সিভি লেখার সময় যে বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকা উচিত
কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সিভি তৈরি, যেখানে প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত মূল্যবান। নিয়োগকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যেখানে সুযোগ থাকে এক অথবা সর্বোচ্চ দুই পৃষ্ঠার মধ্যে নিজেকে উপস্থাপনের। অসম্পূর্ণ সিভি যেমন কাম্য নয়, ঠিক তেমনি অপ্রাসঙ্গিক, অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় তথ্যের
সয়লাবও সিভিকে গুরুত্বহীন করে তোলে। তাছাড়া শব্দের আধিক্যের সঙ্গে থাকে ভুল-ভ্রান্তির আশঙ্কা।
এমনকি কোনোভাবে ইন্টারভিউ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও ঘটতে পারে বিপত্তি। চলুন, জেনে নেওয়া যাক চাকরির সিভিতে ঠিক কোন বিষয়গুলো পরিহার করা জরুরি।
বানান ও ব্যাকরণগত ভুল
একটি সিভির উপাদানগুলো চাকরির অঙ্গন, প্রার্থীর দক্ষতা ও সৌন্দর্য্য বোধের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে প্রতিটি সিভি বানান ও ব্যাকরণগত দিক থেকে নির্ভুল হওয়া আবশ্যক। এই ধরনের ত্রুটিগুলো প্রার্থীর সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। কেননা বাক্য গঠনের ন্যূনতম নিয়ম-কানুন অনুসরণের মাঝে আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রতিফলন ঘটে। অনিচ্ছাবশতও যদি তা হয়ে যায়, তখন ধরেই নেওয়া হয় যে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোতে তার বিশদ মনোযোগ নেই।
দীর্ঘ প্যারাগ্রাফ দিয়ে শুরু করা
চোখের সামনে একটি সিভি ধরা হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে দৃষ্টি পড়ে শিরোনামের দিকে। সিভির একদম উপরের অংশে নামের নিচের এই জায়গাটুকু এক নজরে প্রার্থীর সম্পর্কে ধারণা লাভের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। এখানে পরিচিতি পর্বটা দীর্ঘ হলে এই সিভির বাকি অংশ পড়ার আর আগ্রহ থাকে না। তাই এই সূচনা শব্দগুলো হওয়া উচিৎ সুচিন্তিত, সংক্ষিপ্ত এবং আগ্রহ উদ্দীপক।
এক সময় সিভির শুরুতে ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ বেশ জনপ্রিয় ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন যখন কম সময়ে হাজার সিভি দেখার, সেখানে ৩ থেকে ৪ লাইনের প্যারাগ্রাফ পড়া নিতান্তই সময়সাপেক্ষ।
অপ্রাসঙ্গিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা
বর্তমানে প্রতিযোগিতাপূর্ণ যুগে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য যে সময়ের প্রয়োজনে বড় বড় কাজগুলো ভেঙে এখন ছোট ছোট পদের সৃষ্টি হচ্ছে। বিকেন্দ্রীকরণের এই ব্যবস্থায় অগ্রাধিকার পায় কিছু সুনির্দিষ্ট পারদর্শিতা। তাই শুধুমাত্র সেই পারদর্শিতাগুলোকেই অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ, যেগুলো উদ্দিষ্ট চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে চাওয়া হয়েছে।
তাছাড়া স্কুল-কলেজ জীবনের এমন অনেক অর্জন রয়েছে, যেগুলো কোনো ভাবেই উল্লেখিত পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যারা জীবনের প্রথম চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন তাদেরও এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। অসামঞ্জস্য তথ্য দিয়ে দুই পৃষ্ঠার সিভি অপেক্ষা প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পর্কিত তথ্যে ভরপুর এক পৃষ্ঠার রেজুমিই উত্তম।
অস্পষ্ট সফট স্কিল ও অভিজ্ঞতা
সমস্যা-সমাধানকারী, স্বপ্রণোদিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারা; এরকম সফট স্কিলগুলো অনেকেই তাদের সিভিতে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু এগুলো জায়গার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলোর পরিবর্তে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হার্ড স্কিলগুলো দেয়া ভালো; যেমন গাড়ি চালানো, বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও সম্পাদন সফটওয়্যার বা কোনো নির্দিষ্ট মেশিন অপারেশনে পারদর্শিতা। তবে উত্তম পন্থা হলো সফট স্কিলগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা।
এটি অভিজ্ঞতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শুধুমাত্র কোম্পানি ও পদবির নাম সংযোজনটাই যথেষ্ট নয়। এক লাইনের মধ্যে উপযুক্ত শব্দ চয়নের মাধ্যমে প্রতিটি বিবরণ শেষ করা উচিৎ।
এক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। যেমন ‘রেস্পন্সিবল’, ‘লিডার’, ‘সাক্সেস’ প্রভৃতি শব্দগুলো খুব বেশি দেখা যায়। অন্যান্য সিভির মত একই শব্দ ব্যবহার করা মানে সিভির বিশেষত্ব নষ্ট করা। এগুলো অল্প কথায় সিভির জায়গা বাঁচায় ঠিক, কিন্তু প্রার্থী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারে না।
কিন্তু এর বদলে পরিমাপযোগ্য ফলাফল দেয়া হলে একসঙ্গে দুটো উদ্দেশ্য হাসিল হয়। এক. বহুল ব্যবহৃত শব্দ এড়ানো যায় এবং দুই. নিজের পারদর্শিতার ব্যাপারে সঠিক ধারণা দেওয়া যায়।
অত্যধিক ব্যক্তিগত তথ্য
চাকরির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হলে, পিতামাতার নাম, ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈবাহিক অবস্থা, এবং গ্রামের বাড়ির ঠিকানা না দেওয়াই ভালো। স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা একই হলে স্থানীয় চাকরির ক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া সরকারি চাকরির সময় ঠিকানার বিস্তারিত দেওয়াটা আবশ্যক।
এছাড়া ব্যক্তিগত শখ ও আগ্রহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক হয় না। এগুলো দেখা হয় মূলত প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব বোঝার জন্য। কিন্তু সিভির জায়গা ও নিয়োগকর্তার সময় সংকুলান বিচারে এগুলোর বদলে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বিভাগগুলোতেই জোর দেওয়া উচিৎ। তবে চাকরির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তখন এই শখ ও আগ্রহ দক্ষতার মূল্যায়নে সহায়ক হয়।
অনুপযুক্ত ইমেইল ঠিকানা
জীবনের প্রথম চাকরির আবেদনের সময় অনেকেই এই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে অপেশাদারিত্বের পরিচয় দেন। একটি উপযুক্ত ইমেইল ঠিকানায় সংখ্যা এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বা অপেশাদার অর্থবোধক শব্দ থাকা উচিৎ নয়। কারিগরি দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ হলেও ইমেইল ঠিকানাটি সিভিতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্যতা হারায়।
তাছাড়া এটি সেই বানান ও ব্যাকরণজনিত ভুলের মতো প্রার্থীর সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার উদ্রেক করে। ইমেইল ঠিকানার শব্দগুলো অবশ্যই ইমেইল ব্যবহারকারির নাম ও পেশা সম্বলিত হওয়া উচিৎ।
সর্বনাম পদের ব্যবহার
একটি সিভি এককভাবে শুধু একজনেরই পেশাগত কার্যকলাপকে প্রতিনিধিত্ব করে। এমনকি প্রার্থীর নামেই যেহেতু নথির শিরোনাম হয়, তাই ভেতরের তথ্যগুলোও সেই প্রার্থীর উপরই বর্তায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সিভিতে কোনো প্রকার সর্বনাম ব্যবহার পেশাদারিত্বের বহির্ভূত।
এক্ষেত্রে ব্যাকরণের রীতি মেনে পূর্ণ বাক্য গঠনে সাবজেক্ট উহ্য থাকে। অর্থাৎ ‘I generated’-এর বদলে ‘generated 30 percent sales in July’ বলতে বোঝায় যে সেই প্রার্থী নিজে ৩০ শতাংশ আয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বহুল ব্যবহৃত বা পুরনো ফর্মেট
নতুন চাকরি প্রার্থীদের অনেকেই বন্ধু বা বড় ভাইদের কাছ থেকে ফর্মেট নিয়ে সে অনুসারে সিভি তৈরি করেন। অনেকে দোকান থেকে কম্পিউটার অপারেটরদের কাছ থেকেও সিভি বানিয়ে থাকেন। এতে করে একই ফর্মেটের পুনরাবৃত্তি ঘটায় ইন্টারভিউ ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
একটি স্বতন্ত্র ফর্মেট বানানোর জন্য সিভি তৈরির জন্য গবেষণায় যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিৎ। অতিরিক্ত সম্পাদনার পরিবর্তে সহজ-সাবলীলতা বজায় রাখা উত্তম। অবশ্যই সাদা-কালোর বাইরে অন্য রঙ ব্যবহার না করাই ভালো। ফন্টের আকার ১১ থেকে ১২-তে রেখে প্যারাগ্রাফ ও ফাঁকা জায়গাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা আবশ্যক।
সিভি সম্পাদনার সময় ইন্ডাস্ট্রি এবং পদের বিষয়টিতে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। অভিনব নকশার সিভি একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের জন্য উপযুক্ত হওয়া মানে এই নয় যে তা একজন হিসাব রক্ষকের জন্যও আদর্শ হবে।
চাকরির সিভি তৈরির সময় এই বিষয়গুলো পরিহার করা তথ্য প্রদানে পরিমিতি বজায় রাখারই নামান্তর। বহুল ব্যবহৃত বা পুরনো ফর্মেটের বদলে যুগোপযোগী ফর্মেটগুলো নিয়োগকর্তাদের বেশি পছন্দের। এর সঙ্গে শুরুতেই দীর্ঘ পরিচিতি পর্ব এড়িয়ে একটি চিত্তাকর্ষক সূচনা যোগ হলে বেড়ে যায় পুরো সিভিটা পড়ে দেখার আসত্তি। অতঃপর পরিচ্ছন্ন ফর্মেটে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাগুলোর স্পষ্টতা প্রার্থীকে আকাঙ্ক্ষিত করে তোলে।
সর্বপরি, সিভির শেষব্দি ত্রুটিহীনতার সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতার মেলবন্ধনে নিয়োগকর্তা ধাবিত হন প্রার্থীর যোগাযোগ নম্বর খুঁজে বের করার দিকে।