শর্ত পূরণ করে ক্রিকেটের সবুজ গালিচায় নাহিদ
সময়টা ২০১৯ সাল। পড়াশোনায় মন নেই। ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তির জন্য পরিবারের কাছে বায়না করে বসেন নাহিদ রানা। সেই বায়না নাকচ করে পরিবার জুড়ে দেয় শর্ত। সেটাও অবশ্য পড়াশোনা নিয়েই। নাহিদের বড় ভাই শর্ত দেন—আগে এসএসসি পাস করো, পরে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি!
পড়ায় মন না বসা নাহিদের সামনে পথ নেই। নিজের ক্রিকেট স্বপ্ন পূরণের জন্য আগে পরিবারের শর্ত পূরণ করলেন। এরপর পা রাখলেন বাইশ গজের সবুজ গালিচায়।
চলতি বছর মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে জাতীয় দলের অধ্যায় শুরু করেন নাহিদ। অভিষেক ম্যাচের দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়া নাহিদ পাকিস্তান সিরিজে দুই ম্যাচে নেন ছয় উইকেট। তবে, উইকেট ছাপিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন গতি দিয়ে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১৫২ কিলোমিটার গতিতে বল করে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছেন ২১ বছর বয়সী এই তরুণ। দেশে ফিরে পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন নাহিদ। একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের রঙিন অধ্যায় ও শুরুর যাত্রার স্মৃতি শেয়ার করেছেন বাংলাদেশের পেস বিভাগের নতুন এ সেনসেশন।
পাকিস্তানে দেশের হয়ে একটি স্মরণীয় সফর করে এলেন? তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
নাহিদ রানা : সবমিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো কেটেছে। অনেক উপভোগ করেছি। যাদের খেলা টিভিতে দেখতাম, যাদেরকে সবসময় তারকা ভেবে এসেছি তাদের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে পারা আমার কাছে অবশ্যই স্মরণীয়। সিনিয়রদের সাথে এভাবে মিশতে পারা, একসঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করতে পারা, সবমিলিয়ে ট্যুরটা ছিল দারুণ উপভোগ্য।
টিভিতে দেখা নায়কদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ারের গল্প বলেছেন। তাদের সঙ্গে কোন বিশেষ মুহূর্তগুলো বেশি ভালো লেগেছে?
নাহিদ রানা : আসলে এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। শুধু এইটুকু বলব, এটা অনেক উপভোগ্য। আমি নিজেও কখনও ভাবতে পারেনি। এই অনুভূতি অন্যরকম।
সিনিয়ররাও আপনার অনেক সুনাম করেছেন, এটা কেমন লাগছে?
নাহিদ রানা : এটা তো অনেক বড় পাওয়া। সকল ক্রিকেটার মাঠ ও মাঠের বাইরে আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। আমি যে জুনিয়র সেটা আমাকে ড্রেসিংরুমে বুঝতেই দেওয়া হয়নি। সবাই আমাকে বন্ধুর মতো মেনে নিয়েছেন। কেউ ছোট হিসেবে ট্রিট করেননি। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমের সবাই বন্ধুর মতো। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক ভাই, উনারা এত সিনিয়র হয়েও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছেন। আমি যে ছোট সেটা বুঝতেই দেননি। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
আপনি গতি নিয়ে আগেও স্বস্তির কথা শুনিয়েছেন, পাকিস্তানে সেই কথা রাখতে পেরেছেন। এটা নিজেকে কতটা স্বস্তি দিচ্ছে?
নাহিদ রানা : অবশ্যই স্বস্তি কাজ করছে। দেশের জন্য কিছু করতে পারা যে কোনো ক্রিকেটারের জন্যই স্বস্তির। এখানে দেশে ও নিজের জন্য করতে পেরেছি এটা নিজের কাছেও ভালো লেগেছে। সামনের দিকে চেষ্টা করব আরও ভালো করার। সুযোগ পেলেই চেষ্টা করব নিজের সেরাটা দেওয়ার।
পাকিস্তানে ১৫২ কিলোমিটার গতি তুলেছিলেন, ভারতে কত তুলতে চান? কোনো নিজেকে ছাপিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ার টার্গেট আছে কি না?
উত্তর : আমার এটা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো টার্গেট নেই। ইচ্ছা আছে যে, যদি সেরা একাদশে সুযোগ পাই তখন নিজের সেরা গতিটা উপহার দেওয়া ও দলের যে পরিকল্পনা থাকবে সেটা এক্সিকিউট করা। দলের জন্য যেটা ভালো হবে দিন শেষে সেটাতেই ফোকাস রাখতে চাই।
ভারতের মাটিতে সুযোগ পেলে কার উইকেট নিতে চান?
নাহিদ রানা : নাহ, এ রকম কোনো স্বপ্ন নেই যে কারও উইকেট নিতেই হবে। এটা উল্টো মানসিক চাপ দেবে। আমি আমার সেরাটা দিয়ে বোলিং করব। এরপর যে উইকেটটা পাব সেটাই আমার কাছে স্পেশাল। আমার কাছে স্পেশাল ব্যক্তি নন, স্পেশাল হলো উইকেট সেটা যারই হোক।
দেশের হয়ে রেকর্ড গতিতে বোলিংয়ের মালিক আপনি। নিজেকে কিছুটা বিশেষ মনে হয় কি না?
নাহিদ রানা : নাহ আলাদাভাবে নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হয় না। আমি নিজের চেষ্টাটা করছি। সবসময় নিজের ফিটনেসটা ধরে রাখতে চেষ্টা করতেছি। এর জন্য পরিশ্রম করছি। একটা ডিসিপ্লিন লাইফে চলার চেষ্টা করি। যথা সময়ে ঘুমানো, সময়মতো খাওয়া—এমন সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি।
জাতীয় দলে খেলছেন এখন। বন্ধুদের কাছেও কি তারকা হয়ে উঠেছে নাহিদ রানা? তার জীবন কতটা বদলেছে?
নাহিদ রানা : আসলে যারা বন্ধু তাদের সাথে সবসময় এক রকম। তাদের কাছে গেলে তারকা ব্যাপারটা আসে না। তাদের সাথে আমার ওমন সম্পর্ক না। বন্ধুত্ব আমাদের আগের মতোই আছে। বন্ধুদের সাথে আমি আগে যেমন ছিলাম এখনও তেমনই আছি। পরিবারেও সেম। আমি মাঠে ভালো করেছি পরিবার সবাই খুশি। তাদের ভালো লাগছে। সবাই আমার এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করে। পরিবার থেকে সবসময় একটা কথাই বলে—সুস্থ থেকো আর মানুষের কাছে দোয়া চাইবা।
বাড়িতে বাবা-মা খেলা দেখেন? পাকিস্তানে যখন খেলতেন তাদের সাথে কি কথা হতো প্রতিদিন?
নাহিদ রানা : আগে তেমন খেলা দেখতেন না। বুঝতেন না। এখন একটু একটু খেলা দেখেন। হয়তো খেলা পুরোপুরি বুঝে না। তবে দেখেন এখন। পাকিস্তানে ম্যাচ খেলার দিন প্রতিদিনই মাকে কল দিতাম। মা ভালো খেলার জন্য বলতেন।
ক্রিকেটে আপনার শুরুর গল্পটা জানতে চাই?
নাহিদ রানা : আসলে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এমনেই এলাকায় খেলাধুলা করতাম। পড়াশুনা খুব একটা করতাম না। একদিন বাসায় জানালাম, পড়াশুনা ভালো লাগে না আমার আমি ক্রিকেট অনুশীলন শুরু করতে চাই। এটা শুনার পর প্রথমে বাসা থেকে মানা করে দেওয়া হয়। বাসা থেকে বলে দেয়, এখন এসব না আগে পড়াশুনা করো। তবুও আমি এলাকার খেলাধুলা চালিয়ে যাই। আবার আরেকদিন ভাইয়া বলেছেন, তুমি যদি এসএসসি পাশ করতে পারো তাহলে তোমাকে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য একাডেমিতে ভর্তি করব। ২০১৯ সালের ঘটনা এটা। এরপর এসএসসি পাশ করি। পাশ করাতে ভাইয়া একাডেমিতে ভর্তি করান।
স্বপ্নযাত্রা শুরুর চার বছরের মাঝে জাতীয় দলে সুযোগ। নিজের কাছে সারপ্রাইজিং লাগছে কিনা?
নাহিদ রানা : নাহ আমার কাছে খুব একটা সারপ্রাইজিং মনে হয় না। কারণ, এতটুকু তো খেলেই এসেছি। এখনও চেষ্টা করছি। তাই খুব একটা অবাক না। এখন নিজেকে কতটা ধরে রাখতে পারি সেটাই দেখার।
ক্রিকেট খেলা নিয়ে ছোট বেলায় কোনো বিশেষ স্মৃতি আছে কী?
নাহিদ রানা : ক্রিকেট নিযে স্মৃতি তো বহু আছে। একবার বাসায় আম্মু আমাকে বকা দিছিলো তখন স্কুলে গেছি সেখান থেকে পালিয়ে খেলতে চলে গেছি। তো ক্রিকেট খেলে সেদিন বাসায় ফিরতে আমার অনেক লেট হয়ে যায়। আম্মা সেদিন অনেক টেনশন করছিল। আমি বুঝতে পারিনি আম্মু এত চিন্তায় পড়ে যাবেন। সেদিন আম্মু অনেক বকা দিছেন। আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এটা আমার মনে এখনও গেঁথে আছে।
ক্যারিয়ারে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
উত্তর : ব্যক্তিগত লক্ষ্য একটা আছে। সেটা হলো—যখন আমি ক্রিকেট ছাড়বো তখন সবাই যাতে বলেন যে বাংলাদেশের একটা পেস বোলার ছিল।
পেস বোলিংয়ে কাউকে আইকন মানেন কী?
নাহিদ রানা : আসলে সেভাবে কাউকে অনুসরণ করা হয় না। ছোট থেকে খেলা দেখছি তো সবাইকেই ভালো লাগে। বিশেষভাবে কাউকে ফলো করা হয় না। বা বিশেষ ভাবে কাউকে আইকন মানা হয় না। সবার খেলাই ভালো লাগে।