ভিয়েতনাম
কনফুসিয়াসের স্মৃতি নিয়ে টেম্পল অব লিটেরেচার

টেম্পল অব লিটারেচার দেখবার মূল কারণ ছিল স্থানটির সাথে কনফুসিয়াসের স্মৃতি বিজড়িত। ভিতেয়নামের হান্যয় শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত টেম্পল অব লিটারেচার সম্পর্কে এইটুকু ধারণা নিয়েই দেখতে যাওয়া।
টেম্পল অব লিটেরেচারের প্রবেশ দ্বার। ছবি : লেখক
একা ছিলাম, তাই হোটেলে জিজ্ঞাসা করলাম অল্প পয়সায় কোন গাইড পাওয়া যাবে কি না। অভ্যর্থনায় বসে থাকা মেয়েটি হেসে জবাব দিল, ‘আমি দেখছি’। আমি অপেক্ষা করছিলাম করিডোরের সোফায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সে জানালো, একটি মেয়ে আসছে সে আমাকে সাহায্য করবে ঘুরে দেখতে। কোন টাকা দিতে হবে না। আমি ভালোই অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলাম। সে বলল, ‘আমাদের হোটেলের সাথে কিছু তরুণতরুণী যুক্ত আছে যারা ইংরেজিতে কথা বলায় পারদর্শী হতে চায় টুরিস্টদের শহর ঘোরানোর মাধ্যমে এবং তারা কোনো পারিশ্রমিক চায় না।’ আমি কতটা আনন্দিত ও পুলকিত হবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল একটি জাতি এভাবেই মনে হয় নিজেদের ইচ্ছেয় এগিয়ে যায়।
তাই তো বলি, ১০ বছর যুদ্ধ করা একটি জাতি ভস্ম থেকে উঠে এসে কী করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে? সেটা হোক কৃষি ক্ষেত্রে বা পর্যটন শিল্পে।
দুই মিনিটের মধ্যে আমার গাইড এসে হাজির। ফুটফুটে একটি মেয়ে। অ্যাকাউন্টিইং নিয়ে স্নাতক পড়ছে। নাম থয়াই। আমার হোটেল থেকে খুব কম সময়ে টেম্পল অব লিটেরেচারে যাওয়া যায়। তাই আমরা হেঁটে গল্প করতে করতে মিনিট দশেকের মধ্যে টেম্পল অব লিটেরেচারের টিকেট ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
হান্যয় শহর সফরে আমার খুদে গাইড থয়াইর সঙ্গে। ছবি : লেখক
টিকেট সংগ্রহ করে ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। তবে বাইরের গেটটা দেখে বোঝার উপায় নেই কতখানি জায়গা জুড়ে টেম্পল অব লিটেরেচার। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে দেখা মিলবে তিন দিকে তিনটি পথ চলে গেছে। প্রাচীনকালে মাঝের পথটি ব্যবহার করতেন শুধু রাজ পরিবারের সদস্যরা। বামদিকের পথ ব্যবহৃত হত প্রসাশনিক কর্মকর্তারা, আর ডান দিকের পথ ছিল সৈনিকদের জন্য। তবে বর্তমানে পর্যটক হিসেবে আপনি যে কোন পথই ব্যবহার করতে পারবেন।
টেম্পল অব লিটেরেচারের ভিতরে
টেম্পল অব লিটেরেচার আসলে কী? নামের আগে টেম্পল থাকার কারণে মনে হতে পারে এটি একটি মন্দির। আসলে টেম্পল অব লিটেরেচার ভিয়েতনামের প্রথম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে ভিয়েতনাম শাসন করতো ল্যাই (Ly) রাজ বংশ। ল্যাই রাজবংশের রাজা প্রভাবিত ছিলেন চায়নার সুং রাজবংশের কাজকর্মের প্রতি এবং কনফুসিয়াসের প্রতি। ল্যাই রাজা কনফুসিয়াসের জন্মস্থান অবস্থিত টেম্পল অব কুফুর আদলে তৈরি করেন এই ‘টেম্পল অব লিটেরেচার’। ১০৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীন ভিয়েতনামের প্রথম ইম্পেরিয়েল একাডেমি যার নাম ছিল “Quốc Tử Giám”। এই একাডেমি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন ভিয়েতনামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, উচ্চপদস্ত ব্যক্তিবর্গ, রাজবংশীয়দের শিক্ষা দান। এমনকি তৎকালীন রাজাও সেই একাডেমির ছাত্র ছিলেন।
বনসাই চত্বরে। ছবি: লেখক
প্রবেশদ্বার দিয়ে কয়েক কদম গেলেই চোখে পড়বে টেম্পল ঘুরে দেখবার নিয়ম। যদিও এই প্রাচীন স্থানটি একটি শিক্ষাকেন্দ্র , তথাপি এই চত্বরটি প্রতিটি ভিয়েতনাম নাগরিকের জন্য একটি পবিত্র স্থান। সেই আঙ্গিকেই নিয়ম কানন লেখা আছে। সাধারণ পর্যটকদেরও হিসেবে নিয়ম কানুন মানার কথা বলা হয়েছে যেমন- ময়লা অবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার অনুরোধ করা হয়েছে, কোনো কিছু বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকা আর এটি যেহেতু একটি পবিত্র স্থান তাই হাঁটুর উপরে কাপড় পরে এখানে প্রবেশ নিষেধ।
তৃতীয় আঙ্গিনায় যেখানে পাথরের তৈরি কচ্ছপের উপরে রাখা পাথরে স্কলারদের নাম খোদাই করা। ছবি : লেখক
পুরো চত্বরে পাঁচটি আঙিনা বা courtyards আছে। প্রবেশ গেট দিয়ে ঢোকার কিছুদুর পরই প্রথম ও দ্বিতীয় আঙিনা। সেখানে আছে বাগান , প্রাচীন গাছপালা , গুল্মলতা ছাঁটাই করে বিভিন্ন আকৃতির পশু পাখির রূপ দেয়া আছে বাগানে চাইনিজ প্রথা। যেহেতু টেম্পল অব লিটেরেচার কনফুসিয়াসের মতাদর্শে বানানো। এ ছাড়া আছে ছোট ছোট দীঘি।
তৃতীয় আঙিনায় প্রবেশ করলে দেখা মিলবে বেশ বড় একটা দীঘি, আয়তনটা আমার জানা নেই। যার নাম বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘স্বর্গীয় স্বচ্ছতার কূপ’। কূপের পানির ভিতরে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের মাঝে একটি কচ্ছপের পরিবার। কচ্ছপকে ভিয়েতনামে পবিত্র প্রাণী হিসেবে ধরা হয়। কচ্ছপ শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতীক।
বড় কূপ দেখার পাশাপাশি তৃতীয় আঙিনাতে আরও একটি চমকপ্রদ জিনিস হল, পাথরের কচ্ছপের পিঠের উপর অন্য একটি পাথরে এখানকার সব প্রাচীন স্কলার, দার্শনিকের লিস্ট লেখা আছে যারা এই একাডেমির ছাত্র ছিলেন।
ধর্মীয় উৎসব ও আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য রয়েছে চতুর্থ আঙিনা। সেখানে প্রবেশের দরজাগুলো দৃষ্টি কাড়লো। লাল রঙের দরজার উপরে ড্রাগনের ছবি আঁকা। দরজাগুলো দেখার সাথে সাথে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার গাইড মনের খুশিতে সেই ছবি তুলে দিল। দরজার উপরে ভিনদেশী ভাষায় কিছু লেখা আছে, আমার গাইডকে বললাম অনুবাদ করার জন্য। সে অন্য আরেকজনের সহায়তায় আমার জন্য অনুবাদ করে ইংরেজিতে বলল ‘The Gate of Great Success।’ কনফুসিয়াসকে উৎসর্গ করে কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে চতুর্থ আঙিনায়। টেম্পলের সব থেকে বড় স্থাপনা এই আঙিনায় চোখে পড়বে। ঘরের ভিতরে ছাদ কাঠের তৈরি।
পঞ্চম আঙিনায়। ছবি : লেখক
পঞ্চম আঙিনায় দেখা যাবে বনসাই ও সুভেনির শপ। এই আঙ্গিনায় বড় বড় পাথরের টবে দেখতে পাবেন বনসাই। বনসাইগুলোর চেহারাই বলে দিচ্ছিল সেগুলো বেশ পুরোনো। যদিও তা আমার ধারণা। কত পুরোনো তা জানতে পারিনি। কেউ সে তথ্য দিতেও পারেনি।
কয়েকটি সুভ্যেনির শপ দেখতে পেলাম। দারুণ করে সাজানো। মজার মজার উপকরণের মাধ্যমে নিজের দেশকে তুলে ধরার ধরনটা খুব কাজের। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই তাই করছে।
সুভ্যেনির শপের সামনে। ছবি : লেখক
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে উপভোগ করলাম প্রাচীন ভিয়েতনামের ‘টেম্পল অব লিটেরেচার’। অনেক ক্ষণ হাঁটার কারণে কিছুটা তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলাম। সুভেনির শপের পাশেই দেখতে পেলাম খাবারের দোকানও আছে। হালকা খাবার খেয়ে আমি ও আমার গাইড পেট ঠাণ্ডা করলাম। এরপর হাঁটতে থাকলাম বেরিয়ে যাওয়ার পথটি ধরে।
বেরুতে বেরুতে ভাবছিলাম প্রাচীন বঙ্গেও তো এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এবং কিছু কিছু এখনো বিদ্যমান। সোমপুর মহাবিহার ছাড়া আর কোনটিকেই আমরা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারিনি। কবে পারব সেটি নিয়েও কি আমরা কিছু ভাবছি?
নিকট ভবিষ্যতে না হোক অদূর ভবিষ্যতে হবে হয় তো!
টেম্পল অব লিটেরেচারের সব তথ্য পাওয়া সেখানকার তথ্যকেন্দ্রে লিখিত তথ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমার গাইড এবং প্রতিটি চত্বরের ভিতরে দেয়ালের গায়ে লিখিত তথ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এই লেখার রসদ।