শীতের ছয় মজাদার পিঠা
পিঠা আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার। বাংলাদেশে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি হয়। তবে পিঠা তৈরি ও খাওয়ার জন্য শীতকাল সবচেয়ে ভালো মৌসুম। শীতের সকাল পিঠা খাওয়ার উপযুক্ত সময়। পিঠা বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির একটি অংশ। বেশিরভাগ পিঠাই মৌসুমী। বিশেষ করে শীতের মৌসুমেই ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি করা হয়। কারণ কিছু উপাদান শুধুমাত্র এই সময়েই পাওয়া যায়। কিছু পিঠা নবান্ন এবং পৌষ পার্বণের মতো ফসল কাটার উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পিঠা তৈরির জন্য চালের গুড়ো, নারকেল, গুড়, দুধ, তেল ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। এটা নির্ভর করে পিঠার ধরনের ওপর। কিছু পিঠা মিষ্টি আবার কিছু নোনতা, কিছু নরম আবার কিছু শক্ত।
শীতকালের ছয়টি মজাদার পিঠার রেসিপি তুলে ধরা হল-
১. পাটিসাপটা
পাটিসাপটা হল একটি পাতলা সুইডিশ প্যানকেক বা ক্রেপ ধরনের পিঠা, খুব বিশেষ এবং বাঙালিদের কাছে খুব পছন্দের। এটি ছাড়া কোন বিশেষ অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না। অনেক বৈচিত্র্য থাকতে পারে, কখনও কখনও গুড়ের সঙ্গে প্রস্তুতকৃত নারকেলের মিশ্রণে ব্যবহার করা হয় এবং কখনও কখনও ক্ষীর বা ক্ষীরশা ব্যবহার করা হয়। অনেকে জাফরান, শুকনো বাদাম এবং কিশমিশ ব্যবহার করে থাকে।
পাটিসাপটা পিঠা করতে যা লাগবে-
উপকরণ:
দুধ ২ লিটার,
চিনি ৫০০ গ্রাম,
সুজি দুই টেবিল চামচ,
মিহি নারিকেল কোরা আধা কাপ,
চালের গুঁড়া ১ কেজি,
ময়দা আধা কাপ,
ভাজার জন্য তেল,
পানি পরিমাণ মতো
চিনি স্বাদমতো
প্রস্তুত প্রণালী:
প্রথমে অর্ধেক চিনি আর দুধ ঘন করে জ্বাল দিতে হবে। এবার তার ভেতর সুজি আর নারিকেল কোরা ছেড়ে ক্ষীর তৈরি করে নিতে হবে। ক্ষীর ঘন হলে নামিয়ে রাখুন। চালের গুঁড়া, বাকি চিনি, পানি আর লবণ দিয়ে পাতলা গোলা করে নিন। ফ্রাই প্যানে সামান্য তেল নিয়ে গরম করে নিতে হবে। এবার আধা কাপ গোলা দিয়ে একটা পাতলা রুটির মতো বানিয়ে নিন। রুটির ওপরের দিকে শুকিয়ে এলে এক টেবিল চামচ পরিমাণ ক্ষীর দিয়ে মুড়িয়ে পাটিসাপটার আকার দিয়ে আরেকবার ভেজে নিন। এভাবে একটি একটি করে পিঠা বানিয়ে নামিয়ে আনুন। ঠাণ্ডা হলে পরিবেশন করুন মজার পাটিসাপটা পিঠা।
২. ভাপা পিঠা
ভাপা পিঠা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা যা প্রধানত শীত মৌসুমে প্রস্তুত ও খাওয়া হয়। এটি প্রধানত চালের গুড়া দিয়ে জলীয় বাষ্পের আঁচে তৈরি করা হয়। মিষ্টি করার জন্য দেয়া হয় গুড়। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য নারকেলের শাঁস দেয়া হয়। ঐতিহ্যগতভাবে এটি একটি গ্রামীণ নাশতা হলেও বিংশ শতকের শেষভাগে প্রধানত শহরে আসা গ্রামীন মানুষদের খাদ্য হিসেবে এটি শহরে বহুল প্রচলিত হয়েছে। রাস্তাঘাটে এমনকি রেঁস্তোরাতে আজকাল ভাপা পিঠা পাওয়া যায়। এই পিঠা অনেক অঞ্চলে ধুপি নামেও পরিচিত। এর ধরনের মধ্যে রয়েছে মিষ্টি ভাপা ও ঝাল ভাপা।
ভাপা পিঠা তৈরি করতে যা লাগবে-
উপকরণ:
চালের গুঁড়া ১ কেজি,
নারিকেল ১ টা (কোরানো),
গুড় কুচানো (২৫০ গ্রাম),
লবণ (পরিমাণমত),
পানি (পরিমাণমত)
প্রস্তুত প্রণালী:
একটি পাত্রে চালের গুঁড়া, লবণ ও অল্প অল্প পানি দিয়ে ঝরঝরে করে ভালো ভাবে মাখতে হবে যেন দলা পাকিয়ে না যায়। এইবার এই চালের গুঁড়া চালনিতে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে চালতে হবে। কোরানো নারিকেলের অর্ধেকটা চেলে নেয়া চালের গুঁড়ার সঙ্গে মাখতে হবে।এইবার হাঁড়ির অর্ধেকটা পানিতে ভরে জ্বাল দিয়ে পানি ফুটে ভাপ ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন পিঠার জন্য ছোট বাটিতে এক ফোটা তেল মেখে কিছু মাখানো চালের গুঁড়া দিয়ে তার ওপর গুঁড় ছিটিয়ে দিতে হবে এবং এর ওপর আবার চালের গুঁড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আলতো হাতে চেপে সমান করে ভাপা পিঠার আকার তৈরি করে নিতে হবে। এবার বাটিটা ভেজা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে গরম পানির হাঁড়ির উপর উপুড় করে বসিয়ে দিতে হবে। এবার বাটিটা আস্তে করে সরিয়ে নিতে হবে। খেয়াল করতে হবে যেন পিঠা ভেঙ্গে না যায়। ৫/৭ মিনিট ভাপে সেদ্ধ হলে ঢাকনা সরিয়ে আঙ্গুল দিয়ে চেপে দেখতে হবে নরম হয়েছে কিনা। নরম হলে বুঝতে হবে পিঠা পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত।
৩. দুধ চিতই পিঠা
পরিবারের প্রিয়জনদের জন্য ঘরেই তৈরি করতে পারেন দুধ চিতই পিঠা।
দুধ চিতই পিঠা তৈরির করতে যা লাগবে-
উপকরণ:
দুধ ২ লিটার,
খেজুর গুড় ২ কাপ,
নারিকেল কোড়ানো ১ কাপ,
এলাচ ও দারুচিনি ৪/৫ টুকরো করে,
পানি সামান্য,
আতপ চাল ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে বেটে নিন বা কিছুটা নরমাল পানি দিয়ে ব্লেন্ড করে নিন।
প্রস্তুত প্রণালী:
হালকা গরম পানি ও লবণ দিয়ে নেড়ে মাঝারি ঘনত্বের গোলা তৈরি করে নিন। চিতই পিঠার খোলা গরম করে ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে নিন।
এক চামচ করে গোলা খোলার প্রতিটা ঘরে দিয়ে ঢাকনি দিয়ে ঢেকে দিন। ৪/৫ মিনিট পর পিঠা হলে খুন্তি দিয়ে চাপ দিয়ে উঠিয়ে নিন।
অল্প আঁচে দুধ চুলায় বসান। এলাচ ও দারুচিনি দিন। বলক উঠলে নামিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা করে নিন। সামান্য পানি গরম করে গুড় গলিয়ে নিন। দুধে মিশিয়ে নেড়ে আবার চুলায় দিন। মৃদু আঁচে দুধে বলক তুলুন।
গরম পিঠাগুলো দিয়ে পাঁচ মিনিট জ্বাল করুন। অর্ধেকটা নারিকেল কোড়া ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে ঢেকে চুলা থেকে নামিয়ে রাখুন। ৪-৬ ঘণ্টা পর পিঠা ভিজে নরম হয়ে গেলে ওপরে বাকি অর্ধেক নারিকেল কোড়া ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
৪. ছিটা পিঠা
মুরগি, গরু কিংবা খাসি যেকোনো মাংসের ঝোলের সঙ্গে ছিটা রুটি পিঠা খাওয়ার স্বাদই আলাদা। শীত এলেই মজাদার এ ছিটা রুটি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। এটি তৈরি করাও বেশ সহজ। দেখতেও যেমন সুন্দর; খেতেও তেমনই মজাদার ছিটা রুটি।
চালের গুড়ার মিশ্রণে হাত চুবিয়ে তাওয়া বা প্যানের উপর ছিটিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ এ রুটি। যে কারণে এর নাম ছিটা রুটি। কেউ আবার ছটকা রুটি বা ছিটরুটিও বলে থাকেন।
ছিটা পিঠা করতে যা লাগবে-
উপকরণ:
চালের গুড়া ২ কাপ (১২-১৫টি রুটি হতে পারে),
পানি ৩ কাপ,
ডিম ১টি ফেটানো,
লবণ পরিমাণমতো,
তেল পরিমাণমতো
প্রস্তুত প্রণালী:
প্রথমে একটি পাত্রে লবণ ও ৩ কাপ পানিতে চালের গুড়া মিশিয়ে নিন ভালো করে। পাতলা মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এ মিশ্রণের সঙ্গে একটি ডিম ফেটিয়ে মিশিয়ে নিন। এ অবস্থায় মিশ্রণটি ১৫ মিনিট রেখে দিন। এরপর একটি প্যানে তেল ব্রাশ করে চালের গুঁড়ার মিশ্রণে হাত চুবিয়ে প্যানে ছিটিয়ে দিন। আঙুলগুলো প্যানের উপর ঝেড়ে নিন। এভাবে প্রতি রুটির জন্য ৩-৪ বার মিশ্রণটিতে হাত চুবিয়ে পরপর ছিটিয়ে দিন।
চুলার আঁচ কমানো থাকবে রুটি যেন পুড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। রুটি হয়ে গেলে আলতো করে পাটিসাপটার মতো রোল করে অথবা তিন কোণা আকৃতির ভাঁজ করে তুলে ফেলুন।
এভাবেই একেক করে ছিটা রুটি পিঠা তৈরি করে নিন। রুটিগুলো যেন গরম থাকে এমন কিছুতে তুলে রাখুন। মিশ্রণটি যদি জমে যাওয়ার মতো হয়; তাহলে একটু পানি মিশিয়ে ভালো করে নেড়ে নিন।
বানানো হয়ে গেলে ছিটা রুটির সঙ্গে ভুনা মাংস ও ঝোল, সালাদ, খেজুরের রস কিংবা নারকেল কোরানো দিয়ে পরিবেশন করতে পারেন।
৫. ভাপা পুলি পিঠা
নারিকেল দিয়ে ভাপা পুলি পিঠার খুব সহজ একটি রেসিপি। মিষ্টি খেতে না চাইলে ভেতরে মাংস বা সবজির পুর দিয়েও তৈরি করা যায়।
ভাপা পুলি পিঠা করতে যা লাগবে-
উপকরণ:
চালের গুঁড়ো আধা কেজি,
ময়দা ৩ টেবিল চামচ পানি পরিমাণ মতো,
লবণ সামান্য,
নারকেল কোড়ানো দেড় কাপ,
খেঁজুরের গুঁড় বা চিনি দেড় কাপ,
সাদা তিল ভেজে গুঁড়ো করা আধা কাপ,
ঘি ২ টেবিল চামচ
প্রস্তুত প্রণালী:
নারকেল গুঁড় ও তিল একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে পুর তৈরি করে নিন। পুর ঠাণ্ডা হতে দিন। এবার চুলায় পরিমাণমতো পানি ও লবণ দিন। ফুটে উঠলে ২ টেবিল চামচ ঘি দিয়ে চালের গুড়ো ও ময়দা দিয়ে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখুন অল্প আঁচে। সেদ্ধ হলে নামিয়ে ভালো করে মথে নিন। এবার কাই থেকে লুচির মতো বেলে ভিতরে পুর দিয়ে কোনাগুলো ভালো করে চেপে মুড়ে দিন। চাইলে সুন্দর নকশাও করে দিতে পারেন। এবার হাঁড়িতে পানি দিয়ে ফুটে উঠলে বাঁশের চালনি বসিয়ে দিন। এই চালনিতে পিঠা দিয়ে ঢেকে ভাপ দিয়ে নিন। স্টিমারেও স্টিম দিতে পারেন। স্টিম করতে পারেন রাইস কুকারেও। পিঠা সেদ্ধ হয়ে গেলে গরম গরম পরিবেশন করুন।
৬. নকশি পিঠা
নকশি পিঠা দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও ততটা সুস্বাদু। মুচমুচে এই পিঠা সবার কাছেই পছন্দের একটি খাবার। শীতের পিঠার তালিকায় নকশি পিঠা থাকবে না, তাই কি হয়! অল্প কিছু উপকরণে খুব সহজেই তৈরি করতে পারবেন সুস্বাদু এই পিঠা।
নকশি পিঠা তৈরি করতে যা লাগবে-
উপকরণ:
চালের গুঁড়া- ৪ কাপ,
পানি- ৩ কাপ,
লবণ- সামান্য,
ঘি- ১ টেবিল চামচ,
তেল- ভাজার জন্য
সিরা তৈরি করতে যা লাগবে
গুড়- ১ কাপ,
চিনি- ১ কাপ,
পানি- ২ কাপ,
সিরা তৈরি করবেন যেভাবে
সব উপকরণ একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে সিরা তৈরি করে নিতে হবে।
প্রস্তুত প্রণালী:
পানির সঙ্গে লবণ ও ঘি মিশিয়ে চুলায় বসান। ফুটে উঠলে তাতে চালের গুঁড়া মিশিয়ে সেদ্ধ করুন। পিঠার ডো নামিয়ে ঠাণ্ডা করে ভালোভাবে মেখে নিন। এবার আধা ইঞ্চি পুরু করে রুটি বানিয়ে পছন্দমতো আকার দিয়ে কেটে নিন। খেজুর কাঁটা দিয়ে রুটিতে পছন্দমতো নকশা করুন। এরপর ডুবো তেলে ভেজে নিন। কিছুক্ষণ পর আবার তেলে ভেজে সিরায় দিয়ে ১ মিনিট রেখে তুলে নিয়ে পরিবেশন করুন।