পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুরোধে করণীয়
প্রায়ই আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর দেখতে পাই। এ রকম সমস্যা হলে কী করতে হবে এ বিষয়ে আজ ২৪ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৪৫তম পর্বে কথা বলেছেন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুর রহমান।
প্রশ্ন : আমরা অনেক সময় সংবাদমাধ্যম বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে শুনতে পাই ছোট্ট শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যায়। এটি একটি ভয়ঙ্কর বিষয়। আপনি এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। বাংলাদেশে ছোট শিশুদের বেলায় পানিতে ডুবে এই মৃত্যুর হার কেমন?
উত্তর : বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে পানিতে ডোবা একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যখন এক বছর পার হয়ে যায়। এক থেকে ১৭ বছরের মধ্যে যত শিশু মারা যায় এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশু এ রকম হয়ে মারা যায়। এমনকি সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক থেকে চার বছরের শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশ পানিতে ডুবে মারা যায়। কাজেই এটি একটা বড় শিশুস্বাস্থ্য সমস্যা। আমি মনে করি, এ সমস্যায় সবাইকেই এগিয়ে আসা উচিত সমাধানের জন্য।
প্রশ্ন : স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেও বড় বিষয় হলো এটি একটি দুর্ঘটনা। একটি সুস্থ সবল বাচ্চা হঠাৎ করে পানিতে ডুবে মারা গেল। অত্যন্ত দুঃখজনক একটি বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন শিশুর বেলায় সাধারণত কী কী কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটছে?urgentPhoto
উত্তর : ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একসাথে মিলে একটি জরিপ করেছিল। এটা ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি জরিপ এ বিষয়ে। আমরা প্রায় আট লাখ মানুষের কাছে গিয়ে এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। সেই জরিপ থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর আঠারো হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
প্রশ্ন : এই জরিপ কত বছর আগের?
উত্তর : এটা ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এখন আরেকটি জরিপ করা দরকার। জানা দরকার এর সংখ্যাটা কত হবে। এবং যেহেতু সারা দেশে এই বিষয়ে খুব বেশি কাজ নাই, তাই এখনো জানা যায়নি সংখ্যাটি কত। তবে এটা বাড়ারই কথা।
এই যে ১৮ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে, এর কারণ কী? এই শিশুগুলোর বেশির ভাগই হয় ছোট বয়সের। আমরা যেই শিশুগুলোর কথা বলছি তার ৮০ শতাংশ শিশু মারা যায় বাড়ির পাশে। আমাদের গবেষণায় এসেছে ২০ মিটারের মধ্যে। অর্থাৎ যে ঘরে সে ঘুমায়, সেই ঘরের ২০ মিটারের মধ্যে ৮০ ভাগ শিশু মারা যাচ্ছে। এক থেকে চার বছরের শিশু সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে।
কেন মারা যাচ্ছে? এই শিশুগুলো মাত্র হাঁটা শুরু করছে। নয় থেকে ১০ মাসে শিশুরা হাঁটা শিখে যায়। হাঁটা শিখে গেলে তাদের প্রকৃতিকে জানা-চেনার একটি অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়। দিনের নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত বাবা বা বড় ভাই হয়তো মাঠে কাজ করতে চলে যায়। অন্য ভাইবোন থাকলে স্কুলে চলে যায়। তখন কেবল মা বাড়িতে থাকে। আর মাকেও তো নানা কাজ করতে হয়। তাঁকে রান্নার কাজ করতে হয়, অন্যান্য কাজ করতে হয়। আপনি জানেন, গ্রামে প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির কাছে একটি করে ডোবা আছে। এই বাচ্চাটি হয়তো হাঁটতে হাঁটতে সেই ডোবাতে গিয়ে পড়ে যায়। মা হয়তো বাচ্চাটিকে খুঁজে পাচ্ছে না। ঘণ্টাখানেক পর দেখা গেল যে ভেসে উঠেছে। এটি হলো একটি ছোট বাচ্চার পানিতে ডুবে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। আবার এ রকমভাবেই রয়েছে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা।
প্রশ্ন : আমরা অনেক সময় সংবাদমাধ্যমগুলোতে এও দেখেছি গরুকে যে পানির পাত্রে খাওয়ায় সেখানে পড়ে গিয়েও মৃত্যু হয়েছে। আবার শহুরে বাচ্চাদের বেলায় শোনা গেছে বালতির পানিতে ডুবেও মৃত্যু হয়েছে। আপনাদের জরিপে কী বলে?
উত্তর : এ রকম তথ্য আমাদের জরিপে এসেছে। আসলে আমরা বাড়িতে বালতিতে পানি ভরে রাখি। বা শহরে বস্তি এলাকায় এ রকম রাখা হয়। এমনকি অনেক বাড়িতে ড্রামে করে পানি ভরে রাখা হয়। বাচ্চাটি হয়তো হাঁটতে হাঁটতে পানির কাছে গেছে। দেখতে চাচ্ছে পানির ভেতর কী আছে। তখন হয়তো পড়ে গেছে। মাথাটা ঢুকে যায় আর বের করতে পারে না। এ অবস্থায় মারা যেতে পারে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি পানির প্রয়োজন পড়ে না এবং বেশি সময়ও প্রয়োজন হয় না।
প্রশ্ন : একটি শিশু পানিতে ডুবলে কত সময়ের মধ্যে তাকে উদ্ধার করতে না পারলে তার মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি? এবং যদি সময়ের মধ্যে উদ্ধার করতেও পারে তবে করণীয় কী?
উত্তর : সাধারণত বলা হয়, পানির ভেতরে ডুবে গেলে পাঁচ মিনিট যদি কেউ থাকে তার মৃত্যুর আশঙ্কাই বেশি। আপনি জানেন, পানির ভেতরে কেউ থাকলে সে শ্বাস নিতে পারে না। শ্বাস না নিতে পারলে তার অক্সিজেনের অভাব হবে। অক্সিজেনের অভাব হলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। আর যদি মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় তবে বেঁচে থাকার পরেও তাকে অনেক ভুগতে হয়। আর পাঁচ মিনিট যদি পানির নিচে থাকে তবে তার মৃত্যুর আশঙ্কাই থাকে বেশি। কাজেই কোনো বাচ্চা যদি পানিতে ডুবে যায়, তাকে পাঁচ মিনিটের আগে উদ্ধার করতে পারলে বাঁচানোর সম্ভাবনা থাকে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে উদ্ধার করতে হবে। সেটা হলো প্রথম কাজ।
প্রশ্ন : অনেক সময় নাটক সিনেমায় আমরা দেখে থাকি কেউ যদি পানিতে ডুবে যায়, তাহলে পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করা হয়। এ সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?
উত্তর : পানিতে যদি কেউ ডুবে যায়, সে অনেক পানি খায়। খেলে পেটের মধ্যে পানি জমতে পারে। সেটা তেমন সমস্যার না। সমস্যাটা যেটা হয় সেটা হলো শ্বাস। অর্থাৎ ফুসফুসের মধ্যে যদি পানি ঢুকে যায় সে শ্বাস নিতে পারে না এবং মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি হয়ে যায়। সেজন্য পেটে চাপ দিয়ে পাকস্থলীর পানি বের করার কোনো দরকার নেই। এটি খুব জরুরি না। এতে ক্ষতি হতে পারে। তবে আমরা যদি ফুসফুসটাকে সচল করতে পারি এ জন্য বলা হয় তবে বাঁচানো সম্ভব। শ্বাস নেওয়ার যে নালি থাকে, সেটা ঠিক আছে কি না সেটা দেখা এবং সেটাকে ঠিক করা জরুরি। তার শ্বাসটাকে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য আমরা বলি মুখে শ্বাস বুকে চাপ। যাকে বলা হয় সিপিআর। সেটা যদি করা যেতে পারে তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমরা বলি পানি থেকে ওঠানোর পর সিপিআর করা জরুরি।
সিপিআর মানে, মুখে শ্বাস দেওয়া, অবস্থান ঠিক রাখা, মাথা নিচু করা বা বুকে চাপ দেওয়া এগুলো করতে হবে। পেটে চাপ নয়। নাটকে দেখি পেটে চাপ দেওয়ার পর মুখ দিয়ে অনেক পানি বের হলো, এরপর উঠে দাঁড়াল-এটার বাস্তব ভিত্তি নেই।
প্রশ্ন : এই যে চাপ দিয়ে পানি বের করছে, এই পানিটা যদি পেট দিয়ে গলায় বা মুখে চলে আসে, এটি কি পানিতে ডোবা ওই রোগীর মৃত্যুর কারণকে তরান্বিত করতে পারে ?
প্রশ্ন : হ্যাঁ করতে পারে। সেটা করলে দেখা যাবে যে তার ফুসফুসের মধ্যে পানি গিয়ে আরো শ্বাস নেওয়াকে সমস্যায় ফেলতে পারে। আমরা বলি পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার দরকার নেই। সিপিআর জানে, যেটাকে আমরা বলছি মুখে শ্বাস বুকে চাপ সেটা যদি কেউ জানে তবে সেটা করা।
প্রশ্ন : সিপিআরের পাশাপাশি তাকে কি চিকিৎসকের কাছে কত দ্রুত নিতে হবে?
উত্তর : তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতাল ছাড়া রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বাড়িতে দেওয়া যাবে না।