স্মৃতির পাতায় ঈদ কার্ড, আর ফিরবে কি!

‘বন্ধু তুমি অনেক দূরে। তাইতো তোমায় মনে পড়ে। সুন্দর এই সময় কাটুক খুশিতে, সব কষ্ট ভুলে যেও, আপনজনের হাসিতে।’ ‘বাকা চাঁদের হাসিতে, দাওয়াত দিলাম আসিতে। আসতে যদি না পারো ঈদ মোবারক গ্রহণ করো।’
ঈদকে ঘিরে প্রায় এক যুগ আগেও এসব বাণী লেখা ঈদ কার্ডের জন্যে অধির আগ্রহে সময় গুণতেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও খোকসা উপজেলার প্রিয়জন, বন্ধু, বান্ধবসহ নানা শ্রেণির মানুষ। কে কাকে আগে ঈদের কার্ড দিবেন? এ নিয়েও চলতো প্রতিযোগিতা। প্রিয়জনের কার্ড ছাড়া যেন ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পেত না। তবে কালের বিবর্তনে আর মোবাইলের ফোনের কাছে হেরে গেছে বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রতি প্রাকৃতিক এই আবেগ অনুভূতির মাধ্যম। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে চলে কৃত্রিম অনুভূতির আদান প্রদান।
আট-দশ বছর আগেও ঈদ আসলে দোকানে সাজানো থাকত বাহারি রঙের ঈদ কার্ড। এই ঈদ কার্ড ৫ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো। নানা বয়সি মানুষের কাছে কার্ডের ব্যাপক চাহিদা ছিল। তবে এখন মানুষ আর ঈদ কার্ড কিনে না। মোবাইলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে শুভেচ্ছা ও ভাব বিনিময় করেন।
কথাগুলো বলছিলেন কুমারখালী শহরের গণমোড় এলাকার পদ্মা কসমেটিকসের প্রোফাইটর সুকুমার সাহা। তার ভাষ্যমতে, প্রায় ৩৫ বছর ধরে কসমেটিকসের ব্যবসা করছি। বর্তমানে আমার দোকানে স্নো, পাউডার, সাবান, কাঁচের চুড়িসহ অন্তত দুই হাজার ধরনের পণ্যের পসরা সাজানো রয়েছে। তবে সেখানে নেই শুধু এক সময়ের জনপ্রিয় ঈদ কার্ড।
কুমারখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. মামুনুর রশীদ সিদ্দিক বলেন, ছোট বেলায় ঈদ আসার আগেই কার্ড কেনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। খুব কাছের বন্ধু-বান্ধবীদের কার্ড গিফট দিতাম। কার্ড না দিলে বন্ধুরা অভিমান করে থাকত। কার্ড ছাড়া ঈদ পূর্ণতা পেত না।
কুমারখালী প্রধান শহরের সোনাবন্ধু সড়কের হলবাজার, গণমোড়, থানামোড়, পাবলিক লাইব্রেরি এলাকার ধ্রুবতারা, পদ্মা, কৃষ্ণ গোপাল, অনন্যা ও মীমসহ অন্তত ২০টি কসমেটিকস দোকান ঘুরে দেখা গেছে, দোকানে সাজানো হাজারো পণ্যের পসরা। তবে সেখানে নেই শুধু ঈদ কার্ড।
এ বিষয়ে ধ্রুবতারা কসমেটিকসের প্রোফাইটর স্বপন হোসেন বলেন, অনেক বছর হলো ক্রেতারা ঈদ কার্ড খুঁজে না। তাই বিক্রিও হয়না। সেজন্য এগুলো আর দোকানে তোলা হয়না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ বছর আগেও ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল। ছোট বেলায় অনেক ঈদ কার্ড পেয়েছি।’
ঈদ কার্ড কি? কখনও দেখিনি; চিঠিও লেখা হয়নি কোনোদিন বলে জানালেন কুমারখালী আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী।
৯০ দশকে ঈদ কার্ডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কার্ড কেনার জন্য সারা বছর ধরে এক-দুই টাকা করে জমানো হতো বলে জানান স্থানীয় কবি ও নাট্যকার লিটন আব্বাস। তিনি বলেন, ঈদ কার্ড সংগ্রহ করে তাতে নিজস্ব অথবা কোনো বিখ্যাত কবির কয়েকটি লাইন লিখে প্রিয়জনকে দাওয়াত দেওয়া হতো। তবে মোবাইলের কারণে ঈদ কার্ড আর ব্যবহার করা হয়না। বাঙালির সাংস্কৃতিক হিসেবে পুনরায় ঈদ কার্ড চালু হওয়া দরকার।
জানা গেছে, অনলাইনে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এবার বেশকিছু ঈদ কার্ড কিনে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নূর ই সিয়াম উচ্চারণ। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের দিকে চাচাতো বোন প্রথম ঈদ কার্ড দিয়েছিল। আর দেওয়া নেওয়া হয়নি। তবে এবার বেশকিছু কিনেছি প্রিয়জনদের দিব। তার ভাষ্যমতে, প্রাচীণ এই সাংস্কৃতি আবার ফিরিয়ে আনতে সকলকেই সচেতন হতে হবে।
কাগজে কলমে লিখে মনের যে ভাব প্রকাশিত হয়। তা যান্ত্রিকরণের মাধ্যমে হয়না বলে মন্তব্য করেছেন কুমারখালী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জিল্লুর রহমান মধু। তিনি বলেন, একটা সময় হালখাতা কার্ডের প্রচলন ছিল। তেমনি ভাবে ঈদে ঈদও কার্ড ছিল। এখন কালের বিবর্তনে সবই হারিয়ে গেছে। তবে নতুন প্রজন্মের মাঝে প্রাচীণ এসব সাংস্কৃতি আবার জাগ্রত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।