রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে বরণ করেছেন, আমি মেলাকে : মাকসুদ
‘জেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে, এ কি মাতন দোলা, বছর ঘুরে এলো আরেক প্রভাত নিয়ে, ফিরে এলো সুরের মঞ্জুরি, পলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন, এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি, মেলায় যাইরে মেলায় যাইরে...’ ।
বৈশাখের তিন প্রজন্মের জনপ্রিয় গান এটি। গানে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী মাকসুদুল হক। ১৯৯০ সালে গানটি অ্যালবামের শিরোনাম সংগীত হিসেবে প্রকাশ করে জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাক। তখন মাকসুদ ছিলেন ফিডব্যাকের অন্যতম সদস্য। গানটি প্রকাশের পরপরই সারা দেশে ঝড় তোলে। তখন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলছিল। বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশন করে ফিডব্যাক। গানটি প্রচারের পরদিনই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। এই জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। ২৫ বছর পরও তরুণ-তরুণীরা বৈশাখের প্রথম দিনে গানটি পরিবেশন করেন বিভিন্ন আয়োজনে।
‘মেলায় যাই রে’ গানটির ২৫ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে এ বছর। এ বিষয়ে কিছু বলতে বললে মাকসুদ বলেন, ‘আমি খুব অবাক হচ্ছি একটি গান এখনো সবাই শুনছে। তিনটি প্রজন্ম এটা শুনেছে। এই প্রজন্মের আগ্রহের শীর্ষে গানটি। বাংলা সংস্কৃতিতে গানটি একটি স্থান করে নিতে পেরেছে এটা আমার গর্ব। আর অহংকার পুরো বাঙালি জাতির।’
গানটি কবে লিখেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৯৮৮ সালে গানটি লিখি। স্টেজে আমরা গানটা পারফর্ম করা শুরু করি। অ্যালবামে গানটি আমরা বের করি দুই বছর পর। সেই হিসেবে গানটির বয়স ২৭ বছর। গানটি আমি একবারে লিখতে পারিনি। আমার দুই মাস সময় লেগেছিল। লেখার পর আমি সাত-আটবার সংশোধন করেছি। তারপর সুর করেছি।’
গানে মেলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, কেন? এমন প্রশ্ন শুনে মাকসুদ বলেন, “আমার জন্ম নারায়ণগঞ্জে। আমার বাবা ছিলেন রঙের ব্যবসায়ী। সেই সুবাদে পয়লা বৈশাখ এলে অনেক দোকানের হালখাতা অনুষ্ঠানে খেতে যেতাম। মাছ, মিষ্টি এসব খেতাম। গ্রামের মেলাতেও আমি গিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন ‘এসো হে বৈশাখ’ আর আমি কিন্তু গেয়েছি ‘মেলায় যাই রে’। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে বরণ করেছেন আর আমি করেছি মেলাকে।”
গানের ভেতর মেলাকে নিয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে মাকসুদ বলেন, “এর পেছনে একটি কারণ আছে। আমাদের বৈশাখের আয়োজন কিন্তু মেলাকেন্দ্রিক। গ্রামবাংলার বৈশাখের রূপ ও চরিত্র সেটা কিন্তু এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি গীতিকবিতায় প্রথম অন্তরায় যাই লিখি না কেন, শেষ করেছি ‘মেলায় যাই রে’ কথাটি দিয়ে। শহরের উপকরণ বাদ দিয়ে গ্রামের পোশাক, যন্ত্র, শব্দ আমার গীতিকবিতায় চলে এসেছে। কোনো জাতির বেঁচে থাকার জন্য সংস্কৃতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আবহমান বাংলার ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে গানটি আমি লিখেছি। গ্রামের আবহাওয়ার সঙ্গে শহরের একটি মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি মাত্র।”
কনসার্ট করার সময় ‘মেলায় যাই রে’ গানটি করার অনুরোধ কেমন পান জানতে চাইলে মাকসুদ বলেন, ‘সবার আগে এই গানটি করার অনুরোধ আসে। একবার গাওয়ার পরও বারবার সবাই গাইতে বলে। আর গানটি শুনে দর্শক শ্রোতারা যখন নাচে, নাচের তালে যে ধুলো আকাশে ওড়ে, সেইটাই আমার দরকার। আমি সেই ধুলা খুব উপভোগ করি। একজন মানুষ যে দানব হতে পারে শুধু এই গানটি করে আমি বুঝেছি। বিটিভিতে গানটি প্রথম প্রচারের পরদিন আমি নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে দেখেই লোকজন ভিড় করেছিল। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।”
গানটির স্মৃতিচারণা করে মাকসুদ আরো বলেন, ‘১৯৯২ সালে চট্টগ্রামে আমরা একটি শো করি। তখন ৪০ হাজার লোক হয়েছিল। শীতকাল ছিল। তারা এত নাচানাচি করেছিল যে ধুলাগুলো আমার হাতের ওপর এসে পড়ছিল। এই গানটি যদি আরো ২৫ বছর বেঁচে থাকে আমি ধন্য। কেউ যদি আমাকে নাও চেনে এই গানটির কথা বললেই সবাই চিনে যায়। আমি আরো ভালো গান করেছি কিন্তু এগুলো শোনার কারো সময়ও নেই। এই গানটি শুনেই সবাই অস্থির। কনসার্টেও এই গানটি গাওয়ার পর মানুষজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাদের আর কোনো গান দিয়ে শান্ত করা যায় না।’
গানটির দুটো লাইন, ‘বাসন্তী রং শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়, ঐ বখাটে ছেলেদের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই’।
‘বখাটে ছেলে’ প্রসঙ্গটি গানে কেন এনেছেন জিজ্ঞাসা করতেই মাকসুদ উত্তর দিলেন, ‘এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। আমি স্বেচ্ছায় এটা করেছি। তখন ইভটিজিং বিষয়টি সেভাবে আসেনি। রমনায় আমি মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই যাই। আগে হাজার মানুষ আসত। এখন লক্ষ মানুষ আসে। আমি আগেই ভেবেছিলাম মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হতে পারে। তাই আগে থেকে সতর্কবার্তা হিসেবে এটা লিখেছি। তারপর ১৯৯৩ সালে মেলায় একটি মেয়েকে আমি লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। তারপর খুব ব্যথিত হই। যা ধারণা করেছিলাম তাই হলো। আমরা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে নাচতেই পারি। কিন্তু নাচের অজুহাতে কোনো মেয়েকে যদি অসম্মান করা হয় এটা খারাপ।’
মাকসুদ স্মৃতি হাতড়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘আমি বয়সে তখন ছোট ছিলাম তাই রেহাই শব্দ ছাড়া মাথায় শক্তিশালী কোনো শব্দ ছিল না। তবে এটা লেখার অন্যতম কারণ ছিল ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সব থেকে পুরানো যদি কেউ মেসেজ দিয়ে থাকে, সেটা আমি।’
মাকসুদের গাওয়া ‘মৌসুমি’ গানটিও অনেক জনপ্রিয়। আলাপ ‘মেলায় যাইরে’ গানটি নিয়ে হলেও প্রিয় শিল্পীর প্রিয় এই গানটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে গায়ক হাসলেন। ‘মৌসুমি’ কে? এমন প্রশ্ন শুনে মাকসুদ হেসে বললেন, “কেউ তো একজন আছে। কখনো এটা নিয়ে আমি সত্য কথা বলি না। গানটির প্রথম খণ্ড লিখেছেন নজরুল ইসলাম বাবু। গানের দ্বিতীয় খণ্ড ‘কার বুকের আলিঙ্গনে লুকিয়ে ভাবছো কি আমার কথা’ এটুকু আমার লেখা। এই অংশটুকু আমার জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে। আবার এটাও বলতে পারেন মৌসুমী হচ্ছে মৌসুম। বিভিন্ন সময়ের প্রেম আমি তুলে ধরেছি।”
১৯৯৬ সালে ফিডব্যাক ছেড়ে ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ড গড়ে তোলেন মাকসুদুল হক।
ব্যান্ডে ‘ঢাকা’ নামটি রাখা কেন? জানতে চাইলে মাকসুদ বলেন, ‘এই ঢাকা রাজধানী ঢাকা নয়। আমরা আমাদের সব সময় লুকিয়ে রাখতে চাই। মানে ঢেকে রাখতে চাই। এ জন্য এই নামটি রেখেছি। ক্যারিয়ারের ৪০ বছরে আমি খুব কম কাজ করেছি। আমার কাছে মনে হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যেমন জরুরি, তেমনি সৃষ্টিশীল কাজও সীমিত হওয়া প্রয়োজন, যাতে কাজের মান ঝুলে যায় না।’
সংগীতের পাশাপাশি বাংলা-ইংরেজি কবিতা ও নিয়মিত কলাম লেখেন মাকসুদ। কবিতার বইও বেরিয়েছে তাঁর। এ প্রসঙ্গে মাকসুদ বলেন, ‘আমার মূল পরিচয় আমি কবি। এই পরিচয় দিতেই আমার সব সময় ভালো লাগে।’
‘মেলায় যাই রে’ গানটির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে মাকসুদ বলেন, ‘এখনই কিছু বলতে চাই না। তবে সবার জন্য একটা চমক তো অবশ্যই আছে।’