নাক ডাকার সমস্যায় কী করবেন

Looks like you've blocked notifications!
স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে চিৎ হয়ে শোবেন না। ছবি : কিউরমাই স্লিপ অ্যাপনিয়া

ঘুমের ঘোরে নাক ডাকাকে অনেকে প্রশান্তির লক্ষণ বলে মনে করেন। তবে এটা প্রশান্তি নয়, বরং এক ধরনের রোগ। মেডিকেলের ভাষায়, এটাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়। যদি ঘুমের সময় ১০ সেকেন্ড বা তারও বেশি সময় নিশ্বাস সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ হয়ে যায় এবং এ কারণে দেহের অক্সিজেন শতকরা তিন ভাগের বেশি কমে যায়, তবে তাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলে।

সাধারণ ভাষায় অনেকে এটাকে বোবায় ধরা বলে মনে করেন। শ্বাসনালির মাংসপেশি ঘুমের সময় আংশিক অবশ বা এটোনি হয়ে পরে, ফলে শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে পড়ে। শারীরিক স্থূলতা, মুখ ও করোটির গঠনগত ত্রুটির কারণে শ্বাসনালির সংকোচন আরো বেড়ে যায়। ফলে নাক ডাকার শব্দ হয়।

আবার অনেক সময় মস্তিষ্ক শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িত মাংসপেশিকে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি করে না, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

২০০৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ লোক ঘুমের ঘোরে নাক ডাকেন। এর মধ্যে ৭ শতাংশ লোক স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের বিপুলসংখ্যক লোক এ রোগে আক্রান্ত। তবে সচেতনতার অভাবে এ রোগ সম্বন্ধে বেশির ভাগই জানেন না। এ রোগ কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ

নাক ডাকা স্লিপ অ্যাপনিয়ার অন্যতম লক্ষণ। ঘুম যত গভীর হয়, নাক ডাকা তত বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ আচমকা ঘুম থেকে জেগে শ্বাস নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন; মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েন। অনেকের মুখ ও গলা শুকিয়ে যায়, ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে হয়। আক্রান্তরা যতক্ষণই ঘুমান না কেন, ঘুম থেকে ওঠার পর মাথাটা ভারী বোধ হয়, শরীর ম্যাজম্যাজ করে, সারা দিন ঝিমুনি ভাব থাকে, কাজে ঠিকমতো মন বসে না, স্মৃতিশক্তি একেবারে কমে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়, এমনকি যৌনক্ষমতা হ্রাস পায়।

ক্ষতিকর দিক

উচ্চ রক্তচাপের যে কারণগুলো জানা গেছে, এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো স্লিপ অ্যাপনিয়া। স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্তদের স্ট্রোক, হৃৎপিণ্ডের রোগ, যেমন—করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া ড্রাইভিং পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় দুই-তিন গুণ বাড়ে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করালে ধীরে ধীরে রোগীর পালমোনারি হাইপার টেনশন হয়ে হার্ট ফেইলিউর হতে পারে এবং মৃত্যুর হার প্রতি আট বছরে ৫ শতাংশ করে বাড়ে।

রোগ নির্ণয়

এ রোগ নির্ণয়ের অন্যতম পদ্ধতি হলো পলিসমনোগ্রাফি। স্লিপ ল্যাবরেটরিতে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুম পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ১৬টি লিড লাগিয়ে ঘুমন্ত ব্যক্তির ব্রেইন ওয়েভ, বুকের ওঠানামা, নাক ডাকার অবস্থা, হৃদস্পন্দন, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, পায়ের নাড়াচড়া ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়। পরে এ ডাটাগুলো বিশ্লেষণ করে স্লিপ অ্যাপনিয়ার তীব্রতা নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা অতিরিক্ত দিবানিদ্রার পর্যালোচনা করে এ রোগ নির্ণয় করেন।

চিকিৎসা

স্লিপ অ্যাপনিয়া দুই প্রকার—অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ও সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া। হার্ট ফেইলিউর, লিভার ফেইলিউর রোগে সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া দেখা দেয়। তাই এ রোগগুলোর চিকিৎসা করালে তা ভালো হয়। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসাপদ্ধতির মধ্যে সফল পদ্ধতি হলো কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার বা সিএপিএ। একটি ছোট যন্ত্র নাসারন্ধ্রের মধ্য দিয়ে গলার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে পজিটিভ প্রেশার তৈরি করা হয়, যা অনেকটা বেলুনের মতো কাজ করে। এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমিয়ে থাকলেও গলার চারদিকের মাংসপেশি সংকুচিত হয় না। ফলে নাক ডাকেন না এবং রোগীর নিশ্বাস বন্ধ হয় না। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমানোর সময় এটি ব্যবহার করবেন। এ যন্ত্র ব্যবহারে প্রথম দিকে কিছুটা অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। তবে ক্রমাগত ব্যবহারে তা থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাক বন্ধ হতে পারে। স্টেরয়েড স্প্রে ব্যবহার করলে এ সমস্যা মিটে যায়। এ ছাড়া সার্জারির মাধ্যমে নাক, তালু, গলবিল ও মাংসপেশি কেটে ফেলা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে নাক ডাকা ও শ্বাস বন্ধ হওয়া উপসর্গ থেকেই যায়। এ ছাড়া ওজন কমাতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ শতাংশ ওজন কমালে স্লিপ অ্যাপনিয়া ২৫ শতাংশ কমে। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে স্লিপ অ্যাপনিয়া বাড়ে। তাই বাম কাতে ঘুমানোর অভ্যাস করুন। সুষম খাবার খান। ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন। ঘুমের ট্যাবলেট সেবন থেকে বিরত থাকুন।

দেশে চিকিৎসা

দেশে এ রোগ নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে বেশ অজ্ঞতা আছে। অনেক সময় দেখা যায়, এ রোগে আক্রান্তরা হাঁপানি, সিওপিডি, গ্যাস্ট্রোইসেফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, করোনারি আর্টারি ডিজিজের মতো উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে উপস্থিত হন। তবে পরীক্ষা করে কোনো কিছু ধরা পড়ে না। ফলে তাঁরা এক চিকিৎসক থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে ছুটে বেড়ান। এ জন্য রোগীর কাছ থেকে ভালোভাবে ইতিহাস নিতে হবে।

সরকারিভাবে কোনো হাসপাতালে পেলিসমনোগ্রাফি হয় না। দেশে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে হয়। দাম পড়ে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সিএপিএ মেশিনও বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এসবের সাহায্যেও দেশে এর চিকিৎসা করা হয়।