়েন্টগুলোকে আক্রমণ করতে চায়। একজন যদি মেরুদণ্ড, কোমর বা ব্যাকপেইন নিয়ে আসে আমার প্রথমেই চিন্তুা হবে এটা গাউটের বাত নয়। গাউটের বাত হবে একটু পেরিফেরির দিকে। পায়ের দিকে, হাতেরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ছোট ছোট জয়েন্টগুলো আক্রমণ করতে পারে। তবে হাতে আক্রমণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়।
প্রশ্ন : এই ধরনের ফুলে যাওয়াকে প্রচলিতভাবে অনেকেই বাতের ব্যথা বলতে চায়। এ ক্ষেত্রে রিউমাটোয়েড আরথ্রাইটিসের জন্য বা অন্য কোনো কারণে যদি ব্যথা হয় বা গাউটের জন্য যদি হয়, এটা আলাদা করার উপায় কী?
উত্তর : গিঁট ফুলে গেলে অবশ্যই এটি বাতের রোগ। তারপর আমাদের দায়িত্ব হবে- এই রোগকে কী আমরা গাউট বলব, রিউমাটোয়েড আরথ্রাইটিস বা গিটে বাত বলব, অস্টিওআরথ্রাইটিস বলব, নাকি রিউমেটিক ফিভার বলব। যেমন আমাদের দেশে একটি বিষয় খুব প্রচলিত। যেকোনো ধরনের বাতকে বলি আমরা বাতজ্বর। অনেক রোগীই আসেন, বলেন যে আমার বাতজ্বর হয়েছে! বাতজ্বর অনেক রোগের মধ্যে একটি মাত্র রোগ। বাতজ্বর সবার হয় না। বাতজ্বর ছোট বয়সে হয়, পাঁচ থেকে ১৫ বছরে হয়, ক্ষেত্রে বিশেষে একটু বড়দেরও হতে পারে। কিন্তু সেটার আশঙ্কা কম। বাচ্চাদের জন্যই সেটা প্রযোজ্য। সেই বাতজ্বরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অল্প দিনের মধ্যে জয়েন্টের ব্যথাগুলো চলে যাবে, থাকবে না। আমরা বলি তিন থেকে ছয় মাসের পর বাতজ্বরের কোনো রোগীর জয়েন্টে ব্যথা থাকবে না। তখন খুঁজতে হবে যে তার হার্টে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। আর অন্য যে বাতগুলো, এগুলো জয়েন্টগুলোকে আক্রমণ করবে এবং এখানেই থাকতে চাইবে।
তাহলে গাউট বাতটা আমরা কীভাবে বুঝব? আমি প্রথমেই বলছিলাম যে এটি মধ্য বয়স্ক পুরুষদের বেশি হয়। আরো কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন পায়ের গোড়ালির জয়েন্ট ফুলে যাওয়া, তীব্র ব্যথা হওয়া ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো, আমি যদি গাউট বাতের রোগীকে চিকিৎসা নাও দিই তাহলে দেখা যাবে প্রথম প্রথম তিন থেকে সাত দিন বা দশ দিনের মধ্যে ব্যথাটি চলে যাবে। ফোলাটাও কমে আসবে। কিছু না করলেও কমবে। তবে এত তীব্র ব্যথা হয় যে ব্যথানাশক ওষুধ দিতেই হবে। জয়েন্ট ফুলে থাকলে বেশি ব্যথা করলে ইনজেকশন নিতে হবে।
প্রশ্ন : এই কষ্টদায়ক রোগটি হয় কেন?
উত্তর : আমাদের শরীরের মূল্যবান একটি উপাদান পিউরিন। পিউরিন মেটাবলিজম থেকে এই রোগের উৎপত্তি হয়। পিউরিন যখন ভেঙে যায় এবং ভেঙে গিয়ে যখন সর্বশেষ অবস্থায় পরিণত হয় তখন আমরা এটাকে বলি ইউরিক এসিড। ইউরিক এসিড যখন শরীরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং জমা হতে থাকে, বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ এবং জয়েন্টের মধ্যে তখন এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। খাবারের প্রতিও সতর্ক থাকতে হবে।
প্রশ্ন : ইউরিক এসিড যখন বেড়ে যায় তখন কী খাবে না?
উত্তর : এখানেও আমাদের সমাজের বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে। আগে বলা হতো যে গাউটের রোগীর ক্ষেত্রে সব ধরনের শাক-সবজি নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন সেটা বলা হয় না। গাউটের রোগীদের ক্ষেত্রে কোমল পানীয় থেকে দূরে থাকতে হবে। আরো কিছু জিনিস আছে তাদের জন্য খারাপ। প্রাণীর কলিজা, মগজ, গিলা–এগুলো বাদ দিতে হবে। গরুর মাংস একেবারে নিষিদ্ধ না, তবে একটু সতর্ক হতে হবে। কম খেতে হবে। সামুদ্রিক মাছও একটু সতর্কতার সাথে খেতে হবে। শাক-সবজির ক্ষেত্রে আগের মতো আর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। নিয়মিত আমরা স্বাস্থ্যসম্মত যা খাই তার সবই খাওয়া যাবে।