নিরাপদ ভুবনভাবনায় ফ্যাশনের দায়
কনফারেন্স অব প্যারিস। কপ টোয়েন্টিওয়ান। দুই সপ্তাহের জলবায়ু মহাসম্মেলন। এতে অংশ নেয় ১৯৫টি দেশ। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে দীর্ঘ আলোচনা। বিস্তর উতোর-চাপান শেষে মাইলফলক চুক্তি সম্পন্ন হয়। পৃথিবীর ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, ঠেকায় পড়ে তাই একমত সবাই, প্রকৃতিকে দিতে হবে রেহাই। এ জন্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সব দেশ। ঠিক এই ক্রান্তিতে দাঁড়িয়ে অন্য সব ইন্ডাস্ট্রির মতো বাসযোগ্য পৃথিবীর অঙ্গীকারে দায় থেকে যাচ্ছে ফ্যাশনেরও। অতএব পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফ্যাশন ও লাক্সারি ইন্ডাস্ট্রিকেও হতে হবে সংযত, সচেতন। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বল্গাহীন জীবাশ্ম জ্বালানি খরচ, প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে এমন রঞ্জক, কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ আর জলের অমিতব্যয়ী ব্যবহার।
আমরাও তো এর বাইরে নই, অর্থাৎ বাংলাদেশ। সরকার এই চুক্তির পক্ষে রয়েছে। নিশ্চয়ই ভাবছে নিজের মতো করে। কিন্তু ভাবছে কি বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কুশীলবরা? ঠিক যেমন করে এরই মধ্যে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সব ব্র্যান্ড? কীভাবেই বা এই ইন্ডাস্ট্রি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিশ্বজুড়েই। ঠিক করে নিচ্ছে আগামীর রূপরেখা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না কোনো গাত্রদাহ আছে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির। বরং এখনো গিমিকনির্ভর তাদের কর্মকাণ্ড। এই তো গেল সপ্তাহে ঢাকায় ছিল ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের আয়োজন খাদি ফেস্টিভাল। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে দুই ডজন ডিজাইনারের কালেকশন দেখল ঢাকার এলিট ক্লাস। এই আসরে শ্রাদ্ধ্য হলো খাদির। খাদি সংজ্ঞায়িত হলো নতুন করে বাংলাদেশের বড়, মেজো, সেজো, ছোট ডিজাইনারদের হাত ধরে। ১২ বছর আগের সব্যসাচী মুখার্জির স্টাইলিং অনুকরণ, গেল বছর কার্ল লেগারফেলেল্ডের প্যারিস শোর ক্যাটওয়াক থিম অনুকরণ মঞ্চস্থ হতে দেখা গেল। কিন্তু পরিবেশসম্মত খাদি আসলে পরিবেশবান্ধব ছিল কি না, তা তারা তলিয়ে দেখেননি। যে রং ব্যবহার হয়েছে তার মান কি পরখ করে দেখা হয়েছে, সেটি স্বাস্থ্যসম্মত কি না? বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউসগুলো কেউই এ ব্যাপারে সচেতন নয়। সেই প্রয়াসও তাদের মধ্যে নেই।
প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত না করার বিষয়ে ভাবার কথা সবার। কিন্তু কে-ই বা ভাবছেন? ভাবছে কি সুশীলসমাজ, রাজনীতিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতিরা? সাধারণ মানুষ তো আরো পরে আসে।
তবে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে সচেতন করে তোলার জন্য সরকারকে নীতিমালা তৈরি করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সেটা যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। আর ব্যবহার করা যেতে পারে সোশ্যাল মিডিয়াকে, কার্যকরভাবে।
আপাতত স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমানো যাক পারিতে। প্যারিস আলোচনার মোদ্দা কথা কে না জানে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। আপাতত চার বছরের নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চলবে। চুক্তি কার্যকর হবে ২০২০ থেকে। লক্ষ্য বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না ওঠা। উপরন্তু চেষ্টা থাকবে ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখা। কারণ ২ ডিগ্রির বেশি হলে আশঙ্কা থেকে যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের। যার ফলে নিয়মিতই ঘটবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কারণে-অকারণে আবহাওয়া হবে বৈরী, মেরু বরফের গলা ত্বরান্বিত হবে আর বিপজ্জনকভাবে বাড়তে থাকবে সমুদ্রের পানির পরিমাণ।
প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি আর যাই হোক একটা বার্তা অন্তত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে যে চীন, ভারতসহ সব উন্নয়নশীল দেশকেই ভবিষ্যতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে হবে। বেসরকারি খাতকেও এ ব্যাপারে সমান সহযোগিতা করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর হওয়ার জন্য বিজনেসলিডারদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হবে বলেই আশাবাদী এই চুক্তির সমর্থকরা।
এই চুক্তির এসব দিক না হয় বোঝা গেল। কিন্তু এটা ফ্যাশন আর লাক্সারি ইন্ডাস্ট্রির জন্য কি কোনো অর্থ বহন করছে? এর উত্তর অবশ্যই ইতিবাচক। অন্তত বিভিন্ন শীর্ষ আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ও লাক্সারি ব্র্যান্ডের কর্মকর্তাদের তেমনটাই ভাষ্য। অনেকেই এই চুক্তিকে পরিবর্তনের সূচনাক্ষণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্য শিল্প কেবল নয়, ফ্যাশন্ এবং লাক্সারি ইন্ডাস্ট্রিকেও হয়ে উঠতে হবে সক্ষম হ্রস-কার্বন অর্থনীতি, মনে করেন নাইকির টেকসই ব্যবসাপ্রধান হানা জোনস, এ জন্য এই শিল্প খাতেরও প্রয়োজন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জলবায়ু বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া।
প্যারিস চুক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছেন ফ্যাশন ফেটারনিটি। এর প্রমাণ মেলে এইচঅ্যান্ডএমের টেকসই ব্যবসা বিশেষজ্ঞ পিয়ের ব্রোয়েসনের বক্তব্যে। তিনি মনে করছেন নিরাপদ প্রকৃতি আর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এই পদক্ষেপ বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
এর আগে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম অ্যাডিডাসের উদ্যোগ। তারা পার্লে অব ওশানের সঙ্গে উদ্ভাবন করেছে বিশেষ থ্রিডি প্রিন্টেড মিডসোলে স্নিকার্স। তাদেরও ভাষ্য, বৈশ্বিক নেতারা যা করেছেন, সেটা তাঁদের দায়িত্বেরই পরিচায়ক। তবে আমাদের কাজে নেমে পড়া উচিত কারো কোনো নির্দেশনার অপেক্ষা না করেই। কেরিংয়ের টেকসই প্রধান মারি-ক্লেয়ার ডাভো এখন থেকেই তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেছেন যাতে তাঁরা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন।
স্মরণযোগ্য, ২০২০ সালে মধ্যে ২৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের সিদ্ধান্ত ২০১২ সালেই নেয় লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানি। সুখের বিষয় মাত্র দুই বছরেই তারা ২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এই ফল তাদের আরো আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যানা ওয়াকার মনে করছেন ২০১৬ সালে তারা নতুন করে তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করবে।
এখন শঙ্কাটা অন্যত্র। পরিবেশের জন্য মূল ঝুঁকির কারণ সাপ্লাই চেইনরা। কাঁচামাল উৎপাদন পর্যায়টা আসলে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়ে গেছে। ছোট ছোট উৎপাদকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন বলে অনেক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মানতেই হবে তুলা এবং ক্যাশমেয়ার উৎপাদনে প্রচুর বিদ্যুৎ আর জল খরচ হয়। আর যেসব দেশে এসব কাঁচামাল উৎপন্ন হয় তারা এমনিতেই রয়েছে বন্যা, খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে। উপরন্তু রেয়ন আর ভিসকস উৎপাদনের দরুন ত্বরান্বিত হচ্ছে বৃক্ষনিধন।
কাপড় ও পোশাক রাঙানো এবং পরিষ্কার করার জন্য প্রচুর জ্বালানিও লাগে। একইভাবে তৈরি পোশাক পরিবহনে একটা ফ্যাক্টর বৈকি। এসব জায়গায় নজর দেওয়ার সময় এসেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির চাপ কমানোর বিকল্প হবে একমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি।
এই ক্রান্তিতে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠে আসে- হ্রাস-কার্বন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ। আর তা করে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে তো?
এই মুহূর্তে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। তার পরিমাণ যেমনই হোক। তাই টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এভাবে ভাবতেই হবে। একটি পরিবেশবাদী গ্রুপ ১০০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করছে, যারা শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অঙ্গীকার করেছে। এই দলে আছে গুগল, এইচঅ্যান্ডএম, নাইকি, ইউযুক্স গ্রুপ।
বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করছেন পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হ্রাসতর কার্বন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারে। এ জন্য অবশ্য আইনি ব্যবস্থাও প্রয়োজন হবে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অনেক প্রতিষ্ঠানই টেকসই লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে। তাদের এখন থেকে নিয়ে আসতে হবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাসের পরিবেশ সুরক্ষার কার্যক্রমের আওতায়।
অনেক বিশেষজ্ঞ আবার ক্রেতাদের সচেতন করার জন্য পণ্য উৎপাদনের গল্পটাও বলে দেওয়ার পক্ষপাতি। তা ছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম দিনকে দিনকে আমাদের জীবনকে অনেকটাই স্বচ্ছ্ব করে দিচ্ছে। রাখঢাক কমে আসছে। এটাও এই আন্দোলনে পৃথিবীজুড়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে।
তবে অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। গ্রহণ করছে নানা পদক্ষেপ। এ জন্য তারা বিভিন্ন এনজিও বা পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, কেরিং এবং টিফানি দুটি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন ফুটপ্রিন্ট শূন্যে নামিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।
প্যারিস চুক্তির অংশ হিসেবে ১০০ বিলিয়ন তহবিল ২০২০ সালের মধ্যে তৈরির অঙ্গীকার করেছে সবগুলো দেশ। এই অর্থে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করা হবে। পাশাপাশি এইচঅ্যান্ডএমের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের উৎপাদকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। তারা প্রযুক্তিগত উন্নয়নে যেমন ভূমিকা রাখার বিষয়ে ভাবছে, তেমনি শুরু করেছে পুরোনো পোশাক পুনর্ব্যবহারের কার্যক্রমও। উদ্দেশ্য পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্য অর্জন।
বিশ্বজুড়ে এখন দশে মিলি করি কাজে মনোযোগী শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। নিজেদের গোপনীয় বিষয় সবাই জেনে যাবে এমন আশঙ্কার ভূত নিজেদের ঘাড় থেকে নামিয়ে অভিন্ন লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে প্রয়াসী হচ্ছে তারা। বস্তুত ফ্যাশন জীবনেরই অংশ। যাপিত জীবনে এর প্রয়োজনকে অস্বীকার করতে পারবে? এ জন্যই তো সম্মিলিতভাবেই উদ্যোগ নিতে হবে রাজনীতিক, সুশীলসমাজসহ সব শ্রেণি ও পেশাজীবীদের।
পরিশেষে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কী ভাবছে বাংলাদেশ? আমরা আছি প্যারিস চুক্তির পক্ষে। দায়িত্ব আমাদেরও তাই থেকেই যাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও লাইফস্টাইল প্রফেশনাল