ভিনির নামে বর্ণমালারা গেয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের গান
‘জীবনে কী ঘটেছে, তা গুরুত্ব রাখে না। গুরুত্ব রাখে তুমি কী মনে রেখেছো, কীভাবে মনে রেখেছো’— গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বলা বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করার কারণটা বলা যাক। মার্কেজ অমর হয়ে আছেন তার কালজয়ী উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ এর জন্য। ঠিক ৪৯ দিন আগে (২৯ অক্টোবর) ভিনিসিয়াস জুনিয়র নিজেকে কিছু সময়ের জন্য নিঃসঙ্গই ভেবেছিলেন। কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিল তার পৃথিবী। ব্যালন ডি’অরের সাজানো বাগানে যখন বিজয়মাল্য পরার অপেক্ষায় তিনি, ঠিক তখন জানলেন হাতছাড়া হয়ে গেছে তার শ্রেষ্ঠত্ব।
ওই কিছু সময়ের জন্যই। এরপর ভিনি যা পেয়েছেন, তা একজন অ্যাথলেটের কাছে অ্যাওয়ার্ডের চেয়ে বেশি। উয়েফার রায়ে ইউরোপের বর্ষসেরা হন রদ্রি, জনতার রায় শতভাগ ভিনির ব্যালটে। তার জন্য গোটা রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব বর্জন করে ব্যালনের আসর। প্যারিসের থিয়েটার দ্যু শাটলেটের আক্ষেপ দেড় মাস পর হাওয়ায় মিলিয়েছে। কাতারের দোহায় বিখ্যাত এস্পায়ার অ্যাকাডেমিতে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) রাতটা ছিল ভিনিময়।
‘যদি নিশ্চয়তা দাও, আমি থাকব না অপেক্ষায়। শুধু জানব, তুমি আমারই হবে একদিন’—ব্যালন ডি’অরের গালা নাইটে ভিনিসিয়াস জুনিয়র আনমনে এভাবে ভেবেছিলেন কি না কে জানে! তিনি ঠিকই জানতেন, প্রতিভা চাইলেই দমিয়ে রাখা যায় না। বিতর্কিত ব্যালন ডি’অরে এত কাছে তবু কত দূরের দুঃখ ভুলেছেন ভিনি। রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান এই সুপারস্টার এখন বছরের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়। ফিফা দ্য বেস্টের পুরস্কার হাতে পেয়ে তিনি বলে উঠতেই পারেন, আর কতবার আমাকে তোমরা এড়িয়ে যাবে?
সেই রাতেই ভিনিসিয়াস নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন, তিনিই সেরা। বলেছিলেন, ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী হয়ে ফিরবেন। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাত নম্বর জার্সি গায়ে চাপান, খেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। ‘তোমাদের ভালোবাসা আমাকে শক্তি জোগায়, ঘৃণা করে অপ্রতিরোধ্য’— রোনালদোর এই বেদবাক্য না মানলে চলে? ভিনি মেনেছেন। ঘৃণার জমিতে চাষ করেছেন সমীহ। ফিফা তাই তাকে ফেরাতে পারেনি।
প্রথমবারের মতো ফিফার বর্ষসেরা পুরুষ ফুটবলারের তকমা এখন ভিনির গায়ে। ব্রাজিলিয়ান এই তারকা ফরোয়ার্ড যদি একটু হিসেব কষেন, তাহলে রদ্রির চেয়ে এগিয়ে থাকবেন খানিকটা। কারণটা সহজ। ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক ফিফা। তাই, ফিফার বর্ষসেরা হওয়া মানে তো সেরাদের সেরা হওয়া।
শুরুতে বলা মার্কেজের কথায় ফিরে আসা যাক। সেদিন কী ঘটেছিল ভিনির সঙ্গে তা নিয়ে পড়ে থাকেননি তিনি। তবে, মনে রেখেছেন। ভালোভাবে মনে রেখেছেন। কাতারে ফিফার বর্ষসেরার পুরস্কার বাগিয়ে কেবল হেসেছেন ভিনি। প্রবল প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলার তৃপ্তির হাসি কতটা উজ্জ্বল, তা দেখেছে দুনিয়া।
‘আর সেই ঘরের মধ্যে হাসির উল্লাস
ঝনঝন শব্দ করছে স্বর্গীয় ঘণ্টার মতো
ঝলসে উঠছে কয়েকটি সূক্ষ্ম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ!’
যে ফ্রান্সে ব্রাত্য হন ভিনি, সেই ফরাসি কবি পল ভ্যার্লেনের কবিতার গুচ্ছ পঙক্তিমালা বোধহয় কাল রাতের জন্যই লেখা হয়েছিল! তিনি কি জানতেন, কবিতা ফিরে আসবে তার মাতৃভূমির বিরুদ্ধে? জানলেও বোধহয় রাগ করতেন না। কবিতার মতোই রোমাঞ্চকর আখ্যান উপহার দিয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটালেন ভিনি।
শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হাতে ভিনি যে কথাগুলো বলে গেছেন, তা আগামীর প্রেরণা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। ‘তারা বারবার চেষ্টা করেছিল আমাকে ব্যর্থ করতে, ছোট করতে। কিন্তু, তারা এখনও তৈরি নয়। কেউ আমাকে বলেনি আমি কাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, কীভাবে আমার আচরণ করা উচিত। সিস্টেম আমার পরোয়া করেনি, চেয়েছে বিষাদগ্রস্ত করে ফেলতে।’— ভিনির একেকটি শব্দে উঠে এসেছে হার না মানা মানসিকতা।
বিষাদকে পাখি বানিয়েছেন। নগরীর শ্যাওলা ধরা দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছেন। পাখির ডানায় চড়ে প্যারিস থেকে কাতারে গিয়ে রেখে এলেন আলপনার ছাপ। দেয়ালজুড়ে বর্ণমালারা গেয়ে উঠেছে পাখির সুরে, ভিনির নামে।