শামসেত তাবরেজীর চারটি কবিতা
মুর্দা
শতদল কমল শ্রীঘন
দ্বিতীয় প্রাসাদে,
চিরকাল রাদিভুঁ চক্রে
নিরন্তর কাঁদে।
ব্যর্থ জনম মাগো
একান্দাজ হবার না পেরে,
ঝুল-বারান্দায় বেঁকে
আমি যাই হেরে।
জান না তো দস্যুবাহিনী
দাঁত বিজলায়ে
কাদায় গাড়লো দেহ
গুঁতায়ে-মুতায়ে,
কতই গল্প শুনি
সুভাষিতা বলি,
আড়ালে দেওনই লাগে
আব্বাকে বলি!
কার ঘরে কে ঢুকেছে
কে করে তালাশ,
বেবাক মুর্দা বয়
সে বেটারই লাশ!
অশ্বারূঢ়া
যেই হও না মাতৃঘোড়া, আমি
তোমার পিঠে সওয়ার হব না...
রওজার দ্বার ঠকর ঠকর ঠক
কওন যায় না কে দ্যায় তারে খুলে।
সাত আরশে গর্ত খোঁড়া আছে
বুইড়া ব্যাটার মরণ তবু নাই,
চরণ দুখান বিপদগামী হলে
তখন তারে বরণ করব না!
শুনছি তোমার আছিল্ হিরার ডানা
অশ্বামোদী মাগো, উধাও তা—
রক্তমাখা খিলান ছাড়া আর
অন্য কোন খোয়াব দেখ না?
আত্মরতির কলঙ্ক ফুটতেছে
চাই না আমি, তোমারে চাই না,
গায়ে মেখে আদিম ভর্ৎসনা
বর্ষ এলেন ইসায়ী ক্রুশ চড়ে।
যত পেরেক গাঁথবে দেহে মোর
শিরনি দেবে তোমার পুতেরা,
প্রমাণ করেই ছাড়বে তুমি ছিলা
পিতৃঘোড়ার মাতৃপরিণাম
সেটাও কিন্তু তুমি বুঝবা না...
মোনাজাত
কি শোভা কি ছায়া গো
বেরহম আতশবাজি,
ফুটল আপনা ডেরায়
মোতিলাল সেই বাবাজি।
যার শুধু ফুঁসে ওঠা
গোপন এক প্রাচ্যকলা—
যার লেপ তুলা ওড়া
হর-মাঘ লাফিয়ে চলা।
তাও কি পেল কিছু?
গরিবিই শেষ ভরসা—
তালুতে আমলকী রয়
মুর্দার নাভি ঘষা!
এক ফোঁটা অশ্রু অনল
জন্মের সেই সময়ে,
ঝরেছে মাতৃকূপে
আকারের ইঙ্গিত হয়ে।
সে-ই ফের আবর্তনের
তুলেছে শাল্মলি লাল,
আ-শরীর মতবাদে
জর্জরিত, বেহাল।
ও ছায়া, ও মায়া গো
দাও নাশ শব্দভেদি
একখান আঠালো ঘুম
আল্লার আরশ ছেদি
যেখানে ছিলাম আমি
আমিনার অথই জলে,
শ্যাওলায় পেঁচিয়ে নাম
অতলের গূঢ় তলে!
রাদিভুঁ লীলার গান
তুমি জান না কি দয়াল
ছিলেম জলেতে আমরা
মাখামাখি আশ্চর্য শ্যাওলায়
আমাদের ছিল না বিষাদ চোখে, নক্ষত্রই জ্বলতে আছিল
তুমি জান না কি দয়াল
তথাগত শব্দের ভাব আমরা জেনেছি স্বভাবে
স্বভাবে সভাবে শ-ভাবে
অভাবেও আর অ-ভাবেও
মাছের আঁশটে ঘেঁটে আমরা তো জেনেছি ঠিকানা
চিবুকে চিবুকে ছিল সম্মতি সদা
অবতলা আকাশ মিররে আমরা দেখেছি আমাদের
তুমি জান না কি দয়াল
কমলিওলার আলোকমূল
তারও নিচে হুলুস্থূল
সন্দ কেন তবে?
জাগল কথার ধ্বনিফুল
কুরুশ কাঁটায় তা রিফু
রক্তের গৌরবে।
তুমি জান না কি দয়াল
পাড়ে পাড়ে পাঁড়-এক মাতাল সাথির
সঙ্গে গেছি হাতে লয়ে বাতি,
পুরুষ্ঠ ঠোঁট কামড়ে দিলে পর
ঘুমিয়ে গেছি গেরামের ভিতর...
তুমি জান না কি দয়াল
যতটা গভীর ছিল খাদ—খিতখিতে কাদা
মাড়িয়েছি দুজনার তাম্বুল চেটে
নিরীশ্বর হাওয়ার মির্মিরে আমাদের গেঁথে ছিল গান
হায়, আমাদের তক্ষুনি গেল কিনা ফেটে
উচ্চারের আদ্য ডালিম
আহা লাল কি যে লাল তদীয় মদীয় নানা লাল...
তুমি জান না কি দয়াল
যখন কুসুম দেখছিল কুসুম-বিকাশ
অনন্ত কুসুমে
ফেলোমেন ভাঙা মখমল নরোম
অস্মিতার মুগ্ধিনি আলো
গলে পড়ল রস—আল্লার আরশ
জাফরিকাটা নিরন্তর গোলাপ
পাপড়ির ভাঁজের আড়ালে
কত শিশু হাত-পা ছুড়ল
তুমি জান না কি দয়াল
পুব আর পশ্চিম দুজনা
গলা ধরে এক হয়ে র’লো,
আর, এক অগণন তারকামণ্ডল
এত খুশি যেন দুনিয়ার সরোবরগুলি উঠল উথলি
নাভি পরিধিতে,
পায়ে পায়ে পাহাড় ধসাল নির্মুহূর্তকাল
অযুত-নিযুত-কোটি কাল
নাগ-নাগিনী ত্রিকাল
তুমি জান না কি দয়াল
আর তমাল, আর তমাল, তমাল তনু পাক
ঠিক তারই ধার ঘেঁষে পিঙ্গলার বাঁক
ঢল নদী ছল নদী খুঁজতে গে’ হয়রান
নাকখোলা বাকভোলা—আধ-ডুবন্ত যান
পারভেজ না মদের আসর কিম্বা চঞ্চল
আপ্নাতে রুদ্ধ রয় দলীয় মখমল
জোড় কমল ঘোর কমল ভোর কমল বুঁ
দয়াল তুমি জান না কি আদ্য রাদিভুঁ!